হারাতে বসেছে ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী ৫/১ বেচারাম দেউড়ির ইতিহাস

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় এই ভবনটিতে অনেক আলোচনা সভা হয়েছে। ছবি: প্রবীর দাশ

বেচারাম দেউড়ি- নাম শুনলেই এখন নাকে ভেসে আসে হরেক নাম আর স্বাদের বিরিয়ানির ঘ্রাণ। তবে বেচারাম দেউড়ির ৫/১ নম্বর ভবনটি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নীরব সাক্ষী। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ভবনটিতে অনেক আলোচনা সভা হয়েছে। ভাষাসংগ্রামী এ কে এম গোলাম মোস্তফা ও গোলাম মর্তুজার এ বাড়িটি ছিল ভাষাসংগ্রামীদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র। ইতিহাসের এই অনন্য স্মারকটির কোনো চিহ্নই এখন আর নেই।

ভাষা আন্দোলনের গবেষক এম আর মাহবুবের 'একুশের স্মারক' বই থেকে জানা যায়, বেচারাম দেউড়ির ৫/১ নম্বর বাড়িটি ছিল ভাষা আন্দোলনের অন্যতম তীর্থকেন্দ্র। এখানে ভাষা আন্দোলনের বহু গুরুত্বপূর্ণ সভা হয়েছে। ১৯৪৭-৪৮ সালে ঢাকাইয়াদের বেশিরভাগই ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে কাজ করেছেন। এ রকম প্রতিকূল পরিবেশেও এই বাড়ি থেকে ভাষা আন্দোলনের কার্যক্রম চলেছে। আন্দোলনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পোস্টার ও প্রচারপত্র জমা থাকত এ বাড়িতে।

ভবনটির স্মৃতিচারণ করে এ বাড়ির বাসিন্দা গোলাম মর্তুজা লিখেছেন, 'আমাদের ৫/১ বেচারাম দেউড়ির বাসা ছিল ভাষা আন্দোলন বিষয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তৎকালীন জাঁদরেল নেতারাও এখানে এসেছেন। ভাষা আন্দোলনের অনেক গোপন বৈঠক এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পুরান ঢাকার ভাষা আন্দোলন কর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রও ছিল এটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সবাই আমাদের বাসায় এসেছেন।'

আরেক ভাষাসংগ্রামী আ জ ম তকীয়ুল্লাহ ২০১৫ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ বাড়ির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, 'আমি বহুবার ৫/১ বেচারাম দেউড়ির বাসায় গিয়েছি। সেখানে আমরা গোপন বৈঠকে মিলিত হতাম। এ বাড়ির বাসিন্দা গোলাম মর্তুজা ও গোলাম মোস্তফা ছিলেন আমার পূর্বপরিচিত। তারা বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এই বাড়িটি ছিল ভাষা আন্দোলনের অলিখিত ও অনানুষ্ঠানিক কার্যালয়। তৎকালীন সময়ের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এখানে জমায়েত হতেন।'

এ বিষয়ে ভাষাসংগ্রামী ডা. আহমদ রফিক বলেন, 'এ ভবনটির কথা ও পুরান ঢাকাবাসীর ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা সঠিকভাবে উত্থাপন না হওয়ায় এর বাসিন্দা গোলাম মর্তুজা খুবই মর্মাহত ছিলেন। প্রায়ই তিনি দুঃখ করে বলতেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে পুরান ঢাকার বাসিন্দা, যাদের আমরা 'ঢাকাইয়া' বলে জানি, তাদের ভূমিকা এখনো লেখক ও ইতিহাসবিদের চোখে গৌণ রয়ে গেছে। তার এই অভিযোগ সত্য। বায়ান্নতে, বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারির পরদিন থেকে তাদের ভূমিকার বিস্তারিত বিবরণ এ পর্যন্ত পত্র-পত্রিকায় উঠে আসেনি। সেদিন কারা কারা আহত হয়েছিলেন বা শাহাদাতবরণ করেছিলেন; তারা কোথাকার, কোন মহল্লার বাসিন্দা, তাদের পেশাই বা কী- কোনো গবেষক বা ইতিহাস-লেখক এসব তথ্য পাওয়ার বা সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন বলে জানি না। ভাষা আন্দোলনের এই স্বল্প উদঘাটিত পর্বটি সম্পর্কে গবেষক ও লেখকদের এগিয়ে আসা উচিত।'

কালের বিবর্তনে ৫/১ বেচারাম দেউড়ির ইতিহাস আজ বিস্মৃত। এখন এ ভবনটিতে মায়ের দোয়া বিরিয়ানি হাউজ, রামিছা মেটাল স্টোর, মেহের এন্টারপ্রাইজ ও হাজী মহিউদ্দিন মেটাল স্টোর নামে চারটি দোকান রয়েছে। আর পেছনের অংশে দ্বিতল করে সেখানে কিছু মানুষ বসবাস করেন। ভবনটির চারপাশ ঘুরেও এমন কোনো স্মারকফলক পাওয়া গেল না, যাতে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোঝা যাবে।

এ বাড়ির মালিক এ কে এম গোলাম মোস্তফার ছেলে দুলাল মোস্তফা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এ বাড়িটি ভাষা আন্দোলনের সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আমরা এ বাড়িটি আমাদের দখলে রাখতে পারিনি। যারা বর্তমানে এ বাড়িটি ভোগদখল করছেন, তারা এসব ইতিহাসের বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়।'

Comments

The Daily Star  | English
BNP demands national election by December 2025

BNP to sue election officials, CECs of last three polls

A three-member BNP team, led by its Standing Committee Member Salahuddin Ahmed, will file the complaint

58m ago