ঢাকার বুকে শতবর্ষী হাট
কংক্রিটের শহর ঢাকায় হাট বসে—এ তথ্যটিই চমকে দেয়! হাট শব্দটি কানে এলেই কল্পনার চোখে ভেসে ওঠে গ্রামের দৃশ্যপট। যেখানে নদীর তীরে কিংবা বিশালাকার বটের ছায়ায় সপ্তাহের নির্দিষ্ট কোনো একটি দিনে জমে নানা পণ্যের সমাহার।
প্রতি বুধবার রাজধানীর বনশ্রীর পাশে মেরাদিয়া এলাকায় তেমন একটি হাট বসে। গ্রামীণ আবহে না হলেও, টাটকা সব পণ্যের পসরা সাজিয়ে হাটুরেরা বসেন বুধবার।
এই হাটে প্রায় ৬০ বছর ধরে নিয়মিত বসেন আব্দুল লতিফ। মেরাদিয়া হাটের বয়স কত—জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি পাকিস্তান আমল থেকে এখানে বসি। আমার বাপ-দাদারাও এ হাটে আসতো। সঠিক বলতে পারবো না এর বয়স কত। তবে এ হাট ব্রিটিশ আমলের হাট।
'ব্রিটিশ আমলের হাট'—আপাতত এ তথ্য নিয়ে হাটে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বেশ ভিড়। বুধবার ভোর থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁক-ডাকে জমজমাট হয়ে ওঠে মেরাদিয়া। বিক্রি ভালো হওয়ায় হাটের পরিসরও বেড়েছে। রাস্তার দুপাশে, খালি জায়গায় এখানে-সেখানে মৌসুমী সবজি, টাটকা মাছ ও রঙিন পণ্যের সমাহার।
কাছের হাটুরেরা নিজেরাই নিয়ে আসেন নিজেদের পণ্য। কেউ শাক-সবজি, কেউ ফল, কেউবা গরু, ছাগল, হাস-মুরগি নিয়ে আসেন। অনেকে আনেন খাঁটি ও টাটকা দুধ। হাটের যেখানেই খালি জায়গা, সেখানেই চট করে বসে পড়েন তারা। শামিয়ানা-ত্রিপল-কাপড় টানিয়ে তো বটেই, অনেকে আবার পুরাতন খবরের কাগজ পেতে নিজেদের পণ্যের বিক্রি করতে বসে পড়েন।
সড়কের পাশের খালি জায়গায় সবচেয়ে বেশি দেখা মিলল বাঁশের তৈরি পণ্য বিক্রেতার। আর ভেতরের দিকে কাপড়ের দোকান। হাটের পশ্চিমে বিক্রি হচ্ছে শাক-সবজি। লাল শাক, পালং শাক, মুলা, ডাঁটা, বেগুন, আলু, শিম, করলা, লাউ, মিষ্টি কুমড়াসহ আরও অনেক সবজি। টাটকা সব সবজি দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়, দামও তুলনামূলক কম।
উত্তর দিকে পাওয়া যায় মাছ। দেশি কৈ, মাগুর, শিং, পুঁটি, চিংড়ি, টেংরা, মলা, টাকি, শোল মাছ এই হাটে পাওয়া যায় নিয়মিত। অন্যান্য দিনেও মাছ আর সবজির দোকানগুলো বসে মেরাদিয়ায়।
হাঁস-মুরগির দোকানগুলোও মাছের দোকানের ঠিক পাশেই। খাঁচার বাইরেও দুএকটি হাঁস-মুরগি বেঁধে রাখা হয়েছে। পাশেই একদিকে গরু, অন্যদিকে বিক্রি হচ্ছে খাসি। কেজি হিসেবে বিক্রি হয়, চাইলে পুরোটাও কেনা সম্ভব এখান থেকে।
হাটের এক কোণে জিলাপি, আমৃত্তি আর মিষ্টি নিয়ে বসেছিলেন স্বপন চন্দ্র দাস। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ৫০ বছর ধরে এখানে প্রতি হাটবারে মিষ্টি বিক্রি করছি। হাট আগের মতো জমজমাট না থাকলেও, যা বিক্রি হয় তা মন্দ না।
তার কাছেও প্রশ্ন ছিল হাটের বয়স কত? তবে এখানেও উত্তরটি জানা সম্ভব হয়নি।
১৯৮৮ সাল থেকে মেরাদিয়া হাটে সবজি বিক্রি করছেন মো. সোহরাব। তিনি বলেন, আগের চেয়ে লোক কমেছে। যারা এ হাট সম্পর্কে জানেন, তারা এখানে এসেই কেনেন।
ডেমরা এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, এখানকার সবজিগুলো টাটকা। মেডিসিন ছাড়া। ফলে দাম কিছুটা বেশি হলেও হাটবারে এসে কেনাকাটা করি।
মেরাদিয়া হাটে বাঁশের তৈরি পণ্য ও শুঁটকির বিশেষ চাহিদা আছে। রাস্তার পাশে বাঁশের পণ্য নিয়ে বসে ছিলেন হযরত আলী। তিনি বলেন, আগের মতো আর বেচাকেনা নেই। তবে বাঁশের জিনিস যারা পছন্দ করেন, তারা এখান থেকে পণ্য কেনেন।
একই কথা বললেন তার পাশে থাকা আরেক বিক্রেতা মজিবুর। তিনি বলেন, লোকজন যারা এখানে আসেন, তারা কিনতেই আসেন। ফলে এখানে বিক্রি খারাপ হয় না।
নরসিংদী থেকে শুটকি নিয়ে গত ৩০ বছর ধরে প্রতি বুধবারে হাটে আসেন নীল কমল দাস। তিনি বলেন, করোনার আগেও বিক্রি ভালো ছিল। কিন্তু এখন বিক্রি কমে গেছে। তবে যা বিক্রি হয়, তা খারাপ না।
বিক্রেতাদের সঙ্গে বলে জানা গেল, আশে-পাশের রামপুরা, বনশ্রী থেকে শুরু করে আফতাবনগর, বাড্ডা, খিলগাঁও, সাঁতারকুল, নাসিরাবাদ এলাকা থেকে বেশি ক্রেতা আসেন। আর বিক্রেতারা বেশি আসেন ফকিরখালী, ডেমরা, বাড্ডা, বেরাইদ, ইছাপুর, রূপগঞ্জ থেকে। এ ছাড়া, নাসিরাবাদ, রামপুরা, বনশ্রী, ভুলতা, খিলগাঁও থেকেও অনেক বিক্রেতা এ হাটে আসেন।
হাট থেকে ফিরার সময় টাটকা ডাব খেতে খেতে কথা হলো বনশ্রীর বাসিন্দা আব্দুল মতিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, হাট কবে চালু হয়েছে তা জানা না গেলেও, এ হাট ঢাকায় গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। পাড়া-মহল্লায়, অলিগলিতে অনেক দোকানপাট হলেও এখনো টিকে আছে রাজধানীর এই শতবর্ষী হাট। এ হাট আমাদের ঐতিহ্যের একটি অংশ এখন।
তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখ পড়লো পার্শ্ববর্তী নড়াই নদ। সেখানকার কালো পানি ঠেলে নৌকায় করে আসছে সবজি। নদীর বুক চিরে এভাবেই শত বছর ধরে মেরাদিয়া হাটের ঘাটে নৌকা এসে ভেড়ে এখনো।
Comments