‘পরীক্ষা না হলে বিকল্প ব্যবস্থা’ এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতি ও উদ্বেগ

স্টার ফাইল ছবি

বছরের শুরুতেই পরীক্ষা শেষ করে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হওয়ার কথা ছিল কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের শিক্ষার্থী তাসনিম খানের। অথচ ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও সে নিশ্চিত না যে পরীক্ষা হবে, নাকি বিকল্প উপায়ে মূল্যায়ন করা হবে। তাসনিমের মতো প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর এ বছর এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা। তাদের সবার সামনেই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখে দিয়েছে, মূল্যায়নের পদ্ধতিটা আসলে কেমন হবে। কারণ, মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করছে তাদের প্রস্তুতি।

পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়ে তাসনিম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ব্যক্তিগত উদ্যোগে সন্তোষজনক প্রস্তুতি নিলেও অনলাইনে সে কোনো ক্লাসই করতে পারেনি। না পারার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘জানতামই না অনলাইন ক্লাসের কথা। স্কুল থেকেও জানানো হয়নি। বেশ কয়েকদিন পর বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারি, ততদিনে অধিকাংশ ক্লাস হয়ে গেছে। তাই পরে আর আগ্রহ পাইনি।’

তাসনিম বলেন, ‘আমার স্কুলের মাত্র ৩০-৪০ ভাগের মতো শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পেরেছে। বাকিদের অনেকে জানতোই না, কখন-কীভাবে ক্লাস হয়। জানলেও ডিভাইস নেই, ডিভাইস থাকলেও ইন্টারনেট সংযোগ নেই। আবারও কারও কারও আগ্রহও নেই।’ তবে তাসনিম মনে করেন, এসএসসি পরীক্ষা না হলেও কোন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হবে সেটা দুএক মাস আগে সেটা জানালে সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যাবে।

ঝিনাইদহের সরকারি কে সি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ফাহিম ফেরদৌস ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ বছর অটোপাশ না দিয়ে সরকার বিকল্প চিন্তা করছে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য একটা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসও দেওয়া হয়েছে। তবে, কোন সময় ও কোন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাইনি। ভালো প্রস্তুতির জন্য মূল্যয়ন পদ্ধতি সম্পর্কেও ধারণা থাকা দরকার।’

সংক্ষিপ্ত সিলেবাস সম্পর্কে ফাহিম জানান, আগের বছরগুলোর তুলনায় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে অধ্যায় সংখ্যা। যেমন, উচ্চতর গণিতে ৫০ ভাগ, পদার্থ বিজ্ঞানে ৫০ ভাগ ও রসায়নে ২০ ভাগ অধ্যায় কমিয়ে তৈরি করা হয়েছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস। তবে, অনলাইন ক্লাস ও প্রস্তুতির বিষয়ে ফাহিম বলেন, ‘সিলেবাসের মাত্র ১০-১৫ ভাগ শেষ করা গেছে অনলাইনে ক্লাস করে। বাকিটা নিজেদের মতো করে পড়ে নিতে হচ্ছে।’

ফাহিমের মতে, ‘বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হবে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের কারণে। যেমন, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে কোনো কোনো বিষয়ের মাত্র অর্ধেক সংখ্যক অধ্যায় পড়ার সুযোগ পাচ্ছি। এখন আমার প্রশ্ন হলো, যখন ভর্তি পরীক্ষা দেবো তখন কি অর্ধেক সিলেবাস থেকে প্রশ্ন করা হবে নাকি পুরো বই থেকে। যদি পুরো বই থেকে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে সেটা আমাদের জন্য সমস্যার কারণ হবে। আবার অর্ধেক সিলেবাস পড়ে পাশ করে উচ্চশিক্ষা নিতে গেলেও ঝামেলায় পড়তে হবে।’

বছরের শুরুতেই শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি সমমান পরীক্ষায় অটোপাস নয়, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসেই অনুষ্ঠিত হবে। তবে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

এ ছাড়া গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট পাসের প্রক্রিয়ার সময় বিরোধীদলের সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন ছাঁটাই প্রস্তাবের জবাব দিতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার বিষয়ে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন সারাবিশ্বেই ব্যত্যয় ঘটেছে। আমাদের এখানেও কিছুটা ঘটেছে। কিন্তু, তাদের যাতে দীর্ঘ মেয়াদে কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়, তার জন্য সর্বোচ্চ নজর রাখছি। কেভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শ গ্রহণ করেই আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকি।’

এ বিষয়ে খুব শিগগির জানানো হবে উল্লেখ করে দীপু মনি বলেন, ‘শিক্ষার্থী অভিভাবকসহ সবাইকে বলব উদ্বিগ্ন হবেন না। বৈশ্বিক সংকট চলছে। এই সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সব ক্ষেত্রে সেভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। একইভাবে শিক্ষাক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত হবে। এটি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। অবশ্যই আমরা প্রজ্ঞা, জ্ঞানের সব কিছু প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নেব।’

পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মাহবুবা তাবাচ্ছুম ইমা বলেন, ‘অনলাইন ক্লাসে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস থেকে মাত্র ৩০ ভাগের মতো পড়ানো হয়েছে। তাছাড়া আইসিটি ও ইংলিশের মতো বিষয়ে অনলাইনে ক্লাস করে খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। এই অবস্থায় পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে সেটা আমাদের জন্য খারাপই হবে।’

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ও লকডাউনের কারণে কলেজে যেতে হয় না বলে ঢাকা ছেড়ে ফেনীতে নিজেদের বাড়িতে থাকছেন ইমা। সেখানকার বন্ধুদের পড়ালেখার প্রস্তুতির সম্পর্কে জানান, তারা ডিভাইস ও নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে অনলাইনে খুব একটা ক্লাস করে না।

কুমিল্লার ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদুল আল গালিব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা হলেও এখনো ৩০ ভাগের মতো পড়ানো হয়নি। এই অবস্থায় পরীক্ষা নিলে ভালো করতে পারব না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কিছুদিন ক্লাস নিয়ে তারপর পরীক্ষা নিলে ভালো হতো।’

রাজধানীর ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী জাসিয়া উম্মে মারজান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে সে বিষয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারিনি। অনলাইনে খুব বেশি ক্লাস হয় না, পেমেন্ট নেওয়ার সময় হলে কিছুদিন ক্লাস নেয়। আবার ক্লাস নিলেও ১০-১৫ জনের বেশি সেখানে ক্লাস করে না। আবার নিজেদের মতো করে যে প্রস্তুতি নেব, বাইরের টিচার পাওয়া যাচ্ছে না বলে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।’

করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন পরীক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই আগের ফল মূল্যায়নের ভিত্তিতে অটো পাশ করে যায়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সারাদেশের ২১ লাখ ২৭ হাজার ৮১৫ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা অংশ নেয় এবং তাদের মধ্যে ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫ জন পাশ করে। সেই হিসাবে এ বছর প্রায় সেই সাড়ে ১৭ লাখ শিক্ষার্থীর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা।

তবে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বেশি হবে। আগের বছরগুলোতে অনেকে টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়নি, এবার তারা অটো পাশের আশায় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে।’

চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাসসহ একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এস এম আমিরুল ইসলামের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘পুনর্বিন্যাসকৃত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।’ তবে কোন পদ্ধতিতে বা কোন সময়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে সে বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি।

মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আমিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে। তবে পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয় তো বলেই দিয়েছেন, জাতীয় পরামর্শক কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখনো পরামর্শক কমিটি গঠিত হয়নি, আবার বিকল্প ব্যবস্থা কী হবে সেটা আমাদের জানানো হয়নি। আমরাও একই কথা বলব, যদি পরীক্ষা না নেওয়া যায়, তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা আসবে। তবে, তার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে।’

অনলাইনে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে যা রিপোর্ট দেওয়ার সেটা দিয়ে দিয়েছি। এ বছর মাধ্যমিকে প্রায় ২৩ লাখ ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সাড়ে ১৭ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীর অংশ নেওয়ার কথা। আপতত অনলাইনে সারাদেশের এই বিশাল সংখ্যক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়ার মতো পরিস্থিতিও নেই। প্রযুক্তিগত সক্ষমতার দিক দিয়ে আমরা এখনো ওই অবস্থায় পৌঁছতে পারিনি।’

তবে, দেশের টিকাদান কর্মসূচি যদি ভালোভাবে এগিয়ে যায়, তাহলে এসএসসি ও এইচএসসির প্রায় ৪০ লাখের মতো শিক্ষার্থীর আগে টিকা দিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টাও চিন্তা-ভাবনার মধ্যে আছে বলে জানান আমিরুল ইসলাম।

Comments

The Daily Star  | English
US attack on Iran nuclear sites

Iran denounces US attack as ‘outrageous’

Iran says 'no signs of contamination' after US attacks on key nuclear sites

8h ago