শারদ পাওয়ার থেকে গান্ধী, কেন শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রশান্ত কিশোর
ভারতের রাজনৈতিক কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য এবং তারপর বেশ কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে মনে করা হয়। তবে, তিনি নতুন করে আবারও শিরোনামে এসেছেন, তাকে নিয়ে শোনা যাচ্ছে নতুন গুঞ্জন।
প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে গুঞ্জন হলো- ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপিকে কোণঠাসা করতে তিনি হয়তো সূত্র খুঁজছেন। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিবিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রশান্ত কিশোর। যা এই গুঞ্জনকে উসকে দিয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশান্ত কুমারের সাম্প্রতিক বৈঠকগুলো থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনুমান- ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে মোকাবিলায় বিরোধী ঐক্য গঠনের চেষ্টা করছেন তিনি।
তবে, এমন জল্পনা-কল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রশান্ত কিশোর। তিনি মনে করেন, ‘তৃতীয় ফ্রন্ট বা চতুর্থ ফ্রন্ট’ ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে না। তিনি এটাও দাবি করেছেন, জাতীয় পর্যায়ে বিজেপির বিরুদ্ধে জয়ের সূত্র খোঁজার সঙ্গে এসব বৈঠকের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রশান্ত কিশোর ইতোমধ্যে ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) প্রবীণ নেতা শারদ পাওয়ার, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং এবং প্রভাবশালী গান্ধী ভাইবোন রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন।
ভারতের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে প্রশান্ত কিশোরের বৈঠকগুলো জেনে নিন-
গান্ধী ভাই-বোনের সঙ্গে বৈঠক
প্রশান্ত কিশোর গতকাল মঙ্গলবার (১৩ জুন) নয়াদিল্লিতে রাহুল গান্ধীর বাসায় দেখা করেছিলেন। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন শুরু হয়। বৈঠকে কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, কেসি বেণুগোপাল এবং হরিশ রাওয়াত উপস্থিত ছিলেন।
যদিও প্রশান্ত কিশোর এই বৈঠক নিয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেছিলেন, এটি শুধুমাত্র ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ এবং এটি নিয়ে এর বেশি কিছু ধারণা করা উচিত নয়। যদিও, সেই সৌজন্য সাক্ষাৎ প্রায় চার ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল।
ওই বৈঠকের সঙ্গে ভবিষ্যতের দুটি পরিকল্পনার যোগ সূত্রতা থাকতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এর একটি পরিকল্পনা হলো- আগামী বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শরদ পাওয়ারকে বিরোধী দলের ঐকমত্যের প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন। এর অর্থ হলো- এনসিপি কর্তা শারদ পাওয়ারকে ভারতের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য তদবির করছেন প্রশান্ত কিশোর, দাবি বিশ্লেষকদের।
সূত্র জানায়, প্রশান্ত কিশোর তার পরিকল্পনার একটি বিবরণী উপস্থাপনা করেছেন গান্ধী ভাই-বোনের কাছে। যেখানে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী ও বিজু জনতা দলের নেতা নবীন পট্টনায়েক একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিবেচনা করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রশান্ত কিশোর গান্ধীদের বলেছেন- পট্টনায়েক যদি বিরোধী জোটকে সমর্থন দেন, তাহলে সেই সংখ্যাটি ভারতের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য শারদ পাওয়ারকে এগিয়ে রাখবে।
দ্বিতীয় পরিকল্পনা হলো- ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির কাছে শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ হতে কংগ্রেসকে পুনরুজ্জীবিত করতে ভূমিকা পালন করবেন প্রশান্ত কিশোর। কিছু সূত্র জানিয়েছে, প্রশান্ত কিশোর গান্ধী পরিবারের কাছে যেসব বিষয় উপস্থাপন করেছেন তা কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
শারদ পাওয়ারের সঙ্গে বৈঠক
প্রশান্ত কিশোর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের পর এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ারের সঙ্গে তিনটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। গত ১১ জুন মুম্বাইয়ে তার সিলভার ওকস বাসভবনে শারদ পাওয়ারের সঙ্গে তিনি দেখা করেছিলেন।
তখন প্রশান্ত কিশোর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এই বৈঠকটি রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে আলোচনা নয়, শুধুমাত্র ‘সৌজন্য মধ্যাহ্নভোজন’ ছিল। যদিও বৈঠকটি প্রায় তিন ঘণ্টা স্থায়ী ছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে নানা জল্পনা তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো পক্ষ বৈঠকে আসলে কী হয়েছিল তা প্রকাশ করেনি।
তবে, সেই বৈঠকের একদিন পর শারদ পাওয়ার আট বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করেন। সেখানে আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন- তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, আম আদমি পার্টি, রাষ্ট্রীয় লোকদল এবং বাম ফ্রন্টের নেতারা। দিল্লিতে শরদ পাওয়ারের বাসভবনে এই বৈঠক হয়।
সেই আলোচনায় অংশ নেওয়া নেতারা জোর দিয়ে আবারও বলেছিলেন, এটি রাষ্ট্রীয় মঞ্চের সমমনোভাবাপন্ন নেতাদের একটি ‘অরাজনৈতিক’ বৈঠক। এই মঞ্চটি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলে যোগ দেওয়া প্রাক্তন বিজেপি নেতা এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা চালু করেছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে তৃণমূলের সহসভাপতি করেছেন।
পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক
এ মাসের শুরুতে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রশান্ত কিশোর। ২০১৭ সালের নির্বাচনে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের প্রচার কৌশলের দায়িত্বে ছিলেন প্রশান্ত। ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকটি দিল্লির কাপুরথালা হাউসে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তা নিয়ে কোনো কিছুই জানা যায়নি।
সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রশান্ত কিশোরের ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি (আইপিএসি) পাঞ্জাবে আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচার কৌশলের জন্য তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রশান্ত কিশোরকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করেছেন ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং।
এবং আরও তিন মুখ্যমন্ত্রী
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের বড় বিজয় প্রশান্ত কিশোরকে খ্যাতির নতুন স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। এই নির্বাচনকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল এবং সেখানে মমতার জয়ের কারিগর মনে করা হয় প্রশান্তকে।
সূত্র মতে, প্রশান্ত কিশোর সম্প্রতি নবীন পট্টনায়েক এবং তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিনের সঙ্গেও দেখা করেছেন। সম্প্রতি তাদের ভোট প্রচারের কৌশল তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন তিনি।
অভিজ্ঞ নির্বাচনী কৌশলবিদ
প্রশান্ত কিশোর ২০১৪ সালে নির্বাচনী কৌশলবিদ হিসেবে ভারতের রাজনীতিতে আবির্ভূত হন। সেসময় তাকে নরেন্দ্র মোদী ঢেউ তৈরির কারিগর হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। পরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ও জনতা দল-ইউনাইটেড (জেডিইউ) নেতা নীতিশ কুমার তাকে দলে নিয়ে আসেন।
নীতিশ কুমার যখন রাষ্ট্রীয় জনতা দলের প্রধান লালু প্রসাদের সঙ্গে জোট করেন। তখন ২০১৫ সালের বিহার নির্বাচনে তাদের বিশাল জয়ে অবদান রেখেছিলেন প্রশান্ত কিশোর।
প্রশান্ত কিশোরকে জেডি-ইউ সহ-সভাপতি হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন নীতিশ কুমার। তবে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এনআরসি ইস্যু নিয়ে জেডি-ইউ থেকে বহিষ্কার করা হয় প্রশান্ত কিশোরকে।
পরে, প্রশান্ত কিশোর ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টির প্রধান জগন মোহন রেড্ডির সঙ্গে কাজ করেন। জগন মোহন রেড্ডি ২০১৯ সালে অন্ধ্র প্রদেশের ক্ষমতায় আসেন। ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টির আহ্বায়ক এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রশান্ত। তারপরে দ্রাবিডা মুন্নেত্রা কাঝাগম (ডিএমকে) সভাপতি এমকে স্ট্যালিন তামিলনাড়ুতে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্যে প্রশান্ত কিশোরের নির্বাচনী কৌশল গ্রুপ আইপিএসিকে তার দলের সহযোগী ঘোষণা করেছিলেন।
Comments