অগমেন্টেড ইন্টেলিজেন্স: কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তাকে ছাপিয়ে মানুষ-মেশিনের মেলবন্ধন
স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির রোবটিক্স বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার বিশ্বজুড়ে বেকারত্ব বাড়াচ্ছে বলে মনে করেছেন অনেকে। উৎপাদনকেন্দ্রিক কারখানা থেকে শুরু করে সেবামূলক ব্যবসা—মানুষের এসব কাজ বর্তমানে রোবট কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সংবলিত মেশিনের মাধ্যমে করা হচ্ছে।
এর ফলে, বিশ্বব্যাপী শুধু কায়িক শ্রমনির্ভর মানুষগুলোই কাজ হারাচ্ছে ব্যাপারটা তা নয়, গবেষণা কিংবা বিশ্লেষকের মতো জ্ঞাননির্ভর কর্মীরাও এর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। মানুষের স্থানে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৮ কোটি মানুষ কাজ হারাবে। এই সময়ের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে মানুষ ও মেশিনের অনুপাত হবে সমান-সমান। তবে, প্রযুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হবে নতুন অনেক কর্মক্ষেত্র, যেখানে দরকার হবে মানুষের।
অতি আধুনিকতার এই যুগে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হলে কর্মজীবী মানুষকে হতে হবে আরও বেশি দক্ষ, বাড়িয়ে তুলতে হবে কর্মক্ষমতা, হতে হবে অতি মানবীয় গুণাবলীর ধারক। আর এই কাজটা করার জন্যে আবির্ভাব ঘটেছে অগমেন্টেড ইন্টেলিজেন্স নামক এক দুর্দান্ত প্রযুক্তির।
কী এই অগমেন্টেড ইন্টেলিজেন্স?
বর্তমানে বিশ্বের প্রভাবশালী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অগমেন্টেড ইন্টেলিজেন্স ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে এক ধরণের প্রতিযোগিতা রয়েছে। অধিকাংশের কাছে এই প্রযুক্তি অপরিচিত মনে হলেও ইতোমধ্যেই অনেকে এটা ব্যবহার করেছে। অ্যামাজনের অ্যালেক্সা কিংবা অ্যাপলের সিরির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় আছে। এসবই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও অগমেন্টেড ইন্টেলিজেন্সের কাজ। অগমেন্টেড ইন্টেলিজেন্স আসলে মানুষের বুদ্ধিমত্তারই একটা বর্ধিত অংশ, যেখানে মানুষের জ্ঞানের সঙ্গে মেশিনের ক্ষমতার এক দারুণ মিশ্রণ ঘটানো হয়।
সেই আঠারো শতকেই মানব মন অনুকরণ বা মস্তিষ্কের একটা কৃত্রিম রূপ তৈরির কাজটা শুরু হয়েছিল, সে সময়ে অবশ্য একে অস্বাভাবিক কাজ ভাবা হলেও আজকের দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে তা বড্ড স্বাভাবিক। মানুষের মনের কর্মপ্রক্রিয়া অতি জটিল ও বিস্তৃত। মানুষের বুদ্ধিমত্তা মূলত রিকগনাইজ ও রিজন-এর সমন্বিত সক্ষমতার একটি প্রক্রিয়া। সহজ করে বলতে গেলে, কোনো সমাবেশ বা ভিড়ের মধ্যে একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি তার পরিচিত মানুষকে খুঁজে বের করার যে সক্ষমতা ধারণ করে, সেটাই হচ্ছে মানব মনের রিকগনিশন ক্ষমতা। গাছ, সূর্য, পানি ও বাতাসসহ অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বিত অতি জটিল প্রক্রিয়ার ফল যেমন আবহাওয়া, তেমনই মানুষের আচরণের সমন্বিত রূপই হচ্ছে তার কর্মপ্রক্রিয়া। বিশ্বের সবকিছুই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও জটিল প্রক্রিয়া। একসঙ্গে বহু বিষয় নিয়ে চিন্তা করা থেকে শুরু করে তার ফলাফল অনুমান করার বিস্তৃত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষমতা মানব মনকে বিশেষ করে রেখেছে। যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে এখনো অর্জন করা সম্ভব হয়নি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কেবল একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে খুব দ্রুত কাজ করতে পারে, যেমন অনেক ডাটা প্রক্রিয়ার কাজটা এই প্রযুক্তি দিয়ে মানুষের চেয়ে দ্রুত করা সম্ভব। তবে, মানুষের মনের মতো জটিল ও বিস্তৃত কার্যসম্পাদন এই প্রযুক্তিতে এখনো সম্ভব না।
আবার, একটি অফিসের প্রতিটা ডিপার্টমেন্টের জন্যে আলাদা করে একেকজন বিশেষজ্ঞ থাকে, কারণ একজন মানুষের পক্ষে সব বিষয়ে সমানভাবে দক্ষতা বা পাণ্ডিত্য অর্জন সম্ভব না। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো মানুষের বুদ্ধিমত্তাতেও আছে অনেক সীমাবদ্ধতা। বর্ধিত বুদ্ধিমত্তা বা অগমেন্টেড ইন্টেলিজেন্সের কাজটা ঠিক এখানেই, যা এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে মানুষকে আরও বেশি সক্ষমতা এনে দিতে পারে। আরও সহজ করে বলতে গেলে, মানুষের কার্যপরিধি বাড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যৌথ কাজের ফলই হচ্ছে অগমেন্টেড ইন্টেলিজেন্স। অগমেন্টেড ইন্টেলিজেন্সকে মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরিপূরক ও বলা যায়। ইতোমধ্যেই এই প্রযুক্তি ডাটা সায়েন্স এবং মেশিন লার্নিং-এর মাধ্যমে মানুষকে গ্রাহক সেবা, অর্থনৈতিক সেবা, স্বাস্থ্য সেবা, ইত্যাদি নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সহায়ক বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য
সেলফ ড্রাইভিং ক্ষমতাসম্পন্ন একটি গাড়ির উদাহরণের মাধ্যমে এই দুইয়ের মধ্যকার পার্থক্যটা দেওয়া যাক। কোনো মহাসড়কে সেলফ ড্রাইভ মোডে গাড়ি চালালে গাড়িটি নিজের লেনে থেকে একটা নির্দিষ্ট গতিতে এবং সামনের গাড়ি থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে পারে, সামনে কিছু থাকলে হর্ন দিয়ে সতর্ক করার পাশাপাশি গাড়িটি নিজে নিজে থেমেও যেতে পারে। চালকবিহীন এসব যানবাহন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই একটি ফল—যা বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভুলভাবে বিশালাকার ডাটা প্রসেসসহ সিদ্ধান্ত নেওয়া, পুনরাবৃত্তিমূলক কাজও করতে পারে, যা মানুষের পক্ষে দুরূহ এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব। মেশিনের এই কর্মদক্ষতার ফলে কাজ হারাচ্ছে গাড়ির চালকের মতো অনেক পেশার মানুষ। কিন্তু, বিপত্তিটা বাধে যদি ওই গাড়ির সামনে আচমকা কিছু একটা চলে আসে, লেন পরিবর্তনের দরকার হয় কিংবা তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা মেশিনের পক্ষে সম্ভব না। বর্ধিত বুদ্ধিমত্তার চাতুর্য ঠিক সেখানেই, যা মেশিনের কাজগুলোর পাশাপাশি মানুষের বিরল বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয়ে এক বর্ধিত বুদ্ধিমত্তার জন্ম দেয়।
মানবীয় বুদ্ধিমত্তার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ডাটা জেনারালাইজ করার ক্ষমতা, আরেকটি সৃজনশীলতা। মেশিনের পক্ষে এখন পর্যন্ত এসব সম্ভব হয়নি। মেশিন হয়তো পিকাসো, ভিঞ্চির আঁকা ছবিগুলোর অনুকরণ করতে পারবে, নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারবে না; রবি ঠাকুর-জীবনানন্দ-শেলি-কিটস-লেননের সমস্ত কবিতা-গান মুখস্থ করে ফেলতে পারবে, তাদের মতো করে এসব শিল্প সৃষ্টি করতে পারবে না। এই সৃষ্টিশীলতার জন্যে দরকার সৃজনশীলতা, মানব স্পর্শের, তার মননের কোনায় কোণায় থাকা সূক্ষ্ম-সুন্দরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা কিংবা তীক্ষ্ণ ও তীব্র দুঃখবোধ অথবা চরমা হতাশা বা উদাসীনতার—যা এখনো মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। মেশিন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলেও আবেগময় এসব কাজের ক্ষেত্রে কেবল মানুষই নিতে পারে। বর্ধিত বুদ্ধিমত্তা মেশিনের সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে মানুষের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও কাজ করার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এ কারণেই, অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার থেকে বর্ধিত বুদ্ধিমত্তাকে এগিয়ে রাখতে চেয়েছেন।
২০১৯ সালের আগস্টে, করোনা মহামারি আঘাত হানার আগমুহূর্তে গার্টনার একটা স্টাডিতে বলেছিল, ২০২১ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিবর্ধন বা অগমেন্টেশন বিশ্বব্যাপী ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার মূল্য সৃষ্টি করবে। করোনার কারণে সেটা বাস্তবায়িত না হলেও কোভিড-১৯-এর পরীক্ষা, ওষুধ, জিনোম সিকোয়েন্সিং ও টিকা আবিষ্কারের পেছনে এই প্রযুক্তি দারুন অবদান রেখেছে।
তথ্যসূত্র:
বিবিসি সাইন্সফোকাস, ফোর্বস, ওরাকুয়ান্টিক, হেলথ এনালিটিক্স, জেনপ্যাক্ট ও ডিজিটালরিয়ালিটি
Comments