আত্মসমর্পণের পরও পুরোনো পেশায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাদক চোরাকারবারিরা

মাদক চোরাকারবারি রিপনের বাড়ি। ছবি: স্টার

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের বাসিন্দা ফজলুর রহমান প্রকাশ বজলু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। ২০১৭ সালে তিনি তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপারের কাছে মাদক ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার লিখিত অঙ্গীকার করেছিলেন। পাশের কালিসীমা গ্রামের আবু কালাম একই অঙ্গীকার করে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছিলেন। সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামের হাফিজুলও থানা পুলিশের কাছে মাদক ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন।

কিন্তু, গত কয়েক বছর ধরে 'অঙ্গীকারবদ্ধ' এই ৩ ব্যক্তি অবাধে মাদক চোরাকারবারি চালিয়ে যাচ্ছেন। ফজলুর রহমান প্রকাশের নতুন সহযোগী তার ছেলে আকতার হোসেন। অবৈধ ব্যবসা করে পিতা-পুত্র মিলে গড়ে তুলেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। কিনেছেন জমি, দোকান দিয়েছেন স্থানীয় বাজারে।

মালয়েশিয়া পাড়ি জমানো আবুল কালাম আড়াই বছর পর দেশে ফিরে আগের চেয়ে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করে নেমে পড়েন মাদকের কারবারে। নিজ ভিটায় গড়ে তুলেছেন দৃষ্টিনন্দন ভবন।

একই উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়পুর ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামের আব্দুল হক একসময় দিনমজুর ছিলেন। তার বাবা আবু জাহেরও দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। দিনমজুর আব্দুল হকের উত্থানের কাহিনী সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। মাত্র ১০ বছর মাদক চোরাকারবারি করে আমূল বদলে গেছেন তিনি। ফেনিসিডিল আর ইয়াবার কারবার করে দিনমজুর থেকে কোটিপতি হয়েছেন আব্দুল হক। গ্রামের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন নজরকাড়া ডুপ্লেক্স বাড়ি।

মাদক চোরা কারবারি আব্দুল হকের বাড়ি। ছবি: স্টার

চান্দুরা ইউনিয়নের কালিসীমা গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল ও সোহেলের বাবা মোখলেছ মিয়া ৬-৭ বছর আগেও রিকশা চালাতেন। এখন মাদকের কারবার করে তার ২ ছেলে কোটিপতি। কয়েক বছরের ব্যবধানে তারা আলিশান বাড়ি, ধানের চাতাল কল, খাবার হোটেল ও একাধিক সিএনজি অটোরিকশার মালিক বনে গেছেন।

আব্দুল হকসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কয়েকশ মাদক চোরাকারবারিরা ২০১৭ সালে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

কিন্তু, পুলিশের দুর্বল পর্যবেক্ষণ, সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও পুনর্বাসন কর্মসূচি না থাকায় ৩৮ বছর বয়সী আব্দুল হকসহ অন্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার শপথ নেওয়ার ১ বছরের মধ্যেই ফের এ অবৈধ কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন।

মাদকের ক্রেতা সেজে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক গত ১২ ডিসেম্বর আব্দুল হকের সঙ্গে দেখা করেন এবং ২ বোতল বিয়ার কিনতে চান। এ সময় আব্দুল হক তার কাছে ইয়াবা ও ফেনিসিডিল ছাড়া অন্য কিছু নেই বলে জানান। তবে, তিনি বিয়ারের ব্যবস্থা করতে পারবেন বলে জানান।

এক সময়ের দিনমজুর আব্দুল হক ২০১৩ সালে মাদক চোরাকারবারে জড়ান। পুলিশ বলছে, কয়েক বছরের মধ্যেই তার নামে থানায় ১৪টি মাদক মামলা হয়।

চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রাম থেকে আব্দুল হককে ৯৫ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করে এবং বিজয়নগর থানায় মামলা করে।

২০১৭ সালের জুলাই মাসে দেশে ইয়াবার ভয়াবহ বিস্তারের পর সরকার যখন মাদকের বিরুদ্ধে 'যুদ্ধ' ঘোষণা করে, তখন আব্দুল হক ৭ সহযোগীসহ জেলা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১ হাজার ১৫১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর একটি তালিকা তৈরি করে এবং ঘোষণা দেয়, যেসব মাদক চোরাকারবারি আত্মসমর্পণ করবে সরকার তাদের উন্নত জীবনযাপন নিশ্চিতের চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে তাদের পুনর্বাসন করা হবে। এছাড়া তাদের লঘু শাস্তির কথাও বলা হয়েছিল।

সে সময় কয়েক দফায় জেলার প্রায় ৩৩০ জন মাদক চোরাকারবারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

আব্দুল হকের মতো বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা দুই ভাই জুয়েল মিয়া (৩৫) ও সোহেল মিয়া (৩১) পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে অবৈধ এ কারবার ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক ক্রেতা সেজে জুয়েলের কাছ থেকে কিছু ফেনসিডিল কিনতে চান। জুয়েল বলেন, তিনি এগুলোর ব্যবস্থা করতে পারবেন। তবে প্রতিটি বোতলের দাম পড়বে ২ হাজার ৪০০ টাকা।

কিন্তু, এই প্রতিবেদক উপরোল্লিখিত ৩ মাদক কারবারির কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে তাদের মাদক ব্যবসায় ফিরে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে, তারা ফোন কেটে দেন এবং পরে ফোন নম্বর ব্লক করে দেন।

পুলিশ জানায়, গত ২ বছরে আব্দুল হক, জুয়েল ও তার ভাই সোহেলের বিরুদ্ধে বিজয়নগর থানায় একাধিক মাদক মামলা রুজু হয়েছে।

৫ মাদক মামলার আসামি বিজয়নগরের সিঙ্গারবিল এলাকার আরেক মাদক কারবারি আতিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাদক ব্যবসা ছেড়ে দেওয়া কঠিন কাজ।'

আতিক গত ৪ জানুয়ারি এই প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার শ্বশুর বাড়ি ও নানার বাড়ি বিজয়নগরে। এলাকাটি মাদকপ্রবণ। স্থানীয় কিছু মানুষের সঙ্গে সখ্যতার সূত্রে আমি এই কালো পেশায় জড়িত হই। তবে এখন আমি অবৈধ ব্যবসা ছেড়ে দিতে চাই এবং কুমিল্লায় আমার নিজের বাড়িতে গিয়ে বসবাস করার পরিকল্পনা করছি, যেন আমি এই পেশা থেকে দূরে থাকতে পারি।'

বিজয়নগর থানার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিজয়নগর থানায় প্রায় ৬৩টি মাদক মামলা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওই সময় ৬০৫ জনের বিরুদ্ধে ৩৩০টি মাদক মামলা রেকর্ড করা হয়।

সমাজকর্মী ও স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্তবর্তী জেলা-উপজেলায় মাদকের ব্যবসা বেড়েছে এবং আগে যারা মাদকের কারবার করবে না বলে আত্মসমর্পণ করেছিল, তারা ফিরে গিয়ে পুরোদমে এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইউনিটের সভাপতি ডা. মো. আবু সাঈদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে উদ্যোগটি কার্যকর হয়নি। কর্তৃপক্ষ আত্মসমর্পণকারীদের ভিন্ন কোনো পেশায় নিয়োজিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।'

জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২০১৭ সালে ৩৫ হাজার ২৬৯ পিস ইয়াবা জব্দ করে। ২০১৮ সালে ৫৯ হাজার ৬৭২ পিস ও ২০১৯ সালে ৬১ হাজার ৫৫৩ পিস জব্দ করে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ২ বছরে মাদক বিরোধী কার্যক্রম সীমিত আকারে চললেও ৭৮ হাজার ১৭৭ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলায় তালিকাভুক্ত ছোট-বড় প্রায় ৫২০ জন মাদক চোরাকারবারি আছেন।'

'বর্ডার বেল্টের লোকজন মাদক কারবারিদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য আমাদের দেয় না। তাই আমরা অভিযান পরিচালনা করতে অসুবিধায় পড়ছি। তবে আমরা নিয়মিত কাজ করছি এবং অভিযান চলছে,' বলেন তিনি।

তিনি জানান, বিজয়নগরে মাদক চোরাকারবারের মাধ্যমে মোটা টাকার মালিক হয়েছেন এমন প্রায় ডজন খানেকের তালিকা তাদের কাছে আছে।

মিজানুর বলেন, 'তাদের একবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মসমর্পণও করেছিল। কিন্তু, আবার পুরোনো কারবারে ফিরে গেছে।'

জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান গত ৬ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাদক চোরাকারবারিদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে এই আত্মসমর্পণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। আত্মসমর্পণের পর এখন যারা এই কালো পেশায় ফিরে এসেছে, আমরা তাদের তালিকা সংগ্রহ করব এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।'

উল্লেখ্য, ইয়াবাকে 'ক' শ্রেণির মাদক হিসেবে চিহ্নিত করে গত ২০১৮ সালে ইয়াবা চোরাকারবারিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে সংসদে একটি আইন পাস করা হয়।

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

6h ago