প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণ: ন্যায়বিচারের অপেক্ষা যেন ফুরায় না
'আমার ১৩ বছরের প্রতিবন্ধী মেয়েকে যে ধর্ষণ করেছে, তাকে যখন বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখি এবং বলতে শুনি "এমন একজনকে ধর্ষণ করলে দোষের কী আছে? সে তো এমনিতেই বাতিল"— তখন আর সহ্য হয় না।'
ক্ষোভ ও হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বগুড়ার নির্মাণ শ্রমিক মুজতবা আলী (ছদ্মনাম)।
তিনি বলেন, 'আগে ন্যায়বিচারের আশা করতাম। কিন্তু এখন সব আশা হারিয়ে গেছে।'
২০১৬ সালের নভেম্বরে মুজতবা আলীর প্রতিবন্ধী মেয়ে সামিয়াকে (ছদ্মনাম) ধর্ষণ করে এক প্রতিবেশী। ওই দিনই পরিবার তার বিরুদ্ধে মামলা করে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের মামলার বিচার কার্যক্রম নিম্ন আদালত মামলা গ্রহণের ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছরেও এ মামলার তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি। আসামিও মাত্র ৩ মাস কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে এসেছে।
ছোটবেলা থেকেই সামিয়ার ডান হাত ও পায়ে দুর্বলতা ছিল। গত ৪ মাস আগে একটি দুর্ঘটনার পর সে এখন পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তার বাবার শারীরিক অবস্থারও এমন অবনতি হয়েছে যে, তিনি নিয়মিত কাজই করতে পারছেন না। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের সামর্থ্য তার আর নেই।
তিনি বলেন, 'আসামি ১ লাখ টাকার বিনিময়ে মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে। আমার এখন আর কোনো উপায় নেই।'
বগুড়া নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট নরেশ মুখার্জির মতে, মামলাটি মন্থর গতিতে চলেছে। এটি শেষ হতে কত সময় লাগবে তা অনিশ্চিত। তবে মামলাটি সেশন ট্রায়ালে দেওয়া যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আদালত চাইলে ৭ দিনের মধ্যে শুনানি সম্পন্ন করতে পারবেন।
খুলনার প্রতিবন্ধী শিশু ১৪ বছর বয়সী লামিয়ার (ছদ্মনাম) অভিজ্ঞতা আরও বেশি হতাশাজনক।
লামিয়া 'দাদা' বলে ডাকতো, এমন এক প্রতিবেশী ২০১৬ সালে তাকে ধর্ষণ করে। এতে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে সে।
লামিয়ার মা বলেন, 'মেয়ের জন্য বিচার চাইতে যাওয়াটাই আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে যায়। অভিযুক্তের বয়স ছিল প্রায় ৭০ বছর। ২০১৯ সালে তিনি মারা যান। কিন্তু তার পরিবার আমার স্বামী ও ১৩ বছরের ছেলের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে। আমার স্বামী ৩ মাস জেলে ছিলেন। এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলে এখনও পলাতক।'
লামিয়ার পরিবার তার ভাইকে পরীক্ষা দেওয়াতে আগাম জামিনের খরচ বহন করতে পারছে না। কারণ লামিয়ার মামলার পেছনেই প্রায় সব টাকা খরচ করে ফেলেছে তারা।
ন্যাশনাল গার্ল চাইল্ড অ্যাডভোকেসি ফোরাম বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে মোট ৭৯ জন প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন তাদের জন্য। যদিও, অন্য মেয়ে শিশু ও নারীদের তুলনায় তাদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা অনেক বেশি ঘটে বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
প্রতিবন্ধী নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার কেমন, সে ব্যাপারে কোনো ডেটা নেই। তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এসব ক্ষেত্রে সাজা হওয়ার ঘটনা বিরল। অনেক ক্ষেত্রে এমন ঘটনা সামনেই আসে না।
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে যেসব বাধা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যার উপর নিপীড়ন চলেছে, দেশের আইন ব্যবস্থায় প্রমাণের ভার সম্পূর্ণভাবে তার উপরেই পড়ে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের পক্ষে ঘটনা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতারও তীব্র অভাব লক্ষ্য করা যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ব্লাস্টের সাবেক রিসার্চ ফেলো রেজাউল করিম সিদ্দিকী বলেন, 'বাক ও শ্রবণের সমস্যা আছে, এমন একজন আদালতে সরাসরি সাক্ষ্য দিতে পারেন না। কারণ, বাংলাদেশে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ জানা কোনো আইনজীবী বা বিচারক নেই। ফলে আদালতের দোভাষীর প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেশে এমন দোভাষী আছেন মাত্র ১০ জন। তাদের অধিকাংশই আবার ঢাকা ভিত্তিক।'
এ ছাড়া, কোনো দোভাষী মামলাটির সঙ্গে যুক্ত হলে তিনি সেই মামলার সাক্ষীও হন। শুনানির জন্য যখন প্রয়োজন হয়, তখনই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হয় তাকে। অনেকেই এটাকে ঝামেলা মনে করেন।
বিটিভির সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ সংবাদ উপস্থাপক আরিফুল ইসলাম ২০টিরও বেশি ধর্ষণ মামলায় দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন।
তিনি বলেন, 'ঢাকার বাইরের অনেক বিচারকই দোভাষীদের সম্পর্কে অবগত নন। ফলে তারা সাধারণত সমাজসেবা অধিদপ্তরের ডিজ্যাবিলিটি ফোকাল পারসন বা স্থানীয় বধির স্কুলের শিক্ষকদের সাহায্য করতে বলেন। নিপীড়ন থেকে বেঁচে ফেরা প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুদের সঙ্গে সঠিকভাবে যোগাযোগের দক্ষতা বা সংবেদনশীলতার অভাব থাকতে পারে তাদের।'
'এ ছাড়া, আদালতের আদেশে দোভাষীদের পরিবহন ভাতা দেওয়ার কথা বলা হলেও, বাস্তবে তারা তা পান না। ফলে অনেকে ঢাকার বাইরের কোনো মামলায় সহায়তা করার আগ্রহ পান না। তবে সরকার যদি দোভাষীদের ডেটাবেজ তৈরি করে তাদের নির্দিষ্ট এলাকায় নিযুক্ত করে এবং নূন্যতম একটা পরিবহন ভাতা দেয়, তবে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে', মত দেন তিনি।
আবার দোভাষী পাওয়া গেলেও কিছু সমস্যা রয়ে যায়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিশেষ করে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যায় ভুগছেন, তাদের সাক্ষ্য প্রায়ই বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না।
রেজাউল করিম সিদ্দিকী বলেন, 'মনোসামাজিক সমস্যায় যারা ভুগছেন, তাদের বিষয়টি আরও জটিল। এ ক্ষেত্রে পুলিশ মামলাই নিতে রাজি হয় না। কারণ তারা ঘটনা প্রমাণ করতে পারেন না। তাদের মধ্যে যাদের মাল্টি সেনসরি দুর্বলতা রয়েছে, তারা সাক্ষ্য দিতেও সক্ষম নন।'
উইমেন উইথ ডিজ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (ডব্লিউডিডিএফ) নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি জানান, ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে শিশু বা নারীরা কীভাবে প্রতিকার পাবেন, 'প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩' তে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই।
তিনি বলেন, 'তাদেরকেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধিত) আইন ২০২০ এর আওতায় মামলা করতে হয়। কিন্তু, এ বিশেষ ক্ষেত্রে কীভাবে বিচার করা যায় এবং প্রতিকার দেওয়া যায় সে বিষয়ে একটি পৃথক অধ্যায় থাকলে ভালো হতো। এখন আমরা সম্পূর্ণভাবে বিচারক ও আইনজীবীদের বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। তারা সংবেদনশীল না হলে কোনো আশাই থাকে না।'
আশরাফুন নাহার আরও বলেন, 'আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে এখানে। যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিচার চাইতে আসেন, তাদের বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবারের। এনজিওর সাহায্য ছাড়া দীর্ঘ আইনি লড়াই চালানোর সামর্থ্য থাকে না তাদের। সরকার পাবলিক প্রসিকিউটর নিযুক্ত করলেও, তারা এসব মামলায় যথেষ্ট মনোযোগ দেন না। কারণ এসব মামলা থেকে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হন না।'
অ্যাডভোকেট সিদ্দিকীর মতে, এ ক্ষেত্রে প্রমাণের বিষয়টি অপরাধীর ওপর থাকলে ন্যায়বিচার পাওয়া সহজ হবে।
এ ছাড়া, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ধর্ষণ ও তাদের অধিকার সম্পর্কিত আইনগুলো ব্রেইল বা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে জানাতে হবে, যাতে তারা অপরাধ ও নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
যোগাযোগ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন এবং সমাধানের চেষ্টা করবেন।
অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম
Comments