ইভিএমে নির্বাচন: সরকারের প্রতি বিএনপির অবিশ্বাস আরও বাড়বে
জাতীয় নির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্রে ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের ইঙ্গিত ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বিএনপির অবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে ইভিএম এবং একটি পক্ষপাতদুষ্ট সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছে।
গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে ৩০০টি আসনের সবগুলোতেই ইভিএম ব্যবহার করা হবে এবং নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইভিএম ইস্যুটি সর্বদলীয় নির্বাচনের জন্য সরকারের উদ্যোগের ক্ষতি করতে পারে। কেননা, বেশিরভাগ দল ও নাগরিক সমাজের সদস্য সাধারণ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, 'আগামী নির্বাচন নিয়ে মূল প্রশ্ন হচ্ছে, কোন ধরনের সরকারের অধীনে এটি অনুষ্ঠিত হবে। এটা তো স্পষ্ট যে, পক্ষপাতদুষ্ট সরকারের অধীনে সুষ্ঠু বা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব না। এটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন এবং কোনো বিতর্কিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর সমাধান করা হচ্ছে বললেই তার সত্যতা নিশ্চিত করা যাবে না।'
তিনি জানান, ইভিএম, বিশেষ করে যে মেশিনে 'ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল' নেই, সেগুলোতে ভোট কারচুপি করা যায়।
তিনি বলেন, 'এ ধরনের মেশিন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বাতিল করে দিয়েছে। কাজেই, এই ধরনের একটি বিতর্কে জড়িয়ে পরা অর্থহীন। কে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? কোনো রাজনৈতিক দল, ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল, কেউই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এবং নেওয়া উচিত না।'
তিনি আরও বলেন, 'নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তারা এমন একটি মেশিনে ভোট গ্রহণের কথা ভাবছে, যে মেশিন নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ আপত্তি জানিয়েছে?'
'নির্বাচন কমিশন এখনও এমন কোনো লক্ষণ দেখায়নি যাতে ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পারে। তাদের বরং উচিত হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ইচ্ছুক এমন একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে নিজেদের পুনর্নির্মাণের দিকে মনোনিবেশ করা,' যোগ করেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ক্ষমতাসীন দলকে বিশ্বাস না করার জন্য বিরোধী দলগুলোর যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে তারা আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী দিনে উভয়পক্ষই ঐকমত্যে পৌঁছাবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, 'ক্ষমতাসীন দল সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছে। হতে পারে এর জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে যে, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।'
৭ মে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পরপরই বিএনপি বলেছে, ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে ভোট কারচুপির একটি নতুন কৌশল এবং দলটি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, এই সরকারের অধীনে 'অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়'।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। তারা একটি নির্দলীয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানায়। দাবি পূরণ না হলেও পরের জাতীয় নির্বাচনে দলটি অংশ নেয় এবং 'ভোট কারচুপি'র নির্বাচনে মাত্র ৬টি আসনে জয় পায়।
বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে সেগুলোও বর্জন শুরু করে।
তবে আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার অসাংবিধানিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, আগামী দিনে উভয়পক্ষই তাদের কঠোর অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে।
তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারেনি। বাস্তবতা যাই হোক না কেন, এর দায় অনেকাংশেই শাসক দলের ওপর বর্তায়।'
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে সংসদের বাইরে থাকায় নির্বাচন বর্জন করলে তা হবে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।
তিনি বলেন, এসব বিষয় মাথায় রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই ঐকমত্যে আসবে। তবে তা কীভাবে হবে তা এখনই বলা কঠিন।'
Comments