পুনীত রাজকুমার ‘দ্য ম্যান অব গোল্ডেন হার্ট’
ভারতের কন্নড় সিনেমার সুপারস্টার পুনীত রাজকুমার। সদ্য প্রয়াত এই অভিনেতা সবার কাছে 'পাওয়ারস্টার' নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু, কেন তাকে পাওয়ার স্টার ডাকা হতো? মূলত ভক্তরা তাকে ভালোবেসেই 'পাওয়ারস্টার' নাম দিয়েছিলেন। তবে, ভক্তরা তাকে এমনি এমনি এই নাম দেননি। তার পেছনেও কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল।
শুধু কর্ণাটকে নয়, পুরো ভারতে পুনীতের ভক্তের সংখ্যা ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। ভারতের বাইরেও তার ভক্তের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আর যা তিনি তৈরি করেছিলেন নিজের অভিনয় দক্ষতা এবং মানবিক গুণাবলী দিয়ে। পর্দার বাইরেও এই অভিনেতা অসংখ্য মানুষের জীবনের নায়ক ছিলেন, ছিলেন তাদের ভরসার আশ্রয়স্থল।
গত ২৯ অক্টোবর বেঙ্গালুরুর বিক্রম হাসপাতালে মৃত্যু হয় পুনীতের। তার বয়স হয়েছিল ৪৬ বছর। মাত্র ৪৬ বছরে প্রিয় তারকার মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেননি ভক্তরা। ভারতের একাধিক সংবাদমাধ্যমে খবর অনুযায়ী, পুনীতের মৃত্যুর খবর সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। আর তারপর দুই ভক্ত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আরেক ভক্ত প্রিয় তারকার ছবি সামনে রেখে আত্মহত্যা করেন। এ কারণে পুনীতের জনপ্রিয়তা নিয়ে কিছুটা হলেও শঙ্কায় ছিলেন রাজ্য সরকার। এজন্য সেখানে জরুরি অবস্থাও জারি করা হয়।
কেন তাকে পাওয়ারস্টার বলা হতো?
কিংবদন্তি অভিনেতা রাজকুমার এবং পার্বতীমা রাজকুমারের পুত্র পুনীত রাজকুমার। তাকে 'পাওয়ারস্টার' বলা হতো কারণ ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা অভিনেতা ছিলেন পুনীত। অনস্ক্রিন চরিত্রে ব্যতিক্রমী চিত্রায়ন ছিল তার অভিনয়ের মূল শক্তি। ভক্তরা কেবল তার নমনীয় মনোভাবের কারণেই নয়, গুণগ্রাহীদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও 'পাওয়ারস্টার' বলে অভিহিত করেছিলেন। কারণ পুনীত মাঝে মাঝেই ভক্তদের সঙ্গে দেখা করতেন, বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতেন। কখনো হঠাৎ করেই চলে যেতেন প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে। মিশে যেতেন সেখানকার মানুষের মাঝে আর বাড়িয়ে দিতেন সাহায্যের হাত।
বক্স অফিস রেকর্ডের ক্ষেত্রেও পুনীত রাজকুমার ইতিহাস তৈরি করেছিলেন। তিনি যে ৪৯টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তার মধ্যে ৪০টি প্রেক্ষাগৃহে একটানা ১০০ দিন চলেছিল। যেহেতু তার চলচ্চিত্রের সাফল্যের হার ছিল ৯০ শতাংশ, সুতরাং পুনীত রাজকুমার সব দিক থেকেই 'পাওয়ারস্টার' ছিলেন।
তিনি ২৯টি চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তার মধ্যে মাত্র ৬টি চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে ১০০ দিনের স্ক্রিনিং শেষ হয়নি। কিন্তু, বাকি ২৩টি বড়পর্দায় ১০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে প্রদর্শিত হয়েছিল।
ভারতের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতাদের একজন পুনীত রাজকুমার ২৯টি চলচ্চিত্রে প্রধান অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেন। তার নামের সঙ্গে 'পাওয়ারস্টার' শব্দটি ভক্তরা দিয়েছিলেন। এজন্য পুনীত সবসময় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন।
২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে পুনীত রাজকুমার বলেছিলেন, 'পাওয়ারস্টার নামটি আমার ভক্তরা আমাকে দিয়েছেন এবং তারাই আমার শক্তি।'
পুনীত রাজকুমার কিছু সিনেমাতে শিশুশিল্পী হিসেব অভিনয় করেছিলেন। শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনীত তার কয়েকটি সেরা সিনেমা- বসন্ত গীতা, চালিসুভা মোদাগালু, এরাদু নকশতারাগালু এবং বেট্টাদা হুভু। বেট্টাদা হুভুতে রামু চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলেন। এছাড়া, চালিসুভা মোদাগালু এবং এরাদু নকশতারাগালু জন্য কর্ণাটক রাজ্য সেরা শিশুশিল্পীর পুরস্কার পান।
২০০২ সালে পুনীত 'আপ্পু'র মাধ্যমে প্রধান অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম সিনেমা এতোটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, ভক্তরা তাকে আপু নামে ডাকতে শুরু করেন। তার কয়েকটি হিট সিনেমা হলো- অভি, বীরা কান্নাদিগা, মৌরিয়া, আকাশ এবং মিলানা।
২০১২ সালে অমিতাভ বচ্চন আয়োজিত হিন্দি শো 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'র কন্নড় সংস্করণ 'কন্নড়দা কোটাধিপতি'র প্রথম সিজনও হোস্ট করেছিলেন পুনীত রাজকুমার।
'দ্য ম্যান অব গোল্ডেন হার্ট'
পুনীতকে শুধু 'পাওয়ারস্টার' বলা হতো না। তার নমনীয় স্বভাবের কারণে 'ম্যান অব গোল্ডেন হার্ট'ও বলা হতো। তিনি সবসময় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সিনেমার পর্দায় নায়কের চেয়ে মানুষের বাস্তব জীবনের নায়ক হতে পারাটাই মূল সাফল্য। তাই দাতব্য সংস্থা এবং ফাউন্ডেশনে উদারভাবে দান করতেন। নিজেও কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালাতেন।
গত বছর পুনীত রাজকুমার করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজ্যকে সহায়তা করতে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ৫০ লাখ রূপি দান করেছিলেন। তার আগের বছর উত্তর কর্ণাটকে বন্যা দুর্গতদের সহায়তায় পুনীত মুখ্যমন্ত্রীর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ত্রাণ তহবিলে ৫ লাখ রূপি দান করেছিলেন। প্রয়াত বাবা ড. রাজকুমারের মতো পুনীতও মৃত্যুর পর চোখ দান করেন।
শুধু অভিনয় নয় গানও গাইতেন পুনীত কুমার। গান থেকে যা আয় করতেন তার পুরোটাই যেত দাতব্য সংস্থা ও অসহায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা তহবিলে। এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, গান গেয়ে তিনি যে অর্থ উপার্জন করেন তা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করা হয়।
Comments