‘ভয়ের আবহ তৈরি করতেই মিজানকে তুলে নেওয়া হয়েছিল’

ডিবি অফিস থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মিজানুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান মিজানকে গত বৃহস্পতিবার পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল। পরিবার ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে শ্যামপুর থানা ও ডিবি অফিসে যোগাযোগ করা হলে শুরুতে তাকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে কেউই কোনো তথ্য দেয়নি।

শুরুর দিকে মিজানুর রহমানকে তার পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেতে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে ডিবি অফিসে তার সন্ধান পাওয়া যায় এবং প্রায় ৬ ঘণ্টা পর বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

মিজানুর রহমান ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল ওয়াসা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানকে ওয়াসার পানি দিয়ে তৈরি 'শরবত' খাওয়াতে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে মিজানুর রহমান আলোচনায় আসেন। বিভিন্ন সময় তাকে অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে।

সাধারণ মানুষকে কেন কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়, তা জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রবাসী লেখক মারুফ মল্লিকের সঙ্গে।

তারা ৩ জনই বলেছেন, অন্যায়, অনিয়ম ও অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলায় মানুষের মধ্যে ভয়ের আবহ তৈরি করতে এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, 'জুরাইন এলাকাসহ দেশের সর্বজন যাতে ভালো পানি পায়, যাতে স্বাস্থ্যকর আবাস পায়, দেশের মানুষ যাতে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির সময়ে যাতে গরিব মানুষ খাবার পায়, শিশুরা যাতে খেলার মাঠ পায়, স্কুলে যাতে ক্লাসরুম ঠিক থাকে, যাতে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে, ঘরে বাইরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, যাতে জনগণের কাছে দেওয়া সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না হয়, তাদের কথা ও কাজের যেন অসঙ্গতি না থাকে, যাতে মানুষ গুম খুনের শিকার না হয়, যেন সুন্দরবন বাঁচে, বাংলাদেশ বাঁচে, নদী সমুদ্র বাঁচে ইত্যাদি সবক্ষেত্রে যুক্তি, তথ্য আর আত্মসম্মানবোধ নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান মিজানুর রহমান। তিনি বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে লেখেন, মানুষের কাছে যান, সমাবেশ করেন, পুলিশ কর্মকর্তা, কমিশনার, সংসদ সদস্য, মেয়রদের বোঝাতেও চেষ্টা করেন। দেশে এরকম অসংখ্য মিজান দরকার।'

'যারা দখলদারিত্ব নিয়ে কাজ করেন, যারা সুবিধাভোগী, প্রশাসনের ওপর তাদের প্রভাব বেশি। আমার আশঙ্কা জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলায় যারা ক্ষুণ্ন হন, তাদের প্রভাবেই পুলিশ মিজানকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল', বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'মিজানকে আইনি প্রক্রিয়ায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়নি। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে আইনি প্রক্রিয়ায় সব করতে হবে। মিজানকে তুলে নিয়ে যাওয়া দেশের অন্যান্য নাগরিকের জন্য বড় হুমকি বলে আমি মনে করি। যারা অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য, তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এভাবে অবৈধভাবে তুলে নিয়ে যায় হয়।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, 'মিজানুর রহমানকে কেন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা ধারণা করা খুব কঠিন নয়। তিনি সবসময় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি ভয়-ডরহীনভাবে সরকারের অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেন।'

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারুফ মল্লিক বলেন, 'কাউকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই তুলে নিয়ে যাওয়া আমাদের দেশে নতুন কিছু না। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য, জনমনে ভয়ের আবহ তৈরির জন্য এভাবে কোনো কারণ ছাড়াই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।'

তিনি বলেন, 'আলজেরিয়ায় ১৯৫০-৬০ এর দশকে এভাবে সাধারণ মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করা হতো। তাদের ভয় দেখানো হতো। পরবর্তীতে ১৯৬০-৭০ দশকের শুরুর দিকে দক্ষিণ আমেরিকায় এই তুলে নিয়ে গিয়ে গুম, হত্যার সংস্কৃতি ছিল। আমাদের দেশে অনেক দিন দিন ধরেই ভয়ের আবহ তৈরির জন্য যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। যা সম্পূর্ণ বেআইনি।'

মিজানুর রহমান সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মিজান অনেকদিন ধরেই টার্গেটে ছিলেন বলে আমার মনে হয়। তিনি সব সময় খুন, গুম, ওয়াসার পানিসহ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন, লেখালেখি করেন। তার মুখ বন্ধ করতে, তাকে ও তার পরিবারকে ভয় দেখাতেই তুলে নেওয়া হয়েছিল বলে আমার মনে হয়।'

Comments

The Daily Star  | English
Impact of Trump trade policies on Bangladesh

Bangladesh sees window of opportunity in Trump’s trade war

US President-elect Donald Trump’s trade policies towards China and Mexico could ultimately benefit Bangladesh, according to local apparel exporters.

11h ago