নাহিদ হত্যায় অভিযুক্তরা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ কর্মী, এখনো গ্রেপ্তার হয়নি কেউ

গত মঙ্গলবার ব্যবসায়ী-শিক্ষার্থী সংঘর্ষের সময় হামলাকারী ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতারা। (বাম দিক থেকে) কাইয়ুম নাহিদকে প্রথম আঘাত করেন, হাত উঁচিয়ে হাতুড়ি হাতে মোনায়েম, কাওসার ওরফে সাদা কাওসার ও সাদিক মির্জাকে রামদা হাতে দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের পরিচয় শনাক্ত করেছে। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গত মঙ্গলবার শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী সংঘর্ষে নিহত নাহিদ মিয়াকে যারা পিটিয়েছেন ও কুপিয়েছেন তাদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা সবাই পুলিশের নজরদারিতে আছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ একাধিক সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, যারা দেশীয় অস্ত্র বহন করেছেন তাদের অনেককেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

এলিফ্যান্ট রোডের একটি কম্পিউটার এক্সেসরিজের দোকানের ডেলিভারিম্যান নাহিদ সংঘর্ষে আহত হয়ে সে রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

নাহিদকে যিনি পশু জবাইয়ের ছুরি দিয়ে কুপিয়েছেন, তিনি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী জাকির বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চিহ্নিত করেছে।ছবি: স্টার

প্রত্যক্ষদর্শী ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের তিনটি গ্রুপের নেতৃত্বে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই গ্রুপগুলোর নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগ নেতা জুলফিকার, ফিরোজ ও জসিম।

ওই দিন জসিম ও তার সহযোগীরা সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ছিলেন বলে জানা গেছে। তারা ছুরি, লোহার রড ও লাঠি হাতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভে অংশ নেন।

এই গ্রুপটিই নাহিদের ওপর হামলা চালায় বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তারা জানান, সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্র বহনকারী অনেককে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

তারা আরও বলেন, ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের বেশিরভাগ সদস্য তাদের পরিচয় গোপন করতে এবং সংঘর্ষের সময় আঘাত থেকে বাঁচতে তাদের মোটরসাইকেলের হেলমেট ব্যবহার করেন। নাহিদকে যিনি কুপিয়েছেন, তিনিও হেলমেট পরেছিলেন।

ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বর্তমানে কোনো কমিটি নেই। তাই সেখানকার ছাত্রলীগ কয়েকটিভাগে বিভক্ত। ২০১৬ সালে ৩ মাসের জন্য একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে ব্যর্থ হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্য জানিয়েছে, তারা চায় না এখন আর কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হোক।  তাই আসামিদের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া ধীর গতিতে চলবে।

এর আগে গত সোমবার রাতে নিউমার্কেটে দুই দোকানের কর্মচারীদের মধ্যে ঝগড়া হয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাতে ও পরের দিন ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দিনব্যাপী সংঘর্ষ হয়। এতে দুজন নিহত এবং সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।

ঢাকা কলেজের ঠিক বিপরীতে নূরজাহান সুপার মার্কেটের খান ফ্যাশন স্টোরের সামনে ফুটপাতে ২ গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন নাহিদ। সেখানেই তার ওপর হামলা করা হয়।

হামলার একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রীরাও ওই ঘটনার ছবি তুলেছেন।

ছবিতে ও ভিডিওতে কালো হেলমেট ও ধূসর টি-শার্ট পরা এক যুবককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে নাহিদকে আঘাত করতে দেখা গেছে। লাল টি-শার্ট ও হেলমেট পরা আরেকজন যুবক তাকে বাধা দিতে আসেন। এরপর তারা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশে ফিরে যান।

হত্যা মামলার তদন্তকারী গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নাহিদকে কোপানো যুবকের নাম জাকির। জাকির ছাত্রলীগের কর্মী বলে জানান তারা।

নাহিদকে প্রথম আঘাত করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী কাইয়ুম। তার পরনে সাদা ডোরাকাটা নীল টি-শার্ট ছিল বলে জানান তারা।

তবে তারা জানিয়েছেন, হামলাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হতে তারা সব তথ্য যাচাই করছেন।

হলুদ হেলমেট পরা সুজন ইসলাম ঢাকা কলেজের নর্থ হোস্টেলের ১০১ নম্বর কক্ষে থাকেন বলে জানান তারা।

ছবির হলুদ হেলমেট ও লাল জামা পরা এই যুবক ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী সুজন ইসলাম বলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী চিহ্নিত করেছে। ছবি: সংগৃহীত

সংঘর্ষের সময় যাদের কাছে দেশীয় অস্ত্র, রড ও লাঠিসোঁটা ছিল তাদের অনেককেও শনাক্ত করা হয়েছে।

তাদের একজন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাদিক মির্জা। একই হোস্টেলের ২১৮ নম্বর কক্ষে থাকেন তিনি। তার হাতে একটি চাপাতি ছিল।

সবুজ টি-শার্ট পরা কাওসার ওরফে সাদা কাওসারের হাতেও একটি চাপাতি ছিল। ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষার্থী কাওসার সাউথ হোস্টেলে থাকেন।

হাতুড়ি হাতে মোনায়েমকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি ঢাকা মহানগর (উত্তর) ছাত্রলীগের সদস্য বলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ডিবির ডেপুটি কমিশনার (রমনা বিভাগ) এইচ এম আজিমুল হক গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গণমাধ্যমের সহায়তায় বিভিন্ন ছবি ও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তারা কয়েকজনের নাম পেয়েছেন।

তিনি বলেন, 'আমরা বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া প্রতিটি সূত্র পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে দেখেছি, যেন নিরপরাধ কেউ বিপদে না পড়েন।'

ছাত্রলীগের নেতৃত্বে নাহিদের ওপর হামলা করা হয়েছে, এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফুয়াদ হাসান বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত তা এখনো পরিষ্কার নয়।'

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা ঢাকা কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ''বিক্ষোভ" ছিল।'

ছাত্রলীগের কোনো সদস্য এতে অংশ নেননি দাবি করে তিনি বলেন, 'আমরা নিশ্চিত যে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত ছিল না।'

গত সপ্তাহের এ সংঘর্ষের ঘটনায় ৪টি মামলা হয়েছে। দুটি মামলা পুলিশ করেছে। আর দুটি মামলা করেছেন সংঘর্ষে নিহত দুই জনের পরিবারের সদস্যরা।

এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা দেড় হাজার জনের বেশি আসামি করা হয়েছে। হত্যা মামলা দুটি ডিবি তদন্ত করছে। অপর দুটি মামলা নিউমার্কেট থানার পুলিশ তদন্ত করছে।

এদিকে সংঘর্ষে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় বিএনপি নেতা মকবুল হোসেনের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার রাতে যে দোকান দুটি থেকে ঘটনার সূত্রপাত হয়, তিনি সে দোকান দুটির মালিক।

মকবুলের মুক্তি ও 'মিথ্য' মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আগামী মঙ্গলবার রাজধানীসহ সব মহানগরে সমাবেশ করবে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কর্মসূচির ঘোষণা করেন।

ফখরুল বলেন, 'সহিংসতায় ছাত্রলীগের "ক্যাডাররা" জড়িত ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে।'

(এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রুবেল)

Comments

The Daily Star  | English

Grim discovery: Five bodies found on vessel in Meghna, 2 more die later

The incident had occurred on the Meghna river under Chandpur Sadar upazila in an area adjacent to Shariatpur

3h ago