উৎসবের রঙে রাঙা বৈশাখ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ছবি: প্রবীর দাশ

নতুন বছরের প্রথম সূর্য যখন পূবের আকাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে, তখন থেকেই রমনা উদ্যানে প্রাণের উচ্ছ্বাস। অশ্বত্থমূলকে ঘিরে হাজারো মানুষ স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নতুন বছরের প্রথম সকালকে।

রমনা বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণের আবাহন ধ্বনি। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা, ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠীর আয়োজন, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলা-সবকিছুতেই ছিল প্রাণের ছোঁয়া।

মহামারির কারণে জীবন থেকে দুই বছরের সব উৎসব হারিয়ে যাওয়ার পর আজ বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে প্রাণের উচ্ছ্বাসে বাঙালি বরণ করে নিয়েছে আপন আদলে।

রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করে এবং নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে রাজধানীতে উদযাপিত হচ্ছে পহেলা বৈশাখের আয়োজন।

ভোরের মিষ্টি রোদে শিল্পী শ্রাবন্তী ধরের কণ্ঠে রাগালাপের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজন৷ তিনি পরিবেশন করেন রাগ রামকেলী। তন্ময় হয়ে শোনেন শ্রোতারা। কণ্ঠে সুর আর যন্ত্রের মূর্ছনা শেষে যখন চোখ মেলেন, তখন আশপাশের ভিড় যেন বেড়েছে আরও কয়েকগুণ। বরাবরের মতোই মূল মঞ্চে বসেছেন ছায়ানট বিদ্যায়তনের নানা বর্ষের শিল্পীরা। সংখ্যায় ৮৫ জন।

ছবি: প্রবীর দাশ

এর পর একে একে গীত হয় একক ও সম্মেলক গান। কবিগুরুর 'নব আনন্দে জাগো' গানকে প্রতিপাদ্য করে এবারের সব পরিবেশনা সাজানো হয়।

অনুষ্ঠানে সত্যম কুমার দেবনাথ 'এ কী সুগন্ধ হিল্লোল বহিল, লাইসা আহমেদ লিসা 'গাও বীণা, বীণা গাও রে, অভয়া দত্ত 'বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি, তাহমিদ ওয়াসিফ ঋভু 'কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে, তানিয়া মান্নান 'ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে' এবং এ টি এম জাহাঙ্গীর 'প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে' শিরোনামের রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান।

খায়রুল আনাম শাকিল 'আনো আনো অমৃত বারি, মাকসুদুর রহমান খান মোহিত 'জাগো অরুণ-ভৈরব জাগো হে, শাহীন সামাদ 'অন্তরে তুমি আছ চিরদিন এবং কানিজ হুসনা আহম্মদী 'আজ সকালে সূর্য ওঠা সফল হল মম' শিরোনামে নজরুলসংগীত গেয়ে শোনান।

রজনীকান্ত সেনের 'এত আলো বিশ্বমাঝে' পরিবেশন করেন সুতপা সাহা। অতুলপ্রসাদ সেনের 'আপন কাজে অচল হলে' সেমন্তী মঞ্জুরী ও শারমিন সাথী ইসলাম 'যদি তোর হৃদয়মুনা' গেয়ে শোনান।

সুমন মজুমদার গাইলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'আজি গাও মহাগীত'ও লালন সাঁইয়ের 'মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার' গাইলেন বিমান চন্দ্র বিশ্বাস।

একঝাঁক শিল্পীর সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া হয় নজরুলসংগীত 'প্রভাত বীণা তব বাজে হে', 'ঝড় এসেছে ঝড় এসেছে কাহারা যেন ডাকে' ও 'নবীন আশা জাগল যে রে আজ', রবীন্দ্রসংগীত 'নূতন প্রাণ দাও, প্রাণসখা', 'বিপদে মোরে রক্ষা করো' ও 'পারবি না কি যোগ দিতে', গুরু সদয় দত্তের 'বাংলাভূমির প্রেমে আমার' এবং গিরীন চক্রবর্তীর 'নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে' গানগুলো।

ছবি: প্রবীর দাশ

ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রভাতী আয়োজনে সমাপনী বক্তব্যে ছায়ানটের সহ-সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, 'ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির প্রাণের উৎসব, নতুন বর্ষবরণ। এই প্রভাতে, সবাই নবজীবনের অঙ্গীকারে নতুন করে আবদ্ধ হোক। বৈশাখ এসেছে, সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে।' 

তিনি বলেন, 'হৃদয়ে বাঙালি জাতি সত্তাকে ধারণ করে মানবিক সমাজ গঠনে আমাদের প্রাণিত করে বাংলা নববর্ষ। এই প্রত্যয় অর্জনে অর্ধশতাধিক বছর ধরে সুর ও বাণীর আবহে রমনার বটমূলে আয়োজিত হচ্ছে বাঙালির মিলনমেলা। মহামারির কারণে গত দুটিবছর আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয় এবং স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে আমরা গৃহবন্দী ছিলাম। দুঃসময় পেরিয়ে এবার নব আনন্দে জাগ্রত হওয়ার আয়োজন।' 

ছায়ানটের এই সহ-সভাপতি বলেন, 'সব লোভ-বিদ্বেষ-অসহিষ্ণুতা কাটিয়ে সকলের জীবনে নতুন বছর মঙ্গল বার্তা বয়ে আনুক, দেশের উন্নয়নে গতি সঞ্চার করুক।' 

সবশেষে শিল্পী-দর্শক-শ্রোতা সবাই একইকণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ আয়োজন। 

ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজনের ইতি টানতেই শুরু হয় চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। সবকিছু 'নির্মল' করার প্রত্যয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ২ বছর পর আবারো বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা৷ 

বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন সকাল ৯টায় এ শোভাযাত্রা শুরু হয়। 

এবারই প্রথম ঢাবির চারুকলা অনুষদের বদলে টিএসসি থেকে শোভাযাত্রা বের করা হলো৷ যা ঢাবির উপাচার্যের বাসভবন এলাকা ঘুরে আবারো টিএসসিতে এসে শেষ হয়৷ চলমান মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য এই পরিবর্তন আনা হয়৷ 

ছবি: প্রবীর দাশ

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য হলো 'নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে'৷ 

শোভাযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান, চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। 

এবারের শোভাযাত্রায় দেখা মিলছে ৪টি শিল্প কাঠামোর। এই ৪টি অনুষঙ্গ হচ্ছে টেপা পুতুল, মাছ, পাখি ও ঘোড়া। 

এবারের শোভাযাত্রা প্রসঙ্গে চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনার কারণে আমাদের জীবনের ছন্দ হারিয়ে গিয়েছিল। পুনরায় স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসা ধরে রাখার প্রত্যাশায় এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য হয়েছে 'নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে'।

বাংলা একাডেমিতে নববর্ষ উপলক্ষে বর্ষবরণ-সংগীত, নববর্ষ বক্তৃতা, কবিতাপাঠ এবং আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানে 'বাংলা ঋতু ও মাসের নাম-বিচার: লোকশ্রুতি ও আভিধানিক সূত্র' শীর্ষক 'নববর্ষ বক্তৃতা ১৪২৯' প্রদান করেন লোকসাহিত্য গবেষক ও নাট্যকার ড. সাইমন জাকারিয়া। 

কবিতা পাঠ করেন কবি আসাদ মান্নান, আবৃত্তি পরিবেশন করেন বাচিকশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। 

এর পর নববর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর যৌথ উদ্যোগে একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে বৈশাখী মেলা। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন মেলা উদ্বোধন করেন। 

বাংলা একাডেমির ফোকলোর উপবিভাগের উদ্যোগে একাডেমি প্রাঙ্গণের ভাষাশহিদ মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় লোককবিতা ও লোকসংগীত পরিবেশনা। 

অনুষ্ঠানে ভাটকবিতা পরিবেশনা করেন বাউল রশিদ (ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ), বাউল গান পরিবেশন করেন আবদুর রহমান (দিরাই, সুনামগঞ্জ), আলেয়া, আবুল বাসার তালুকদার (কেন্দুয়া, নেত্রকোনা)। কবিগান পরিবেশন করেন কবিয়াল নির্মল সরকার (সাইটারা, চিলমারী, কুড়িগ্রাম) ও কবিয়াল যশোদা রানী।

Comments

The Daily Star  | English

PSC announces major changes to ease BCS recruitment process

The PSC chairman says they want to complete the entire process — from prelims to recruitment — in 12 months

3h ago