‘অ্যাপ্লায়েড ফর রেজিস্ট্রেশন’ স্টিকারে ৩১৯ কিমি চলেছে রোলস রয়েসটি

ঢাকার বারিধারা থেকে বিলাসবহুল রোলস-রয়েস ব্র্যান্ডের গাড়িটি জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম কাস্টমসে শুল্কায়ন সম্পন্ন না করে খালাস নেওয়া ২৭ কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল রোলস রয়েস ব্যান্ডের গাড়িটি ঢাকায় শুল্ক গোয়েন্দারা আটকের পর গাড়িটির মাইলেজ ছিল ৩১৯ কিলোমিটার।

ব্যান্ড নিউ গাড়িটি গত ১৭ মে রাতে চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে একটি লোবেটে করে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বারিধারা এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গাড়িতে কোনো নম্বর প্লেট বা স্টিকার না থাকলেও 'অ্যাপ্লায়েড ফর রেজিস্ট্রেশন' স্টিকার এবং ঢাকার রাস্তায় চলাচলের কিছু ছবি আমাদের হাতে রয়েছে। মামলার যা পরবর্তী তদন্তে প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হবে।

কর্মকর্তরা জানান, গাড়িটি ঢাকাতেই চলাচল করেছে। চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে গাড়িটি একটি লোবেটে করে ঢাকায় আনা হয়েছিল এবং আমদানির সময় গাড়িটি জিরো মাইলেজ ছিল। ৩ কোটি টাকার গাড়িটির ৮০০ শতাংশ হারে ২৪ কোটি টাকা শুল্ককরসহ মূল্য ২৭ কোটি টাকা।

যেভাবে আটক হয় গাড়িটি

চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত বাংলাদেশি ও চীনা নাগরীকদের যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান জেড অ্যান্ড জেড ইন্টিমেটস লিমিটেড গাড়িটির আমদানিকারক। গাড়িটি যুক্তরাজ্যের ভারটেক্স অটো লিমিটেড থেকে প্রায় ২ মাস আগে আমদানি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে খালাস না নেওয়া এবং গাড়িটি এনবিআরের এসআরও (স্ট্যাচুটরি রেগুলেটরি অর্ডার) অনুযায়ী শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় গত ৩০ জুন চালানটি আটক (এনেবিআরের সার্ভারে খালাস স্থগিত) করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

তবে সরেজমিনে ইপিজেডের কাস্টম স্টেশন এলাকায় এবং কারখানা চত্বতে গাড়ির সন্ধান না পাওয়ায় তদন্ত নামে শুল্ক কর্মকর্তারা। পরে গত সোমবার অভিযান চালিয়ে গাড়িটি ঢাকায় আটক করা হয়। যদিও গণমাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয় বুধবার সকালে। গাড়িটি অবৈধভাবে খালাসের কারণে সরকার ২৪ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতো বলে জানান শুল্ক কর্মকর্তারা।

ঢাকার বারিধারায় একটি বাড়ি থেকে রোলস-রয়েস ব্র্যান্ডের গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

আমদানি প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ হয় চট্টগ্রাম কাস্টমসের

গত ২৭ এপ্রিল আমদানিকারকের পক্ষে কাস্টমসে বিল অব এন্ট্রি (চালানের প্রাথমিক তথ্য) দাখিল করেন সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান এমআই ট্রেড অ্যাসোসিয়েটস। গাড়িটি শুল্কমুক্ত সুবিধায় খালাসে অনুমতি চাওয়া হলেও কাস্টমস আপত্তি জানায়। কারণ এনবিআরের ২০১০ সালের এসআরও অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠান ২০০৯ সালের ২২ মার্চের আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানই এ সুবিধা পাবে। কিন্তু জেডঅ্যান্ডজেড ইন্টিমেটস লিমিটেড ২০১৭ সালে বেপজা (বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ কর্তৃপক্ষ) অনুমতি ও ২০১৮ সালে বন্ড কমিশনারেটের অনুমতি পায়। যদিও প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ সালে স্থাপন হওয়া আদি টাওয়াল (বিডি) লিমিটেড থেকে কিনে নেন বর্তমান মালিকরা।

প্রতিষ্ঠানটির নাম ও মালিকানা ২০০৯ সালের পরে পরিবর্তন হলে এ সুবিধা পাবে কি না তা এসআরওতে স্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় তা আটকে দেয় কাস্টমস। এ বিষয়ে বেপজার আমদানির অনুমতিপত্র যাচাই ও এনবিআরের মতামত পেতে দেরি হওয়ায় গত ১৫ মে আমদানিকারকের জিম্মায় গাড়িটি হস্তান্তর করে কাস্টমস। কিন্তু শুল্কায়ন সম্পন্ন না হওয়ায় কনটেইনার খুলে তা ব্যবহার বা স্থানান্তরের সুযোগ ছিল না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এ শর্ত অমান্য করে তা ঢাকায় নিয়ে ব্যবহার করায় কাস্টমস অ্যাক্ট-১৯৬৯ অমান্য করা হয়েছে। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এসআরও জটিলতায় বাড়তে পারে শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার

বিদেশি বিনোয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং ক্রেতাদের কারখানা পরিদর্শনের সুবিধার জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় পিকআপ, জীপ, মাইক্রোবাস ও কার- এ ৪ শ্রেণির যানবাহনের মধ্যে যেকোন দুটি যানবাহন আমদানির অনুমতি দেয় এনবিআর। এ সুবিধার অপব্যবহার করে এসব গাড়ি ব্যক্তিগত ব্যবহার বা বিক্রির আশঙ্কা থাকায় কিছু শর্ত দেয় এনবিআর।

২০১০ সালে পাস হওয়াস এ অর্ডারের শর্তের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ২০০৯ মালের ২২ মার্চের আগে কারখানা স্থাপন হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানই এ সুবিধা পাবে। একই সঙ্গে ন্যূনতম ৫০০ বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত থাকতে হবে। বিলাশবহুল গাড়ি এনে যাতে বিক্রি বা হস্তান্ত করতে না পারে সে জন্য কার আমদানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিসি উল্লেখ করা হয় ২০০০ সিসি। কিন্তু জীপ বা অন্য গাড়ির ক্ষেত্রে সিসির সর্বোচ্চ সীমা উল্লেখ না করায় রোলস-রয়েজ, মার্সিটিজ, বিএমডাব্লিউ-এর মতো বিলাসবহুল জীপ আমদানি করছে কারখানা মালিকরা। ইতোমধ্যে এমন অনিয়মের কারণে মামলাও করেছে বন্ড ও কাস্টম কর্মকর্তারা।

কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, কারের পাশাপাশি জীপের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিসি উল্লেখ করে না দিলে এ সুবিধার অপব্যবহার হবে।

আমদানিকারকের বক্তব্য

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ১২ মে কারখানা চত্বতে পরীক্ষণ সম্পন্ন হওয়ার পর শুল্কায়নের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা দেরি হওয়ায় নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে এটি ঢাকায় নিয়ে আসি। আমাদের কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না এবং আইনের বিষয়টি এত গুরুত্ব দিয়েও ভাবিনি।

শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বা মালিকানা পরিবর্তন হলেও আমরা এ ‍সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখি। বেপজা থেকে নিশ্চিত হওয়ার পরই আমরা গাড়ি আমদানির উদ্যোগ নেয়। কারণ পূর্বের মালিক থেকে এটি আমরা কিনে নেয় এবং আগের ট্রেড ও বন্ড রেজিস্ট্রিশন নম্বারেই আমরা এখনো কার্যক্রম পরিচালনা করছি।'

গাড়িটি ঢাকায় ব্যবহার ও স্টিকার লাগানো বিষয়ে তিনি বলেন, 'এত গভীরভাবে বিষয়টি আমরা ভাবেনি। গাড়িটির ইঞ্জিন টেস্ট করার জন্য কিছু সময় চালানো হয়েছে। স্টিকার লাগানোর বিষয়টি আমার জানা নেই।'

দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বক্তব্য 

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. বশীর আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এসআরও-তে কিছু বিষয় অস্পষ্ট থাকায় তার অপব্যবহার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইন অনুযায়ী ৫ বছরের মধ্যে এসব গাড়ি হস্তান্তরের সুযোগ নেই। পরবর্তী হস্তান্তর হলে শুল্কহার কী হবে তাও স্পষ্ট উল্লেখ নেই। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ৫ বছর পর পর দুটি গাড়ি এনে ৪৮ কোটি টাকার সুবিধা পায় তাহলে সরকারের লাভের চেয়ে লসই বেশি হবে। এসআরও-এর এসব বিষয় স্পষ্ট করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে চিঠি পাঠানো হবে বলেও জানান তিনি।

শুল্কায়ন ছাড়া পণ্য চালান খালাস প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফকরুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অন্যান্য সব পণ্যের শুল্কায়ন ও পরীক্ষণ চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে হলেও ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানের আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে তা হয় ইপিজেডের অভ্যন্তরে। এসব পণ্য যাতে বাইরে যেতে না পারে তাই পাহারা দিয়ে ইপিজেডের কারখানা চত্বরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'বেপজার আইপি সত্যতা যাচাই ও এসআরও-এর কিছু বিষয়ে নিশ্চত হতে বিলম্ব হচ্ছিল। তাছাড়া অন্য কোনো কারণে বিলম্ব হচ্ছিল কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য ২ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু গাড়ি প্রতিষ্ঠানের জিম্মায় রয়েছে তাই পরবর্তী শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলেও শুল্ক আদায়ের সুযোগ ছিল। তবে প্রতিষ্ঠান কীভাবে গাড়িটি ঢাকায় নিয়ে গেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এতে কাস্টমস বা ইপিজেডের কেউ জড়িত থাকলে তা বের হয়ে আসবে।'

ইপিজেডের মতো সংরক্ষিত এলাকা থেকে গাড়িটি বের হওয়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ইপিজেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউদ্দিন বিন মেজবাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইপিজেডের ভেতরে গাড়ি প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় আমাদের নিরাপত্তাকর্মী থাকার পাশাপাশি কাস্টমস ও বন্ড কমিশনারেটের অফিসারও দায়িত্বে থাকেন। কীভাবে গাড়িটি বের হয়েছে তা তদন্ত করা ছাড়া বের করা সম্ভব নয়।'

তিনি বলেন, 'কোনো পণ্য শুল্কায়ন হয়েছে কি হয়নি তা আমরা দেখতে পারি না। তা দেখার দায়িত্ব আমাদেরও না। ফলে গাড়িটি শুল্কায়ন হয়েছে কি হয়নি, তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সার্ভারে যাদের অ্যাকসেস আছে তারাই বলতে পারবেন।'

শুল্ক গোয়েন্দার চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপপরিচালক এ কে এম সুলতান মাহমুদ বলেন, 'শুল্কয়ন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কোনো পণ্যেরই শুল্ক স্টেশন বা বন্ডেড এরিয়া থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। আমদানিকারক শুল্কমুক্ত ‍সুবিধা দাবি করলেও চূড়ান্ত নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা ভোগ করার সুযোগ নেই।'

'গাড়িটি গত ১৭ মে ঢাকায় আনার পর তা ব্যবহার করার আলামত আমরা পেয়েছি। শুল্কায়ন ছাড়া অবৈধভাবে পণ্য খালাস ও তা ব্যবহার করার দায়ে বৃহস্পতিবার বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। তদন্ত শেষে অভিযুক্তদের শনাক্ত ও কার দায় কতটুকু নিরুপণ করার পর ফৌজদারি মামলাও করা হতে পারে।'
 

Comments

The Daily Star  | English
Dhaka Airport lounges for migrant workers

A dignified welcome

Dhaka airport finally opens lounges dedicated to migrant workers and their families

16h ago