ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১৮১ ইটভাটার ৯৯টি অবৈধ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় নির্বিঘ্নে চলছে পরিবেশ বিধ্বংসী ১৮১টি ইটভাটার কার্যক্রম। এর মধ্যে ৯৯টি অবৈধ। প্রশাসনের কঠোরতার অভাবকে পুঁজি করে অবৈধ এসব ইটভাটা চলছে বছরের পর বছর ধরে।
এসব ইটভাটার বেশিরভাগ কৃষিজমি, বসতবাড়ি, বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে। প্রশাসনের নাকের ডগায় বৈধ-অবৈধ সবগুলো ভাটাতেই জ্বালানি হিসেবে নিম্নমানের কয়লা পোড়ানোর কারণে মারাত্মক বায়ুদূষণ হচ্ছে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় আম, লিচু, নারিকেল, ধানসহ মৌসুমি ফল ও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে টিনশেড ঘরের চাল।
এ ছাড়াও জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নিয়ে তা দিয়ে ইট তৈরি করায় উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে ফসলি জমি। সুস্থ পরিবেশের জন্য এসব ইটভাটা এখন 'গলার কাঁটা' হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কার্যালয়ের হিসাব মতে, জেলার ৯টি উপজেলায় ১৮১টি ইটভাটা রয়েছে। পরিবেশগত ছাড়পত্রের ভিত্তিতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বৈধ ইটভাটার সংখ্যা ৮২। লাইসেন্স ছাড়া অবৈধভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে ৯৯টি। এর বাইরে বাকি ৩০টি ইটভাটা বিভিন্ন কারণে বন্ধ বা পরিত্যক্ত রয়েছে। তবে তাদের তালিকার বাইরেও জেলায় আরও ইটভাটা রয়েছে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ইটভাটা চালানো যাবে না। এ ছাড়াও ভাটা নির্মাণের আগে জেলা প্রশাসন, বিএসটিআই, স্থানীয় ভূমি অফিসসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থার ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। এর ব্যত্যয় হলে ২ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এসব নিয়ম কাগজে থাকলেও তা মানছে না ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইটভাটার মালিকরা।
সরেজমিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সুহিলপুর, বাকাইল এবং সরাইল ও বিজয়নগর উপজেলার ইটভাটাগুলোতে দেখা গেছে, প্রতিটি ইটভাটাই ফসলি জমির মাঝখানে স্থাপন করা। প্রতিটি ভাটার ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে জনবসতি রয়েছে। এ ছাড়া অধিকাংশ ইটভাটার ৫০০ মিটারের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
স্থানীয় পরিবেশবাদীরা বলছেন, ভাটা মালিকরা বছরের পর বছর ধরে আইন লঙ্ঘন করলেও তাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসন। ইট প্রস্তুতের মৌসুম শুরুর আগে ভাটা মালিকরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে মোটা অংকের অর্থ লেনদেন করে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিবেশ উজ্জীবি মঞ্চের সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, 'অবৈধভাবে এতগুলো ইটভাটা একটি জেলায় কীভাবে চলে? পরিবেশের জন্য হুমকি এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, এর সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আমাদের ক্ষতি করে কোনো অবৈধ ইটভাটা চলতে পারে না।'
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সদস্য সচিব মো. নাসির মিয়া বলেন, 'জমির উর্বরা শক্তি মাটির উপরিভাগের ১২ থেকে ২০ ইঞ্চির মধ্যে থাকে। তাই উপরের মাটি বিক্রি করায় জমির উর্বরা শক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। ভাটার একশ্রেণীর দালাল দরিদ্র কৃষকদের অভাবের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে কৃষি জমি থেকে ২-৩ ফুট পরিমাণ গর্ত করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এই মাটি ইট তৈরির কাজে লাগানো হচ্ছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে কৃষি জমি থেকে মাটি কাটায় উর্বরা শক্তি কমে যাওয়ার পাশাপাশি ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক বলেন, '২০২৫ সাল পর্যন্ত মাটি দিয়ে ইট তৈরির অনুমতি আছে। এরপরে মাটি দিয়ে আর ইট বানানো যাবে না। হঠাৎ করে ইটের ভাটা ভেঙে দিলে মানুষের কষ্ট হবে, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে প্রশাসনের উচিত, যেসব ভাটা পরিবেশের তেমন বেশি ক্ষতি করছে না তাদের ব্যাপারে সহনশীল হওয়া। আর যেগুলো পরিবেশের বেশি ক্ষতি করছে তাদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে আগামী ৩ বছরের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া।'
অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নুরুল আমিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৪১টি ইটভাটাকে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং সেগুলো আংশিকভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ২৯টি অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে ২৭ লাখ ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়াও গত বছর ৫টি অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতে মামলা দায়ের করা হয়।'
Comments