আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাস

ঈদেও তাদের সঙ্গী একাকীত্ব

বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। ছবি: আনিসুর রহমান

নাদিরা বেগমের বয়স ৭০ এর কোটা ছুঁয়েছে। শরীরের ত্বকে স্পর্শ করেছে বয়সের ছাপ। মুখ থেকে হারিয়ে গেছে হাসি। যৌবনে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে রেখে আসতে হয়েছিলো সন্তানদেরকেও। পরে আরেকবার বিয়ে করলে সে স্বামীও হারিয়ে গেছে দিনান্তের পাড়ে। সব মিলিয়ে নাদিরা বেগমের জীবনের অর্থ এখন একাকীত্ব। সেখানে ঈদের দিন ফিরে আসে আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই।

নাদিরা বেগমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে। তার মতো সেখানে বাস করেন আরও ২৯ জন প্রবীণ। যে বয়সে সন্তানদের পাশে থেকে নাতি-নাতনির সঙ্গে খেলার কথা, সেখানে তারা এখন শুধুই একাকীত্বকে সঙ্গী করে বাঁচছেন।

আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবনের পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া সড়কে বেশ খানিকটা হাঁটতেই দেখা মিলে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের। স্বায়ত্বশাষিত এ প্রতিষ্ঠানের অংশ হিসেবে পরিচালিত হয় প্রবীণ নিবাস ও হাসপাতাল।

ছবি: আনিসুর রহমান

প্রবীণ নিবাসের বারান্দায় বসে নিজের জীবনের গল্প শোনাচ্ছিলেন নাদিরা বেগম। জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন তিনি। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালকে।

কেন আপনি এখানে- এ প্রশ্ন ছুঁড়েতেই কাঠিন্য এসে ভর করলো নাদিরা বেগমের চেহারায়। তিনি বলেন, 'এই যে তোমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, সেখানে মেয়েদের যাওয়ার জায়গাটা কোথায়? স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর সন্তানদেরকেও নিজের কাছে রাখতে পারিনি। বাবা ঘরে ফিরে নিয়ে যাওয়ার পর সম্পত্তি দিয়েছিল, সেটিও ভাই দখল করে নিয়েছে। আর আমি এই প্রবীণ নিবাসে বসে আছি।'

ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমার স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর আশা করছিলাম, ছেলেমেয়েরা মানুষ হবে। কিন্তু সৎ মায়ের কাছে থেকে কোন ছেলেমেয়েই মানুষ হতে পারেনা। আমার সন্তানরাও পারে নাই। মেয়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে, ছেলে অসুস্থ। কখনও তারা আসে দেখা করতে। আবার অনেক দিন হয়ে যায় কোনো খোঁজ নেয়না। এসব নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। শুধু আক্ষেপ একটাই- ছেলেমেয়েরা মানুষ হলো না।'

ঈদের দিন কেমন কাটে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে ঈদ কোনো আলাদা দিন না। এখান থেকে ভালো খাবার খাওয়ায়, সেমাই খাওয়ায়- এতটুকুই তো আমাদের ঈদ!'

নাদিরা বেগমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিলো পাশে বসে দূর থেকে দেখছিলেন শেখ মুজিবুল হক। এ প্রবীণ নিবাসের সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা তিনি। বয়সের ভারে অনেককিছুই এখন তিনি ভুলে গেছেন। বললেন, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এখানে বাস করেন। আগে শিক্ষকতা করতেন, ছবিও আঁকতেন। নিজের ইচ্ছায় সন্তানদের কাছ থেকে এখানে চলে আসেন তিনি।

নিজের ছেলের বিষয়ে তিনি বলেন, 'খুব ভালো ছেলে আমার। কোলের মধ্যে পা নিয়ে পায়ের নখ কেটে দেয়।'

ছবি: আনিসুর রহমান

তবে তার এসব কথা সবই মিথ্যে। তার একমাত্র ছেলে একটি মুঠোফোন সেবাসংস্থায় কর্মরত। ধানমণ্ডিতে মুজিবুল হকের টাকায় কেনা প্রায় কোটি টাকার ফ্ল্যাটে থাকেন। গেল ৬ মাস ধরে তার ছেলে প্রবীণ নিবাসের ভাড়ার টাকাও শোধ করেন না।

জানতে চাইলে নিশ্চুপ মুজিবুল হক নিবাসের বারান্দা দিয়ে গেটের বাইরে তাকিয়ে থাকেন। হয়তো তার দৃষ্টি খুঁজে ফিরছিল নিজের ছেলে, মেয়েকে দেখার জন্য।

এখানকার অনেক বাসিন্দাই নিজের সন্তানদের কথা বলতে নারাজ। তাদেরই একজন আবু তৈয়ব। সাবেক সরকারি এই কর্মকর্তার দিন কাটে এখন ইবাদত-বান্দেগী করে।

তিনি বলেন, 'ঈদের দিন খুব বেশি আলাদা না আমার জন্য। সকালে নামাজ পড়তে যাই, এসে সেমাই খাই। দুপুরে ভালো খাবার খাই, এই তো!'

ছবি: আনিসুর রহমান

সরকারি কর্মকর্তা হয়েও কেন তিনি প্রবীণ নিবাসে- এ প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'প্রত্যেকের সংসারেই কোনো না কোনো সমস্যা আছে। এখানকার সবার সংসারে কোনো না কোনো সমস্যা আছে। তবে আমি ভালোই আছি। ঝামেলামুক্ত আছি। অবসরে বই পড়ি, পত্রিকা পড়ি- খারাপ কী?'

এ প্রবীণ নিবাসের বিষয়ে এর ম্যানেজার মহসীন কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে বর্তমানে ৩০ জন বাসিন্দা আছে। আমরা আমাদের বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের নিজস্ব আয় দিয়ে তাদের সেবা করার চেষ্টা করি। বর্তমানে পুরান বাসিন্দাদের জন্য ৪ হাজার এবং নতুন বাসিন্দাদের মাসিক ভাড়া ৬ হাজার টাকা। আর খাবারের জন্য আলাদা করে আরও ৩ হাজার টাকা লাগে।'

ঈদের দিনের পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, 'এবার সকালে খিচুড়ি-মাংস, দুপুরে কাচ্চি বিরিয়ানি এবং রাতে সাদা ভাত, মাছ, মাংস পরিবেশন করা হবে। এর বাইরে আলাদা করে আর কোন আয়োজন নেই।'

সবার সঙ্গে কথা বলে যখন বের হওয়ার সময় এলো, তখন দেখা হলো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। দুই হাতে তার বাজারের ব্যাগ। কথা বলতে চাইলে, সরাসরি 'না' বলে দিলেন।

প্রবেশমুখের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক রক্ষী বললেন, 'এই লোক প্রতিদিন তার মাকে বাজার করে দিয়ে যান। কিন্তু ঘরে রাখে না। এ সেবার মানে কী? এ গল্প এখানকার সবার। মাঝেমাঝে ছেলেমেয়েরা হৈ-হুল্লোড় করে আসেন, এরপর আবার মাসের পর মাস আর কোনো খবর নেই। অনেকের তো কেউই আসে না। একা একাই তাদের জীবন কেটে যাচ্ছে।'

 

 

Comments

The Daily Star  | English

Electoral reform proposals: Parties want caretaker govt, 2-term limit for PM

Bangladesh Jamaat-e-Islami, Communist Party of Bangladesh (CPB) and Gono Odhikar Parishad (GOP) proposed a proportional representation electoral system and the restoration of the caretaker government to oversee the national polls.

14h ago