মাহিন্দা রাজাপাকসের উত্থান-পতন
শ্রীলঙ্কার প্রভাবশালী রাজাপাকসে পরিবারের সদস্য ৭৬ বছর বয়সী মাহিন্দা রাজাপাকসে। একসময় তার পরিচিতি ছিল তিনি সবসময়ের জন্য শ্রীলঙ্কার 'নায়ক'। কিন্তু, দ্বীপরাষ্ট্রটিতে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সুনামির রূপ নেওয়ায় তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর শ্রীলঙ্কাকে এবারই সবচেয়ে চরম অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বৈদেশিক মুদ্রার অভাব। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে শ্রীলঙ্কা প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে পারছে না। তাই তীব্র হয়েছে খাদ্য ঘাটতি এবং দেখা দিয়েছে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি।
গত ৯ এপ্রিল থেকে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার পদত্যাগের দাবিতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাস্তায় নামেন। ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া এপ্রিলের মাঝামাঝি তার বড় ভাই চামাল ও বড় ভাতিজা নামালকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন।
তবে, অপর ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা পদত্যাগ করতে রাজি হননি। যদিও শ্রীলঙ্কা ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, ঋণের ভারে জর্জরিত দেশ পরিচালনায় ২ ভাইয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে।
ওয়ান ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহিন্দার পদত্যাগের পর তার সমর্থকরা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার কার্যালয়ের বাইরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়। এতে কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী আহত হন এবং সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। একইসঙ্গে রাজধানী কলম্বোয় সেনা মোতায়েন করা হয়।
রাষ্ট্রীয় সেবা, স্বাস্থ্য, বন্দর, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও ডাক থেকে শুরু করে প্রায় ১ হাজার ট্রেড ইউনিয়ন শক্তিশালী রাজাপাকসে পরিবারের গোতাবায়া ও মাহিন্দাসহ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে যোগ দিলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ আরও জোরালো হয়ে উঠে।
মাহিন্দা শ্রীলঙ্কার ২ বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট। ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। কিন্তু, ২০২০ সালে ইস্টারে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন। ওই হামলায় ২৭০ জন নিহত হন।
ওয়ান ইন্ডিয়া বলছে, তার নবগঠিত শ্রীলঙ্কা পিপলস পার্টি (এসএলপিপি) দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে ইতিহাস রচনা করে। ২০২০ সালের আগস্টে সাধারণ নির্বাচনে তার দল বিপুলভাবে বিজয়ী হয়।
এরপর, প্রভাবশালী রাজাপাকসে পরিবার ক্ষমতার ওপর তাদের কর্তৃত্ব আরও মজবুত করে তোলে। যা তাদের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে সংবিধান সংশোধনের অনুমতি দেয়।
ফলে, সামরিক অভিযানে তামিল টাইগারদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করা মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কর্মজীবনে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়লে প্রাথমিকভাবে মাহিন্দা রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সেখানে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক কম ছিল। তা সত্ত্বেও পর্যটন-নির্ভর শ্রীলংকার অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায় এবং দেশটিতে চরম অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এ কারণেই শেষ পর্যন্ত তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হলো।
মাহিন্দা একজন প্রবীণ স্ট্রিট-ফাইটার রাজনীতিবিদ। ১৯৭০ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন এবং সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে নিজের আসনটি হারানোর পর ১৯৮৯ সালে পুনরায় পার্লামেন্টে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আইনি পেশায় মনোনিবেশ করেন তিনি।
মাহিন্দা শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার অধীনে শ্রমমন্ত্রী (১৯৯৪-২০০১) এবং মৎস্য ও জলজসম্পদ মন্ত্রী (১৯৯৭-২০০১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ২০০৪ সালের এপ্রিলের সাধারণ নির্বাচনের পর মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। সেসময় দেশটির নির্বাচনে ইউনাইটেড পিপলস ফ্রিডম অ্যালায়েন্স সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
২০০৫ সালের নভেম্বরে মাহিন্দা শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে জয়ের পরপরই তিনি লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমকে (এলটিটিই) ধ্বংসের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
পূর্বসূরিরা ব্যর্থ হলেও এলটিটিই'র সঙ্গে প্রায় ৩০ বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শ্রীলঙ্কার মানুষের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। যা তাকে ২০১০ সালে বড় জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসতে সাহায্য করে।
২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মাহিন্দা তার অবস্থানকে আরও সুসংহত করেন। সংবিধান পরিবর্তন করে তাকে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেওয়া হয়। তার ৩ ভাই—গোতাবায়া, বাসিল ও চামালকে প্রভাবশালী পদে বসানো হয়। এ কারণে তার বিরুদ্ধে পারিবারিক সংস্থার মতো দেশ পরিচালনার অভিযোগ উঠে।
২০১৪ সালে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। সেই পরিস্থিতিতে নিজের সমর্থন হারানোর আগে আরও এক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদ সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে প্রাথমিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আহ্বান জানান।
কিন্তু, তার রাজনৈতিক জুয়াটি 'ব্যাকফায়ার' করে এবং ২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। রাজাপাকসের মন্ত্রিসভার সদস্য মৈত্রীপাল সিরিসেনা তাকে পরাজিত করেন এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মাহিন্দা চীনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সই করেন। যা ভারত ও পশ্চিমের দেশগুলোর জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৫ সালে মাহিন্দাকে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত রাখতে পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টে মেয়াদের জন্য সাংবিধানিকভাবে ২-মেয়াদের সীমা পুনরুদ্ধার করা হয়।
২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে রাজাপাকসেরা আদালতে দুর্নীতির মামলায় লড়ছেন। সেই সময়ে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা করা হয় এবং এখনো সেগুলো বিচারাধীন।
প্রায় ৩ বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা মাহিন্দাকে সংক্ষিপ্ত মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। সিরিসেনা তখনকার প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করেন। ঘটনাটি শ্রীলঙ্কাকে সাংবিধানিক সঙ্কটে ফেলে দেয়। সুপ্রিম কোর্ট সিরিসেনার পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়াকে 'অবৈধ' ঘোষণার পর ১৫ ডিসেম্বর মাহিন্দা পদত্যাগ করেন।
ওই ঘটনার পর মাহিন্দা ও পার্লামেন্টে তার সমর্থকরা ক্ষমতাসীন দল থেকে বেরিয়ে তার ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত এসএলপিপিতে যোগ দেন। এ দলে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দলীয় নেতা হন মাহিন্দা।
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল ইস্টারে ভয়াবহ বোমা হামলা শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল। ওই হামলার পর রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন এসএলপিপি দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতার জন্য প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহের সরকারের সমালোচনা করে।
এসএলপিপি তখন মাহিন্দা ছোট ভাই গোতাবায়াকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি এলটিটিই'র বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের শেষ বছরগুলোয় মাহিন্দার মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন।
এই ভাই-যুগল শ্রীলঙ্কানদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন। ২০১৯ সালে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গোতাবায়া জয়ী হন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন গোতাবায়া।
Comments