পদ্মা সেতু: ১৪ হাজার শ্রমিক-প্রকৌশলী কাজ করেছেন সাড়ে ৭ বছর
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর। আর সেই কাজ সম্পন্ন হয় চলতি বছরের ২২ জুন। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা।
সেতুটির নির্মাণ শেষ হতে সময় লেগেছে ৯০ মাস ২৭ দিন কিংবা ২ হাজার ৭৬৫ দিন কিংবা ৭ বছর ৬ মাস ২৭ দিন। দিনরাত খেটে কাজ করেছেন প্রায় ১৪ হাজার দেশি-বিদেশি শ্রমিক, প্রকৌশলী ও পরামর্শক। এরমধ্যে প্রায় এক হাজার ২০০ দেশি প্রকৌশলী, দুই হাজার ৫০০ বিদেশি প্রকৌশলী, প্রায় ৭ হাজার ৫০০ দেশি শ্রমিক, আড়াই হাজার বিদেশি শ্রমিক এবং প্রায় ৩০০ দেশি-বিদেশি পরামর্শক কাজ করেছেন।
পদ্মা সেতুর প্রকৌশলী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রকৌশলীরা জানান, চীন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড, কোরিয়া, নেদারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ ২০টি দেশের প্রকৌশলীরা এখানে কর্মরত ছিলেন।
এ ছাড়া, মুন্সিগঞ্জ, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, গাইবান্ধা, যশোর, নোয়াখালী, বরিশাল, বগুড়া, টাঙ্গাইলসহ ১৫-২০টি জেলার মানুষ পদ্মা সেতুতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। কয়েকটি শিফটে একেকজন শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করে। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও অনেকে কাজ করেছে। তাদেরকে অতিরিক্ত মজুরিও দেওয়া হয়েছে। সেতু নির্মাণে শুরুতে প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের যে সংখ্যা ছিল, তা বর্তমানে কমে এসেছে। কারণ, বিভিন্ন ধাপের কাজ শেষ হয়ে গেলে তাদের আর দরকার হয় না।
প্রকৌশলীরা বলছেন, এ সেতু নির্মাণের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কাজ করতে গিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা সামনে দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে। যারা এখানে কাজ করেছেন, তারা দেশের অন্যান্য বড় স্থাপনা নির্মাণে যেকোনো বাধা সহজেই অতিক্রম করতে পারবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রকৌশলীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এমন অনেক প্রযুক্তি এখানে ব্যবহার হয়েছে, যা পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি সেতুতে ব্যবহার হয়েছে। এতে তারা ভিন্নধর্মী ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছে।
সেতুতে কর্মরত শ্রমিক আরিফ হোসেন বলেন, '২০১৪ সাল থেকে এখানে কর্মরত আছি। পথিমধ্যে নানা বাধাবিপত্তি এসেছিল। কিন্তু, আমরা রাতদিন খেটে কাজ করে গিয়েছি। মানুষজন যখন সেতু নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতো, তখন আমরা চুপ হয়ে যেতাম। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ছিল সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে সেতুটি পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে। এখন তাই হলো। প্রমত্তা পদ্মা পার হওয়া যাবে এ সেতুর মাধ্যমে। আর এটি আমরা করে দেখিয়েছি।'
সেতুতে কর্মরত সেফটি ইনচার্জ আলমগীর হোসেন জানান, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করেছিলাম সেতুতে। শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনা করা ছিল আমার দায়িত্ব। করোনার মধ্যে লকডাউনে পুরো দেশ অচল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর কাজ থেমে থাকেনি। গতি কম হলেও কাজ এগিয়ে গিয়েছে। প্রমত্তা পদ্মায় ঝড়-বৃষ্টি, তীব্র রোদ উপেক্ষা করেই কাজ করে গেছে শ্রমিক-প্রকৌশলীরা। ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলেছে।'
প্রায় ৪ বছর সেতুতে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন রাহাত হোসেন। তিনি বলেন, 'ঈদের মধ্যে সবাই যখন পরিবার নিয়ে ঈদ আনন্দ উদযাপন করেছিল, তখন আমরা সেতুতে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কাজের গতি স্বাভাবিক রাখতে অনেক শ্রমিক-প্রকৌশলী ছুটি নেননি। বিভিন্ন উৎসবগুলোতেও আমরা সেতু এলাকাতেই অবস্থান করেছি। প্রিয়জনদের মুখও বহুদিন আমরা দেখিনি। এসব ত্যাগ সফল হয়েছে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী জানান, মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে চীনের থেকে স্টিলের টুকরো দেশে আসে, এরপর এসব জোড়া লাগিয়ে স্প্যানের আকার তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া তৈরি হয়েছে স্ল্যাব। পিলার নির্মাণের পর স্প্যান বসানোর মতো কঠিন কাজটি সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। প্রথম স্প্যান থেকে ধারাবাহিকভাবে বসিয়ে শেষ পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে ৩৮ মাস ১০ দিন। দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাব ও দুই হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হয়েছে সফলভাবে।
উল্লেখ্য, এ প্রকল্পের মোট বাজেট প্রায় ৩০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধু মূল সেতুর কাজের চুক্তিমূল্য প্রায় ১২ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা।
Comments