অস্ট্রেলিয়ায় ‘রক্তাক্ত’ ক্যাপ্টেন কুক
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবস 'অস্ট্রেলিয়া ডে' তে দেশটির ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী মেলবোর্নে ব্রিটিশ অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জেমস কুকের একটি ভাস্কর্যে লাল রঙ ঢেলে দেওয়া হয়েছে।
আদিবাসীদের সংবেদনশীলতার কারণে দেশটিতে 'অস্ট্রেলিয়া ডে' নিয়ে তুমুল বিতর্ক আছে।
প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি দেশটিতে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের বার্ষিকী 'অস্ট্রেলিয়া ডে' পালন করা হয়। ১৭৭৮ সালের এই দিনে প্রথম একটি ব্রিটিশ নৌযান সিডনি উপসাগরে উপস্থিত হয়েছিল। আর ক্যাপ্টেন কুক অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে প্রথম পা রাখেন ১৭৭০ সালে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্ট্রেলিয়া সরকার নানা আয়োজন ও পরিকল্পনায় ধুমধাম করে ২৬ জানুয়ারি পালনের উদ্যোগ নিলেও দেশটির আদিবাসীরা দিবসটির জন্য ভিন্ন কোনো তারিখ বেছে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। তাদের ভাষ্য, ২৬ জানুয়ারির উদযাপন তাদের আঘাত করে।
কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবারও এই দিনটি পরিবর্তনের জন্য দেশজুড়ে বিক্ষোভ করেন হাজারো আদিবাসী। এর মধ্যেই মেলবোর্নে কুকের ভাস্কর্যটি লাল রঙে রাঙিয়ে বিকৃত করে দেওয়া হয়।
এর আগেও ২০১৮ সালে একবার কুকের একই ভাস্কর্যের ওপর গোলাপি রং ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। যেখানে গ্রাফিতিতে লেখা ছিল, 'গণহত্যা গর্ব নয়'।
গতকাল সিডনি, মেলবোর্ন, ব্রিসবেন, ক্যানবেরা, কুইন্সল্যান্ডসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচির ভেতর দিয়ে আদিবাসীরা বলেন, সারা পৃথিবী দেখেছে আমাদের খুন, আমাদের নারীদের ধর্ষণ, আমাদের শিশুদের চুরি, আমাদের ভূমি ও নদীতে বিষ প্রয়োগ, আমাদের ভাষার নিন্দা। আজ অস্ট্রেলিয়া ডে নয়। আজ আক্রমণ দিবস। এই দিনে আমাদের ভূমি কেড়ে নেয়া হয়েছিল।
সিডনিতে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে আদিবাসীরা চিৎকার করে বলেন, আমরা ছিলাম, আমরা আছি। আমাদের ভূমি আমরা ফেরত চাই।'
বিক্ষোভ সমাবেশের প্রধান অতিথি এলিজাবেথ জ্যারেট তার বক্তব্যে বলেন, 'যেদিন আদিবাসীদের গণহত্যার সূচনা হয়েছিল; সেদিন কেন সরকারি ছুটি দিয়ে বলা হচ্ছে– যাও তোমরা হুইস্কি খেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করে দিনটিকে উদযাপন করো।'
এলিজাবেথ জ্যারেট আরও বলেন, 'আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে, এখনও শ্বেতাঙ্গরা আমাদের খুন করছে, আমাদের নারীদের ধর্ষণ করছে, আমাদের শিশুদের চুরি করছে এবং আমাদের সংস্কৃতি অপবিত্র করছে। রয়্যাল কমিশনের ৩০ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ সময়ের মধ্যে পুলিশের হেফাজতে প্রায় ৫০০ আদিবাসীর মৃত্যু হয়েছে।'
অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর মতে, এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য আগে কখনো দেখা যায়নি। তাদের ভাষ্য, আগের বছরগুলোর তুলনায় এবারের বিক্ষোভে প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ অংশ নিয়েছে। যাদের সবার হাতেই ছিল আদিবাসীদের নিজস্ব পতাকা, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড।
গণমাধ্যমগুলো বলছে, অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম পা রাখা ক্যাপ্টেন কুকের ভাস্কর্য লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়ে বিক্ষোভকারীরা কেবল অস্ট্রেলিয়াকেই নয়; বরং গোটা পৃথিবীকে এই বার্তা দিয়েছে যে, গণহত্যা অহংকারের নয়।
বুধবার সিডনিতে বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজকদের অন্যতম রাউল বাসি বলেন, 'আমাদের ভূমিতে দাঁড়িয়ে আজকের দিনে শ্বেতাঙ্গরা দাবি করেছিল যে, এই ভূমি তাদের। এই লজ্জা আমাদের নয়, লজ্জা এই সমাজের।'
এ সময় বিক্ষোভকারীরা 'লজ্জা, লজ্জা' বলে চিৎকার করে ওঠেন। স্মরণ করেন পুলিশি হেফাজতে নিহত স্বজনদের।
এক বক্তা বলেন, অনেক আদিবাসী একটি 'ভাঙা' আইনি ব্যবস্থায় জেলে আটকা পড়ে আছে।
আরেকজন বলেন, 'আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আমাদের একটি চুক্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতিগুলো বালিতে আঁকা রেখার মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে।'
লিটোনা দুংয়ে নামের এক আদিবাসী নারী কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, তার ছেলেকে ২০১৫ সালে ৬ জন পুলিশ কর্মকর্তা বিনা প্ররোচনায় হত্যা করেছে। তাকে মৃত্যুর আগে কেবল ১ প্যাকেট বিস্কুট খেতে দেওয়া হয়েছিল।
তিনি তার ছেলে হত্যার বিচারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বলেন, 'আমি ও আমার আইনজীবীরা অস্ট্রেলিয়া সরকারকে জাতিসংঘে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো।'
২০১৬ সালের সর্বশেষ আদমশুমারির হিসাবে অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসীর সংখ্যা ৭ লাখ ৯৮ হাজার ৪০০ জন।
প্রোডাক্টিভিটি কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতি ৬ জন আদিবাসীর মধ্যে ১ জন এখন জেলে আছেন কিংবা জীবনে একবার হলেও জেলে গিয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা দেশের বাকি নাগরিকদের তুলনায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজ সবক্ষেত্রেই অনগ্রসর। দেশের অন্য নাগরিকদের তুলনায় তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা ভাল নয়। তাদের প্রত্যাশিত আয়ু বা লাইফ 'এক্সপেক্টেন্সি'ও কম।
এ ছাড়া আদিবাসীদের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আত্মহত্যার উচ্চ হার, ট্রমা ও মনোবৈকল্য।
আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক
Comments