পশুপাখির চিকিৎসায় ভরসা ‘বিডিভেটস’
বিশ্বে ভেটেরিনারি চিকিৎসা, রোগনির্ণয় ও রোগ সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থার ব্যাপক অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশের অগ্রগতি তেমন আশানুরূপ নয়। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুসারে, প্রাণীর বিভিন্ন রোগবালাইয়ের কারণে বাংলাদেশে বছরে ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পাশাপাশি পশুপাখির রোগবালাই সম্পর্কে মানুষের সচেতনতারও অভাব আছে। অথচ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৩১ শতাংশ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৬১ শতাংশ মানুষ জড়িত।
এ অবস্থায় দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারি ও কৃষকদের কাছে ভরসারে জায়গা হয়ে উঠেছে বিডিভেটস নামে একটি মোবাইল অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার খামারি ও কৃষক সেবা নিয়েছেন। ২৯২টি উপজেলার ৮৮৫ জন পশু চিকিৎসক ৪ হাজার ৭৯২টি ডিজিটাল ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৮৮৪টি হাঁস-মুরগি ও ১ হাজার ১৮টি গবাদি পশুকে চিকিৎসা দিয়েছেন।
এই মোবাইল অ্যাপটির উদ্ভাবক প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিঠুন সরকার। ২০১৮ সালে তার উদ্যোগেই অ্যাপটি চালু করা হয়। তিনি এখন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।
মিঠুন সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৩ সালে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকার সময় দেখতাম, মাছ ধরার ঝাকিতে করে রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে। সে সময় মনে হয়েছিল, মানুষেরই যখন এমন অবস্থা, তখন এই এলাকার গৃহপালিত পশুপাখির অবস্থা নিশ্চয় আরও খারাপ হবে। তখন থেকে আমি ভাবতে শুরু করি, প্রয়োজনের সময় দুর্গম এলাকার কৃষক ও খামারিদের পশুপাখির চিকিৎসায় কী করা যায়?'
মিঠুন সরকার খেয়াল করেছিলেন, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শহরে রোগী বহন করে আনা যেমন কষ্টসাধ্য, গরু-ছাগল বয়ে নিয়ে আসাটাও তেমন কষ্টকর ও ব্যয়বহুল। এ অবস্থায় ২০১৫ সাল থেকে তিনি পশুপাখির চিকিৎসাসেবা প্রদানে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ শুরু করেন।
মিঠুন সরকার বলেন, 'আমি ২০১৮ সালে বিডিভেটস ডটকম (bdvets.com) নামে একটি ওয়েব সাইট তৈরি করি। পরে অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের কাজ শিখে bdvets মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনও তৈরি করেছি। যার মাধ্যমে আজ দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষ বিনা পয়সায় ঘরে বসে সহজেই ভেটেরিনারি চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন।'
গুগল প্লে স্টোর থেকে bdvets অ্যাপটি নামিয়ে তা মোবাইলে ইনস্টল করে নিলেই ইন্টারনেট ছাড়াই অ্যাপটি ব্যবহার করা যায় বলে জানান মিঠুন সরকার। রোগের ধরন অনুসারে ব্যবস্থাপত্রসহ সব ধরনের পরামর্শ পাওয়া যায় এখান থেকে। পাশাপাশি বিনামূল্যের টিকাদান কর্মসূচি ও পশুপাখির বিভিন্ন রোগ এবং তার প্রতিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন সচেতনতামূলক বার্তাও পাঠানো হয় এখান থেকে। এছাড়া সরাসরি ওয়েসাইটে ঢুকেও এ সংক্রান্ত নানাকিছু জানতে পারেন সবাই।
বিডিভেটস থেকে সেবা নেওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বাসিন্দা সালমা আক্তার গত ১০ বছর ধরে নিজ বাড়িতে ২০টি গরু পালন করছেন। কিছু দিন আগেও তার একটি গরু খুরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তিনি বলেন, 'গরুর মতো প্রাণী মারা গেলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়। আমার গরুটি মারা যাওয়ার পর এক আত্মীয়ের কাছ থেকে আমি অ্যাপটি (বিডিভেটস) সম্পর্কে জানতে পারি। পরে অ্যাপটি ইনস্টল করে এর মাধ্যমে বিনা খরচে বিভিন্ন সেবা নেই।'
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে আমুলী এলাকার খামারি এম এ কাইয়ুমের ভাষ্য, 'হাওর কিংবা গ্রামাঞ্চলের খামারি ও কৃষকদের পক্ষে উপজেলা পর্যায়ের ভেটেরিনারি সার্জনের কাছ থেকে সেবা নেওয়ার বিষয়টি কঠিন। কিন্তু বিডিভেটস মোবাইল অ্যাপ এটাকে সহজ করে তুলেছে।'
অ্যাপের উদ্ভাবক মিঠুন সরকার জানান, অনলাইন সার্ভারে কে কী ধরনের সেবা নিচ্ছেন তার রিয়েল টাইম ডাটা সংরক্ষণ করা হয়। এতে সেবায় স্বচ্ছতা বাড়ছে। এছাড়া অ্যাপটি সহজেই কাস্টমাইজ করা যায়। যেকোনো কৃষক এটি ব্যবহার করতে পারেন। এখানে কৃষকরা তাদের নিজস্ব ডেটা ইনপুট করতে পারেন। পাশাপাশি চিকিৎসকরাও নিজেরা ওষুধসহ অন্যান্য ডেটা ইনপুট করতে পারেন এবং ব্যবস্থাপত্রের টেমপ্লেটগুলো কাস্টমাইজ করতে পারেন। এটি একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যা উদ্ভাবক ছাড়াও সিস্টেমটি চালু রাখবে।
বগুড়া সদর উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুস সামাদও এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রান্তিক খামারিদের পরামর্শ দেন। প্রয়োজনে ভিডিও কলের মাধ্যমে পশুপাখির চিকিৎসা দেন। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'যদি গুরুতর কোনো সমস্যা পাই, তাহলে অ্যাপের মাধ্যমেই স্থানীয় ভেটেরিনারি সার্জন খোঁজার পরামর্শ দেই আমি।'
মৌলভীবাজারের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আব্দুস সামাদ মিঠুন সরকারের এই উদ্ভাবনী উদ্যোগটিকে একটি 'টেকসই উদ্যোগ' হিসেবে অভিহিত করেন। তার মতে, এর মাধ্যমে প্রাণিসম্পদের জন্য চিকিৎসেবা এখন মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে।
কুলাউড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরীর ভাষ্য, এটি মহৎ একটি উদ্যোগ। এসডিজি লক্ষ্য অর্জনেও এই উদ্যোগ সরাসরি ভূমিকা রাখছে।
Comments