বেড়েছে লবণের দাম, আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা
ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে ব্যবহৃত অপরিশোধিত লবণের চাহিদা বেড়েছে।
বাজারে চাহিদা বাড়ায় নারায়ণগঞ্জের পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র নিতাইগঞ্জ লবণ বাজারে লবণের দামও বেড়েছে। সেখানে প্রতি বস্তা (৭৪ কেজি) অপরিশোধিত লবণ ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ৭৪ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা লবণ ১ হাজার ৮০ টাকা থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক মাস আগে তা ৯৮০ থকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বাজারের চাহিদা অনুযায়ী লবণ না থাকা, উৎপাদন খরচ, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ও কক্সবাজারের লবণ চাষি-ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেও দাম বেড়েছে।
অপরিশোধিত লবণের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
এ ছাড়া, আসন্ন ঈদুল আযহায় কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে লবণের চাহিদা বাড়তে পারে। এই সুযোগে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী লবণের দাম বাড়াচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, আগে একটি ট্রাকে ২০ টন লবণ পরিবহনের ভাড়া ছিল ২০ হাজার টাকা। কিন্তু, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার টাকা।
অবশ্য বিসিক বলছে, বাজারে লবণের ঘাটতি নেই এবং কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। যারা এসব করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিতাইগঞ্জের মেসার্স ডিএস এন্টারপ্রাইজের মালিক দিলীপ রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উৎপাদন খরচ, পরিবহন খরচ বেড়েছে ও সরকার লবণ আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এসব কারণে লবণের কিছুটা দাম বেড়েছে।'
গরিবে নেওয়াজ সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক জামাল দেওয়ান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বরফ, বেকারি পণ্য, ড্রাইং, কোমলপানীয় তৈরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে লবণের চাহিদা বেড়েছে। আমদানি বন্ধ থাকায় স্থানীয় পর্যায় থেকে বড় বড় কোম্পানি লবণ কিনে মজুদ করছে। তাই লবণের চাহিদা বেড়েছে এবং চাহিদার সঙ্গে দামও বেড়েছে।'
খুচরা লবণ ব্যবসায়ীদের দাবি, মিল মালিক, বড় ব্যবসায়ী ও চাষি লবণ মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। ফলে, বাজারে লবণের চাহিদা দেখিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে সরকারকে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ সল্ট ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এইচএম শহীদ উল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছরের তুলনায় এ বছর ভালো দাম পেয়েছি। রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে। তাহলে আমরা কেন লবণ মজুদ করব? কিছু অসাধু ব্যবসায়ী লবণ আমদানি করতে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে।'
লবণের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে চাষি ও ব্যবসায়ীরা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কক্সবাজার, টেকনাফ, ইসলামপুর, পটিয়া, কুতুবদিয়া অঞ্চলের লবণ চাষিরা তাদের উৎপাদিত লবণ মজুত করে রেখেছে। এজন্য লবণের দাম বাড়ছে।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও পূবালী সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী পরিতোষ কান্তি সাহা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন আমাদের দেশে লবণের চাহিদা ৩০ লাখ টন। সরকার ধরেছে সাড়ে ২৩ লাখ টন। এবার সাড়ে ২৩ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়নি, হয়েছে সাড়ে ১৮ লাখ টন। এই যে ৯-১০ লাখ টনের ঘাটতি তার জন্য সরকার কী করছে, তা আমাদের জানা নেই। আমরা বলেছি যে পরিমাণ লবণ কম আছে তা আমদানি করুন। সরকার আনছি, আনব করছে। তবে আনছে না। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় দেশে লবণের দাম বাড়ছে। আমদানি করা না হলে লবণের দাম বেড়ে ডাবল হতে পারে।'
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের নারায়ণগঞ্জ জেলার সহকারী মহাব্যবস্থাপক আশিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে খাবার লবণ ও শিল্প লবণের ঘাটতি নেই। কেউ যদি কৃত্রিমভাবে বাজারে দাম বাড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
চামড়া ব্যবসায়ীদের দাবি, নানা অজুহাতে লবণ ব্যবসায়ীরা লবণের দাম বাড়াচ্ছেন। লবণের দাম বেশি হলে চামড়ার সংরক্ষণ খরচ বাড়বে।
রাজধানী ঢাকার চামড়া ব্যবসায়ী রহমান শেখ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোরবানির ঈদে চামড়া সংরক্ষণে অনেক লবণের প্রয়োজন হবে। এসময় লবণের দাম বাড়লে চামড়ার সংরক্ষণ খরচ বাড়বে। ফলে, লোকসানের ভয়ে কেউ কোরবানির চামড়া বেশি দাম দিয়ে কিনতে চাইবে না।'
নিতাইগঞ্জ থেকে বর্তমানে রাজধানীর পুরান ঢাকা, নরসিংদী, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, ভৈরবসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় লবণ সরবরাহ করা হয়।
এর আগে, এখানকার লবণ দেশের অন্যান্য জেলাতেও সরবরাহ করা হতো। কিন্তু, অনেক জায়গায় নতুন বাজার গড়ে ওঠায় এবং ব্যবসায়ীরা সরাসরি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে লবণ নেওয়ায় নিতাইগঞ্জে ভিড় কমেছে।
আয়োডিনযুক্ত লবণের দামও বেড়েছে
পাইকারি বাজারে আয়োডিনযুক্ত খাওয়ার লবণের দাম বস্তা প্রতি (২৫ কেজি) ২০-৩০ টাকা বেড়েছে। ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে এসিআই ৭৫০ থেকে বেড়ে ৭৮০ টাকা হয়েছে। কনফিডেন্স ৭৩০ থেকে বেড়ে ৭৬৫ টাকা হয়েছে। মোল্লা সুপার সল্ট ৬৪০ থেকে বেড়ে ৬৬০ টাকা হয়েছে। অন্যান্য ব্রান্ডের লবণ ৪৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৬০ টাকা হয়েছে।
বিসিক চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সারা বছরের লবণের চাহিদা কিন্তু চাষি, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই নিরূপণ করা হয়। এখন যদি ব্যবসায়ীরা ভিন্ন কথা বলেন তাহলে আমাদের কী করার আছে?'
তিনি আরও বলেন, 'ঈদকে কেন্দ্র করে লবণের চাহিদার কথা ভেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অগ্রিম লবণ আমদানির চিঠি দেওয়া হয়েছে। লবণ নিয়ে আমাদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কেউ যদি দাম বাড়িয়ে দেয় আমার কী করার আছে? দাম বৃদ্ধির বিষয়ে আমি আর কী বলব?'
বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলায় ৬১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই জেলায় ১৮ দশমিক ৩০ লাখ মেট্রিকটন লবণ উৎপাদিত হয়েছে।
গত এক দশকের মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ২৪ লাখ মেট্রিকটন লবণ উৎপাদন হয়েছিল। গত ৫ বছরে লবণ চাষের জমি ও চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
বিসিক জানায়, কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬০ সালে। বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয় কক্সবাজার জেলায়। মোট উৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশ লবণ আসে এই জেলা থেকে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাকি লবণ উৎপাদিত হয়।
Comments