পুলিশ কি জনবান্ধব

পুলিশ কি জনবান্ধব? প্রশ্নটা ক্ষণে ক্ষণে ঘুরছে। ১৯ আগস্ট ২০২২। হাতিরঝিল থানায় সুমন শেখ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযোগ অর্থ চুরি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই থানায় সুমনের মৃত্যু হয়। এখন জানার আর সুযোগ থাকলো না, সুমন আদৌ অর্থ চুরি করেছে, নাকি করেনি।

পুলিশ বলছে, সুমন আত্মহত্যা করেছে। স্বজনদের অভিযোগ, সুমনকে মেরে ফেলা হয়েছে। আত্মহত্যার কথা বলে পুলিশ দায় এড়াতে চেষ্টা করছে। পরিবারের অভিযোগ, সুমনকে ধরার পর পুলিশ ৫ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দেওয়ায় পুলিশ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

প্রশ্ন হলো, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু এটাই কি প্রথম? অবশ্যই না।

১০ অক্টোবর ২০২০। মধ্যরাত। সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দর বাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে রায়হান আহমদকে নির্যাতন করা হয়। ১১ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়। রায়হান আহমদকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়াসহ পুলিশ সদস্যদের বিচার প্রক্রিয়াধীন।

৭ জানুয়ারি ২০২২। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানায় পুলিশ হেফাজতে হিমাংশু রায়ের মৃত্যু হয়। সব জায়গায় ঘটনা একই।

পুলিশ হেফাজতে এমন মৃত্যুর উদাহরণ বলে শেষ করা যাবে না। প্রশ্ন হলো, পুলিশ হেফাজতে কেন মৃত্যু হচ্ছে?

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, ২০২১ সালের প্রথম ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) 'বন্দুকযুদ্ধে' ৩৫ জন নিহত হন, আর হেফাজতে মারা যান ৩ জন। ২০২২ সালের প্রথম ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) 'বন্দুকযুদ্ধে' মারা গেছেন ২ জন, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের।

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা মনে আসতেই 'জয় ভীম' সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়। গল্পটা ছিল এইরকম, একজন বিত্তশালীর বাসায় চুরি হয়। তাতে সন্দেহ করা হয় দলিত সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে থানায় অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। তাদেরকে চুরির দায় স্বীকার করতে বলে, কিন্তু তারা করে না। কারণ তারা আসলে চুরি করেনি। নাছোড়বান্দা পুলিশ তা প্রমাণে উঠে পড়ে লাগে। এরই মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। পুলিশ সেই ঘটনা নিজেদের মতো করে সাজিয়ে প্রমাণ করতে থাকে। পুরো ঘটনা প্রমাণিত হয় আদালতে। আইনজীবী প্রমাণ করে দেন, আসলে পুলিশ তাকে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে।

বাংলাদেশে এই ধরনের সিনেমা বানানো তো অসম্ভব। বরং পুলিশের বিরুদ্ধে কিছু লেখাও কঠিন। জনগণের সেবা করতে গেলে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকবে, কিন্তু তা যে সংশোধনযোগ্য তা যেন আমাদের পুলিশ বিভাগ ভুলে যায়।

হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি, বাসা থেকে তুলে নেওয়া, মাদক সম্পৃক্ততা— সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে পুলিশ জড়িত এবং তা প্রমাণিত। ক্ষেত্র বিশেষে পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠে, যা গোটা সিস্টেমকে বিব্রত করে। যেমন সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ড, ডিআইজি মিজানের দুর্নীতি, চট্টগ্রাম কারাগারে লক্ষাধিক টাকা ঘুষ নেওয়ার ঘটনা, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বাবুল আক্তারের ঘটনা, দিনাজপুরের ইয়াসমিনকে থানায় ধর্ষণ, ১৯৯৮ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে শামীম রেজা রুবেলের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ৫৪ ধারায় মামলা দেওয়া, রাজপথে হেফাজতে ইসলামকে সরানো বাদ দিয়ে তাদের সঙ্গে দোয়ায় সামিল হওয়া, টিপ পরার ঘটনায় নারী হেনস্তাকারী পুলিশ নাজমুল তারেকের কর্মকাণ্ড— এর সবই পুলিশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর কি সমাধান নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু আমরা কি সেই পথে হাঁটছি? হাঁটছি না।

শুধু পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু নয়, বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছিল ২০২২ সালের জুন মাসে। মানবাধিকার কর্মী মিজানুর রহমান, থাকেন জুরাইনে। পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যথারীতি সেই অভিযোগও প্রথমে পুলিশ অস্বীকার করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে তা প্রমাণিত হয়। আমরা সেটা জানতে পারি মিজানুর রহমানের বক্তব্যে।

তিনি বলেন, 'আমার মনে হলো যে, তারা আমাকে ধরতে পারে। তখন আমি মার্কেটের ভেতরে ঢুকে গেলাম। তখন তারা দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেলে। তারা আমার নাম জিজ্ঞেস করল। বলল, আপনার সঙ্গে আমাদের ডিসি স্যার একটু কথা বলবেন।'

'...গাড়িতে ওঠানোর পর পুলিশ আমার সঙ্গে একটু খারাপ আচরণ করল। জোর করে আমার মোবাইল ফোন নিয়ে নিল। ...একটা পর্যায়ে আমাকে ওই রুমে থাকা নারী কর্মকর্তা মারার নির্দেশও দিলেন। এর আগে আমি দেখছিলাম, পুলিশ পাশে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুরুতে লাঠি ছিল না। পরে এনেছে। নির্দেশ পাওয়ার পর আমার গায়ে কয়েকটা বাড়ি দিল। জোরেই দিল।'

প্রতিবার যাদের তুলে নেওয়া হয় তাদের কেউই আর মুখ খোলেন না। কারণ পুলিশ তাদের ভয় দেখায়। জুরাইনের মিজানুর রহমান মুখ খুলেছেন। তাকেও ভয় দেখানো হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, পুলিশের কাজ কী জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া, নাকি জনগণকে তুলে নেওয়া?

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ অসংখ্য হলেও সমাধানের গতি কিন্তু বেশ ধীর। থানায় জিডি বা মামলা করতে চাইলেও পুলিশ মামলা তো দূরের কথা জিডিই করতে চায় না।

মানবাধিকার কর্মী খুশি কবীর বলেন, 'মামলা না নেওয়ার ঘটনা শুধু যে নিখোঁজের ক্ষেত্রে ঘটে তা নয়, নারী নির্যাতন, অপহরণসহ অন্যান্য বিষয়েও থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতে চায় না। মামলা করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। আমি জানি না, তারা কেন এটা করে।'

বলছিলাম পুলিশে হেফাজতে সুমন শেখের মৃত্যুর কথা। সুমন শেখের মৃত্যুতে যে প্রশ্নগুলো ফিরে ফিরে আসে তা হলো, সুমন শেখ যদি অপরাধী হয় তাহলে তার অপরাধ কেন প্রমাণের সুযোগ দেওয়া হলো না? সুমনকে কেন নির্যাতন করা হলো? সুমনের কাছে পুলিশ কেন ৫ লাখ চেয়েছিল? যদি সুমন ৫ লাখ টাকা দিত তবে কি তাকে ছেড়ে দেওয়া হতো? নিশ্চয়ই না। পরে অন্য কোনো অপরাধে তাকে আবার আসামি করা হতো। যেমনটা আমরা জেনেছি, জুরাইনের মিজানুর রহমানের বক্তব্যে। তার পকেটেও ইয়াবা দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি।

উপরের ঘটনাগুলো মনে যে শঙ্কা তৈরি করে তা হলো, পুলিশ সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, সেটা প্রমাণিত। পুলিশের আধুনিকায়ন জরুরি এটাও সত্য। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা পুলিশের জন্য যে আইন প্রণয়ন করেছিল, ১৫৯ বছরে তা আর পরিবর্তিত হয়নি। তার আধুনিকায়ন দরকার।

শুধু আধুনিকায়ন নয়, কোনো পুলিশ সদস্য যদি অপরাধী হয় তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। তাকে আড়াল করার নামে অন্যরা যেন উৎসাহিত না হয়। যেমন টিপকাণ্ডে নাজমুল তারেক যে অপরাধী তা প্রমাণিত, শুরু থেকেই তাকে আড়াল করার চেষ্টা যেন গোটা পুলিশ বাহিনীর। তা নিশ্চয়ই হওয়ার কথা ছিল না। এতে করে অন্য পুলিশ সদস্যরা অপরাধ করার সুযোগ পায়। সেই সুযোগ বন্ধ করতে হবে। পুলিশ সদস্যের মানসিক উন্নয়ন ঘটাতে তাদের অনেক বেশি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। না হয় পুলিশ কর্তৃক অপরাধ বাড়তেই থাকবে।

বিনয় দত্ত: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

benoydutta.writer@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch a party by next Feb

Student leaders who spearheaded the July-August mass uprising are planning to launch a political party by early February 2025 and contest the next general election.

7h ago