‘মুরাদ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন, আইন প্রয়োগকারীরা নীরব কেন?’

সেলিনা হোসেন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সারা হোসেন, সামিনা লুৎফা। ছবি: সংগৃহীত

খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, তার কন্যা জাইমা রহমান ও ছাত্রলীগের নেত্রীদের নিয়ে অশালীন, অনৈতিক, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য এবং চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহিকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে পদ হারিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান। অতীতে এ রকম ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে তৎপর হতে দেখা গেছে। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হওয়ার ঘটনাও আছে। কিন্তু আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।

এ বিষয়ে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফার মন্তব্য জানতে চেয়েছিল দ্য ডেইলি স্টার।

তারা বলেন, মুরাদ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন। শুধু মন্ত্রিসভা থেকেই নয়, তাকে দল ও সংসদ থেকে পদচ্যুত করা উচিত এবং দেশের প্রচলিত আইনে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতায় তারা হতাশা ব্যক্ত করেন।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, 'এ ধরনের মন্তব্য খুবই অশোভন। প্রতিমন্ত্রী কেন, কেউই এমন ঘৃণিত মন্তব্য করতে পারেন না। এসব বলার কোনো অধিকার তাদের নেই। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের জায়গায় এসব কাম্য নয়।'

'পদত্যাগের মাধ্যমে তাকে শাস্তি দেওয়া একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। তবে এটাই চূড়ান্ত সমাধান নয়। আমাদের আইনি ব্যবস্থার আরও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে গতিশীল এবং আরও কঠিন হওয়া দরকার', বলেন তিনি।

'এ ধরনের অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে এবং তাদের কঠোর আইনে শাস্তি হওয়া উচিত। যেন এমন অপরাধ আর কেউ করতে সাহস না করে', যোগ করেন তিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, 'বিষয়টি খুবই নোংরা। এ নিয়ে কথা না বলাই ভালো। সরকার তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে, এটা ভালো। তারপরও বলি এ ক্ষেত্রে পদত্যাগই সমাধান নয়। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।'

'তিনি রাজনৈতিক নারীদের নিয়ে ও নারী অভিনয় শিল্পীর সঙ্গে যে অবমাননাকর ভাষায় কথা বলেছেন, এটা অত্যন্ত রুচিহীন মানসিক বৈকল্যের পরিচয়। ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন নিশ্চয়ই', বলেন তিনি।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, 'এসব ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে এখনই কোনো কথা বলব না। কারণ এটা অনেক জটিল জায়গা। অভিযোগগুলো আদালত পর্যন্ত গেলে আদালত নিশ্চয়ই এর একটি সঠিক সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবেন। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।'

'আমি মনে করি, এ ধরনের পদে যারা যাচ্ছেন, তাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য জোগাড় করে তারপর তাকে দায়িত্বশীল পদ দেওয়া উচিত। তার সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতির জায়গাগুলো জেনে নেওয়া উচিত এবং এসব ঘটনার ক্ষেত্রে আইনের সুস্পষ্ট প্রয়োগ হওয়া উচিত। তা না হলে এমন ঘটনা আগামীতেও ঘটতে পারে।'

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, 'এ ঘটনায় আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা সবচেয়ে অবাক করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে যে হয়রানীমূলক ব্যবস্থা তারা তৈরি করেছে, অন্যসময় তারা যে "উইচ হান্ট" চালান, মধ্যরাতে মানুষের বাসায় চলে যান, তাদেরকে তুলে নিয়ে যান, এ ক্ষেত্রে তারা নীরব কেন?'

'আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পক্ষে না, এ আইন প্রয়োগের বিরুদ্ধে। তবে একজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দ্রুত প্রয়োগ হয়, আর একজনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ না করার বিষয়টি আসলে আইনটিকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে। তিনি মন্ত্রিপরিষদ সদস্য হয়ে এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে রাষ্ট্রের সুনাম নষ্ট করেছেন, মানহানি, ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার মতো গুরুতর অপরাধ করেছেন। তিনি পার পেয়ে যেতে পারেন না', বলেন তিনি।

এই আইনজীবী বলেন, 'আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কখন, কার বিরুদ্ধে মামলা করে বোঝা মুশকিল। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হলে তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহৃত হচ্ছে না। বিরোধীদের ক্ষেত্রে শুধু ত্বরিত ব্যবস্থাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে "মব জাস্টিসের" ব্যবস্থাও করা হচ্ছে, একযোগে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মামলা দেওয়া হচ্ছে।'

'মুরাদ ফেসবুক লাইভে অরুচিকর কথা বলেছেন। ফেসবুকে একটা লাইক, কমেন্ট, শেয়ার দেওয়ার জন্য শিশুরাও পর্যন্ত জেল খাটছে, জামিন পাচ্ছে না, সেখানে রাজনৈতিক দলের সদস্য আইনের ন্যূনতম জবাবদিহিতা থেকে পার পেয়ে যেতে পারেন না', বলেন তিনি।

সারা হোসেন বলেন, 'আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা হচ্ছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানীমূলক কোনো কিছু যাতে না ঘটে, তার ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোচ্চ আদালতের এ আইন উপেক্ষা করার কারও কোনো সুযোগ নেই। মুরাদ একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য, একজন জনপ্রতিনিধি, তারপর প্রতিমন্ত্রী, তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। ক্যাবিনেট প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সংসদ নেতা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, দল থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, 'মুরাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেত্রী এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অত্যন্ত জঘন্য, নিন্দনীয় কথা বলেছেন। জনগণের করের টাকায় দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত মানুষের কাছ থেকে আমরা এ ধরনের ভয়ঙ্কর সংকীর্ণ, বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক কথা জনপরিসরে শুনতে চাই না। এটা কোনোভাবেই ছেড়ে দেওয়ার মতো ঘটনা নয়। এটা একটা শাস্তিযোগ্য বাচিক হয়রানি। এ অপরাধের জন্য তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।'

'তারা ক্ষমতার দম্ভের কারণে এরকম কথা বলেন। এই যে ভয় দেখানোর সংস্কৃতি, নারীকে নানাভাবে দুশ্চরিত্র প্রমাণের চেষ্টা এবং নারীর ওপর জুলুম করে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের যে প্রবণতা, এগুলো তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকেই উৎসারিত হয়। তারা মনে করেন তাদের এই ক্ষমতাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করবে না', বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, 'মুরাদকে শুধু পদত্যাগের নির্দেশনার মধ্যে আমরা একটা দায়মুক্তি দেখছি। তিনি খালেদা জিয়া এবং জাইমা রহমানকে নিয়ে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তার দলের আরও অনেকেই আছেন যারাও প্রায়শই অনেকটা এভাবেই কথা বলে থাকেন। সরকারি দলের বলেই তিনি এ ধরনের দম্ভ করার সাহস দেখিয়েছেন। এরকম পটেনশিয়াল রেপিস্ট তাদের দলে সম্ভবত আরও আছে।'

'আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে উঠিয়ে নিয়ে ধর্ষণের যে হুমকি তিনি দিয়েছেন, তাহলে ধরে নিতে হবে এমন ঘটনা ঘটে। না হলে তিনি কেন বলেছেন। তার কথোপকথন থেকে বোঝা যায় যে, এ ধরনের কাণ্ড-কারখানা তিনি এর আগে আরও করেছেন', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Session delays, irregularities, and lack of central planning cited as reasons

11h ago