কৃত্রিম প্রজননে সফল মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট

আবার পানিতে ঢেউ তুলবে কাকিলা

কাকিলা মাছ। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় হারিয়ে যাওয়া স্বাদু পানির মাছ কাকিলার কৃত্রিম প্রজনন কলাকৌশল উদ্ভাবনে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা। মুক্ত জলাশয়ের এই মাছটিকে বদ্ধ পরিবেশে অভ্যস্তকরণেও সাফল্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ফলে এই মাছটির প্রাচুর্য আবারও ফিরবে বলে আশা করছেন তারা।

বিএফআরআইর স্বাদু পানি উপকেন্দ্র যশোরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. রবিউল আউয়াল হোসেন, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিশির কুমার দে এই গবেষণা পরিচালনা করেন।

গবেষক দলের সদস্য ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বুধবার বিকেলে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তিন বছর নিবিড় গবেষণার পরে এখন সাফল্য এসেছে। ফলে কাকিলা বিলুপ্তির আশঙ্কার বদলে আবারও পানিতে ঢেউ তুলবে বলে আশা করা যায়। কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজনন এটিই বাংলাদেশ প্রথম এবং বিশ্বের কোথাও এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।'

বিএফআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বাদু পানির অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে বিশেষ করে নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল ইত্যাদি জলাশয়ে যে মাছগুলো পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে কাকিলা অন্যতম। খেতে সুস্বাদু এই মাছটি মানব দেহের জন্য উপকারী অনুপুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এবং কাটা কম বিধায় অনেকের কাছে প্রিয়।

এক সময় অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মানবসৃষ্ট নানাবিধ কারণে বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ মাছের প্রাচুর্যতা ব্যাপকহারে কমে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তারা এই মাছটির প্রাচুর্যতা ফিরিয়ে আনতে গবেষণা শুরু করেন।

এই বিজ্ঞানীরা জানান, কাকিলা বা 'কাখলে' একটি বিলুপ্তপ্রায় মাছ। এর দেহ সরু, ঠোঁট লম্বাটে ও ধারালো দাঁতযুক্ত। বাংলাদেশে যে জাতটি পাওয়া যায়, সেটি মিঠা পানির জাত। মাছটি বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে কাইকল্যা, কাইক্কা নামেই বেশি পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Xenentodon cancila. মাছটিকে ইংরেজিতে 'ফ্রেশওয়াটার গারফিশ' বলে। এটি Belonidae পরিবারের অন্তর্গত। বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে এ মাছ পাওয়া যায়। তবে, রং ও আকারে কিছু পার্থক্য থাকে।

গবেষক দলের প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. রবিউল আউয়াল হোসেন জানান, কাকিলা মূলত ছোট মাছ খেয়ে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে প্রবহমান জলাশয়ে বিশেষ করে নদীতে এবং বর্ষাকালে প্লাবিত অঞ্চলে প্রজনন করে থাকে। পরিণত মাছেরা ভাসমান জলজ উদ্ভিদ নেই এমন স্থানে বসবাস করলেও জলজ উদ্ভিদের পাতার নিচে ও ভাসমান শেকড়ে এদের স্ত্রীরা ডিম পাড়ে।

গবেষক দলের সদস্যরা জানান, তারা তাদের গবেষণায় রাজবাড়ি জেলা সংলগ্ন কুষ্টিয়ার পদ্মা নদী থেকে কাকিলা ব্রুড (মা-বাবা মাছ) মাছ সংগ্রহ করে বিশেষ পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে যশোরের স্বাদু পানি উপকেন্দ্রের পুকুরে ছাড়েন। পরে হ্যাচারিতে উৎপাদিত কার্প জাতীয় মাছের জীবিত পোনা ও নানা জলাশয় থেকে সংগৃহীত জীবিত ছোট মাছ খাইয়ে পুকুরের আবদ্ধ পরিবেশে মাছকে অভ্যস্ত করা হয়।

পরে চলতি বছরের মে থেকে বৈজ্ঞানিক প্রটোকল অনুসরণ করে কৃত্রিম প্রজননের উদ্দেশ্যে উপকেন্দ্রের হ্যাচারিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক মা-বাবা মাছকে বিভিন্ন ডোজে হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। এভাবে কয়েকবার বিভিন্ন ডোজের ট্রায়াল দেওয়া হলেও মাছের প্রজননে সফলতা আসেনি। অবশেষে ২৫ আগস্ট প্রজননকৃত মাছের ডিম থেকে পোনা বের হয় এবং কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা আসে।

ড. মো. রবিউল আউয়াল হোসেন জানান, কাকিলা মাছের প্রজননের জন্য পিজি (পিটুইটারি গ্ল্যান্ড) হরমোন ব্যবহার করা হয়। গত ১৮ আগস্ট পুকুর থেকে মাছ ধরে চার জোড়া মা-বাবা নির্বাচন করে হ্যাচারির চৌবাচ্চায় নির্দিষ্ট সময় ঝর্ণাধারা দিয়ে মা-বাবা মাছকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় হরমোন ইনজেকশন দেওয়া হয়। পরে মা-বাবা মাছকে একত্রে একটি চৌবাচ্চায় রেখে ঝর্ণাধারা দিয়ে সেখানে কচুরি পানা রাখা হয়। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পরে মা মাছ ডিম ছাড়ে। ডিমের ভেতরে বাচ্চার বিভিন্ন দশা ও উন্নয়ন অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। ডিম ছাড়ার প্রায় ৯০ থেকে ১০০ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়।

গবেষক দলের সদস্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিশির কুমার দে বলেন, কাকিলা মাছের প্রজননের ট্রায়ালের সময় চৌবাচ্চার পানির গড় তাপমাত্রা ছিল ২৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল চার দশমিক পাঁচ মিলিগ্রাম/লিটার, পিএইচ ছিল সাত দশমিক ছয়।

এই বিজ্ঞানীরা জানান, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী কাকিলা মাছে ১৭ দশমিক এক শতাংশ প্রোটিন, লিপিড দুই দশমিক ২৩ শতাংশ, ফসফরাস দুই দশমিক ১৪ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ ক্যালসিয়াম রয়েছে, যা অন্যান্য ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি।

ডেইলি স্টারে পাঠানো বিএফআরআইয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদকে উদ্ধৃত করা বলা হয়েছে, দেশের বিলুপ্তপ্রায় ৬৪টি মাছের মধ্যে ৩০টি মাছের কৃত্রিম প্রজননে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সফলতা লাভ করেছে। সফলতার ধারাবাহিকতায় ৩১তম মাছ হিসেবে কাকিলা মাছ যুক্ত হলো।

বিএফআরআই বলছে, দেশীয় মাছকে সংরক্ষণের জন্যে ময়মনসিংহে ইনস্টিটিউটের সদর দপ্তরে লাইভ জিন ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্যে ২০২০ সালে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট একুশে পদক অর্জন করেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

10h ago