উত্তরাঞ্চলে নতুন ৭ সেতু: ত্রুটিপূর্ণ নকশায় নদীর ক্ষতি
দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) সাম্প্রতিক নির্মিত অন্তত সাতটি সেতুতে ত্রুটি খুঁজে পাওয়া গেছে, যা নদীগুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এক সরকারি প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
সওজের বৈদেশিক তহবিল নির্ভর প্রকল্পটির ওপর বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) করা প্রতিবেদনটিতে নদীর বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
সওজের ‘দ্য ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজেস ইমপ্রুভমেন্ট’ প্রকল্পের ওপর সম্প্রতি আইএমইডি একটি নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা ২০২০-২১ অর্থবছরে টেকনো কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই নিরীক্ষাটি করিয়েছে।
সওজ প্রতিটি সেতুতে পরিবেশ বান্ধব পোস্ট-রেলিংয়ের পরিবর্তে সলিড রিইনফোর্সমেন্ট কংক্রিটের (আরসিসি) দেয়াল নির্মাণ করেছে। ফলে নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, তারা নির্মাণকৃত সেতুগুলোর গুণগত মান যাচাই করার জন্যে গবেষণাগারে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা চালিয়েছেন এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত ফলগুলো তাদের কাছে ‘সন্তোষজনক’ মনে হয়েছে।
‘তবে, এ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন জেলায় (দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়) নির্মিত সাতটি সেতুর গাইড ব্যাংকগুলো ত্রুটিপূর্ণ। ফলে এটি নদী ক্ষয়ে বা শুকিয়ে যাওয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণ তৈরি করতে পারে’, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, সেতুর গাইড ব্যাংক নদীর পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং এটি নিশ্চিত করে যাতে পানি সব সময় সেতুর নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পঞ্চগড়ের চাওয়াই সেতু ও দিনাজপুরের পার্বতীপুরের আরেকটি সেতুর অ্যালাইনমেন্টে ত্রুটি খুঁজে পাওয়া গেছে।
কিছু সেতুর পিলারের প্রস্থ দুই দশমিক পাঁচ মিটার, যার কারণে নদীর প্রবাহ সংকুচিত হয়ে গেছে। যদি পিলারগুলোকে গোলাকার না বানিয়ে উপবৃত্তাকারে নির্মাণ করা হতো, তাহলে নদীর পানির প্রবাহ এত সংকুচিত হত না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবিষ্যতে সেতু নির্মাণ করার আগে এ বিষয়টি কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় রাখতে হবে।
২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে সওজ দুই হাজার ৯১১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় ২৬টি জেলায় ৮২টি সেতু নির্মাণ করছে। আইএমইডির প্রতিবেদনে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সংশোধিত সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবেন না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
২০১৫ সালের নভেম্বরে সরকার ৬১টি সেতু নির্মাণের মাধ্যমে মানুষ ও পণ্যের নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর পরিবহন নিশ্চিত করার জন্য ‘দ্য ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজেস ইম্প্রুভমেন্ট’ প্রকল্পটি হাতে নেয়। প্রকল্পের মোট খরচের ৬৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ দেবে জাপান।
প্রকল্পটি পাঁচটি প্যাকেজের মাধ্যমে ও দুই হাজার ৯১১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা খরচে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
একজন প্রকল্প কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালে প্রকল্পের সঙ্গে আরও ২২টি সেতু যোগ করা হয়। এ কারণে প্রকল্পের নির্ধারিত সময়সীমাকে বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত নেওয়া হয়।
তবে, প্রকল্পের খরচ অপরিবর্তিত থেকে যায়। কারণ, নরসিংদীর একটি বড় সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে সেটির জায়গায় ২২টি ছোট সেতু তৈরির জন্য বাজেটের পুনরায় বরাদ্দ দেওয়া হয়।
তিনটি প্যাকেজের আওতায় নির্মিত ২৫টি সেতু গত বছরের মার্চে উদ্বোধন করা হয়েছে। চারটি প্যাকেজে অন্যান্য সেতুগুলোর কাজ চলছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে
দিনাজপুরের রাজাপুর উপজেলার গবুরা ইউনিয়নের গর্ভেশ্বরী নদীর ওপর ৮০ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
সরেজমিনে পরিদর্শনের বরাত দিয়ে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেতুটির গাইড ব্যাংক আংশিকভাবে নদী দখল করে নিয়েছে। এ কারণে ব্রিজের উজানে নদী প্রায় মৃত হয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়াও, নদীর তলদেশে সিমেন্ট কংক্রিটের (সিসি) ব্লক বসিয়ে সেটিকে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, প্রকৌশলগত দিক দিয়ে এটির কোনো উপযোগিতা নেই।
দিনাজপুরের মাদারগঞ্জে আত্রাই নদীর ওপর দিয়ে যাওয়া সেতুটির বিষয়ে বলা হয়েছে, গাইড ব্যাংকটির দ্বারা নদীর আংশিক দখল করা হয়েছে এবং নব্যনির্মিত সেতুটির অ্যালাইনমেন্টের ক্ষেত্রেও ত্রুটি রয়েছে। সেখানে আগে নির্মিত পুরনো সেতুটিতে অ্যালাইনমেন্ট ঠিক ছিল। এ ত্রুটির কারণে ব্রিজের ভাটিতে নদী-তীর ভাঙন আক্রান্ত হয়েছে।
সওজের একজন প্রকৌশলী বলেন, নদী যাতে গতিপথ পরিবর্তন না করতে পারে এবং সেতুর নিচ দিয়ে যাতে পানি প্রবাহিত হয়, সেটি নিশ্চিত করার জন্যে সেতুর সঙ্গে গাইড ব্যাংক নির্মাণ করা হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ২৮৬ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পেরেছেন এবং তারা বাড়তি অর্থ ব্যয় করে একই প্রকল্পের আওতায় আরও ১০টি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন।
তবে, আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারবে না। আইএমইডির প্রতিবেদনে নতুন সেতুর বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
প্রতিবেদনে আইএমইডি জানিয়েছে, প্রকল্প কর্তৃপক্ষের ২০২০ সালের জুনের মধ্যে এক হাজার ৮৫৫ দশমিক ৩৬ কোটি টাকা (প্রকল্পের মোট খরচের ৬৩ দশমিক ৭১ শতাংশ) খরচ করার কথা ছিল। কিন্তু, তারা মাত্র ৪৪২ দশমিক ৬৯ কোটি টাকা খরচ করতে পেরেছে।
প্রকল্পটি ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৫৯ দশমিক ১৩ শতাংশ আর্থিক অগ্রগতি দেখাতে পেরেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৫টি সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ও ৩৫টি সেতুর নির্মাণকাজ প্রায় শেষ (৯৮ শতাংশ) অবস্থায় আছে। তবে, বাকি সেতুগুলোর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে মাত্র ২০ শতাংশ শেষ হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২২টি সেতু ও অন্যান্য কাজ ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে না।’
সওজ কী বলছে?
সওজের প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর জানান, তারা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছেন। ‘সেখান (মূল পরিকল্পনা) থেকে সরে আসার তেমন কোনো সুযোগ নেই’, বলেন তিনি।
বর্তমান পরিচালক দায়িত্বভার গ্রহণ করার আগে সবুর এই প্রকল্পটির পরিচালক ছিলেন।
দ্য ডেইলি স্টার একাধিকবার চেষ্টা করেও বর্তমান প্রকল্প পরিচালক খান মো. কামরুল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।
আইএমইডির পর্যবেক্ষণ বিষয়ে জানতে চাইলে সবুর বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছি, যেখানে আমরা আমাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণগুলোর বিষয়ে তাদেরকে জানিয়েছি।’
অ্যালাইনমেন্টের ত্রুটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা সংযোগ সড়কের সঙ্গে সমন্বয় করে এই সীমাবদ্ধতাটি দূর করার চেষ্টা করেছি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments