নোয়াখালীতে কিশোর গ্যাং, ২ মাসে ২ খুন
নোয়াখালীতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে কিশোর গ্যাং। হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, ছিনতাই, নারীদের উত্যক্ত করাসহ নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে কিশোররা।
গত ১৩ এপ্রিল থেকে আজ ১৩ জুনের মধ্যে ২ জনকে হত্যা, রাস্তায় স্কুল শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করাসহ একাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
এসব ঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে।
এই কিশোরদের কর্মকাণ্ডে স্থানীয়দের আতঙ্ক বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে পুলিশ প্রশাসনের দুশ্চিন্তা।
দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, নোয়াখালীর ৯ উপজেলা ও ৮ পৌরসভায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য রয়েছে। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট ও রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন অপরাধ করছে।
অনেক জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির পর বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে এবং উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে উত্যক্ত করছে।
এসব কিশোরের বয়স ১৪ থেকে ১৯ বছর।
গত ৫ জুন বিকেলে নোয়াখালী পৌর পার্কে বেড়াতে আসা ৩ কিশোরের মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনতাই করা হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে ডিবি পুলিশ ৩ কিশোরকে গ্রেপ্তার করে।
গত ৪ জুন সন্ধ্যায় শহরের জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে এক পথচারীকে মারধর করে নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠে। সেসময় কিশোর আতাউর রশিদকে (১৮) হাতেনাতে আটক করে ডিবি পুলিশ। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে আরও ৩ কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই দিন দুপুরে চাটখিল পৌর এলাকায় এক রেস্তোরাঁয় বেড়াতে আসা কলেজ শিক্ষার্থী ও তার বান্ধবীর কাছে ৫ হাজার টাকা দাবি করে ২ কিশোর—শিপন ও স্বপন। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাদেরকে তুলে নিয়ে একটি মার্কেটে আটকে রাখা হয়। খবর পেয়ে চাটখিল পুলিশ তাদেরকে উদ্ধার করে এবং ২ কিশোরকে গ্রেপ্তার করে।
গত ১০ মে দুপুরে জেলার সেনবাগ উপজেলার নবিপুর ইউনিয়নে বাড়ির পুকুরঘাটে গোসলের সময় ২ কিশোরীকে উত্যক্ত করে কিশোর মো. রবি (১৯)। কিশোরীরা প্রতিবাদ করলে রবি তাদের লাঞ্ছিত করে এবং এক কিশোরীর জামা ছিঁড়ে ফেলে।
কিশোরীর পরিবার বিষয়টি স্থানীয় চেয়ারম্যানকে জানালে তিনি সেদিন রাত ৮টার দিকে মীমাংসা করতে আসেন। সে সময় রবির সহযোগীরা চেয়ারম্যানকে মারধর করে এবং তার গাড়ি ভাঙচুর করে। ওই ঘটনায় ৪ কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ফেসবুকে মন্তব্য করাকে কেন্দ্র করে ১৬ মে রাত সাড়ে ১০টার দিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পেশকারহাট এলাকায় ২ দল কিশোর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ওই ঘটনায় ৪ জন আহত হয়। সেসময় তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করে।
২১ মে সন্ধ্যায় বেগমগঞ্জের চৌমুহনী বাজারে ব্যবসায়ী মো. আয়মান হোসেনকে ছুরিকাঘাত করে এক কিশোর। পুলিশ তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে ৩ কিশোরকে গ্রেপ্তার করে।
২৪ এপ্রিল সকালে সুবর্ণচর উপজেলার চরভাটা ইউনিয়নে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় কিশোর মিরাজ ও সহযোগীরা তাকে উত্যক্ত-লাঞ্ছিত করে। ওই শিক্ষার্থীর চিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে এসে ৪ কিশোরকে আটক করে চর জব্বার থানা-পুলিশে সোপর্দ করে।
সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৈতি সর্ববিদ্যা ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে আটক কিশোরদের ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
গত ১৩ এপ্রিল বিকেলে বেগমগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামের মালেকার বাপের দোকান এলাকায় প্রবাসী মাওলানা আবু জাহেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে কিশোর রিমন ও তার সহযোগীরা। সেসময় আবু জাহেরের কোলে তার ৫ বছর বয়সী একমাত্র সন্তান তাসফিয়া আক্তার (৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
ওই ঘটনায় ১৭ জনের নামে ও অজ্ঞাত ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় মামলা হয়। ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। তাদের মধ্যে ৪ জন দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেয়।
নোয়াখালী নারী অধিকার জোটের সভাপতি লায়লা পারভীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ২ মাসের প্রতিটি ঘটনা বলে দেয় নারীর প্রতি সহিংসতা-নির্যাতন ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা কারো না কারো আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে নির্ভয়ে বিচরণ করে। কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তারা অল্প সময়ের মধ্যে বেরিয়ে আসে। বের হওয়ার পর ভুক্তভোগীদের মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়।'
বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধ প্রবণতাকে উস্কে দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, 'পাশাপাশি, এসব অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্তদের প্রতিহত ও প্রতিরোধে রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিদের নিষ্ক্রিয়তাই জঘন্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।'
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রাহা নবকুমার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিশোর গ্যাং নামে কিছু পথভ্রষ্ট যুবক-কিশোর বিভিন্ন স্থানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী নির্যাতন এমনকি মানুষ খুন করতেও তারা পিছপা হচ্ছে না। এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন দরকার।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি—অসৎ, ক্ষমতা লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থে এই কিশোরদের ব্যবহার করছে।'
নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিশোর গ্যাং সমাজের বড় সমস্যা। অবক্ষয়ের কারণেই এর সৃষ্টি। নানা কারণে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এই সুযোগে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল তাদের দিয়ে অপরাধ করাচ্ছে।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কেউ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে কি না তা জানতে পুলিশ কাজ করছে। কিশোরদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর সূত্র ধরে তাদের ইন্ধনদাতাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে।'
Comments