নিয়মিত ছাত্র নন, তবুও ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে

ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

দেশের ছাত্রসংগঠনগুলো শুধু নামেই 'ছাত্রসংগঠন' হিসেবে টিকে আছে। বাস্তবে যারা সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগেরই ছাত্রত্ব শেষ। ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে শীর্ষ নেতারা বছরের পর বছর থেকে যান একই ক্লাসে, সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হওয়ার চেষ্টারও কমতি নেই। সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডও শিক্ষার্থীবান্ধব নয়, বরং 'লেজুরবৃত্তিক' বলে অভিযোগ বিজ্ঞজনদের।

দুটি বড় ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতৃত্বের (যেমন- সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) কেউই নিয়মিত ছাত্র নন।

ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী) এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা ছাত্রলীগ, ছাত্রদল এবং ছাত্র ফ্রন্টের (মার্কসবাদী) যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের ছাত্রত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাছাড়া ঢাবিতে অপর ২ ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী'র বর্তমানে কোনো কমিটি নেই।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের অবশ্য ঢাবি শাখার দুটি শীর্ষ পদে নিয়মিত ছাত্র রয়েছে। ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে সাবেক এক ছাত্র এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে একজন নিয়মিত ছাত্র আছেন।

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, এই প্রবণতা নতুন নেতৃত্ব তৈরির জন্য ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিকে প্রতিফলিত করে। এটি সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থের পরিপন্থী বলেও জানান তারা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নেতা যদি নিয়মিত ছাত্র না হন, তাহলে তিনি ছাত্রদের মনস্তত্ত্ব ও চাহিদা বুঝতে পারেন না।'

ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান এজন্য অভিভাবক সংগঠনগুলোকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, 'তারা (অভিভাবক সংগঠন) শুধু এমন কাউকে চায়, যে বিরোধীদের সঙ্গে লড়তে পারে এবং গালিগালাজ করতে পারে।'

অভিভাবক সংগঠনগুলোর ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, 'এটি একটি ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে যে, কোনো ছাত্রসংগঠনই তাদের নিজস্ব নেতা নির্বাচন করবে না।'

ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

গত মাসে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের 'অছাত্র' আখ্যা দিয়ে তাদের ঢাবি ক্যাম্পাসে ঢুকতে ছাত্রলীগ বাধা দেওয়ার পর বিষয়টি সামনে আসে।

তবে ছাত্রদল নেতারা বলছেন, ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারাই নিয়মিত ছাত্র নন।

'তারা (ছাত্রলীগ) আমাদের অছাত্র উল্লেখ করে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিচ্ছে না। কিন্তু তারা নিজেরাই নিয়মিত ছাত্র নয়। তাহলে তারা কীভাবে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারে?', প্রশ্ন রাখেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ।

সাইফ মাহমুদ ঢাবিতে ভর্তি হয়েছিলেন ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে। বাংলা বিভাগে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষে এখন সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর (সান্ধ্য কোর্স) করছেন তিনি।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম ঢাবিতে ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। বাংলা বিভাগ থেকে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি এখন তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ (সান্ধ্য কোর্স) থেকে আবার স্নাতকোত্তর করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী হলগুলোতে শুধু নিয়মিত শিক্ষার্থীরা থাকতে পারবেন।

ঢাবি সিন্ডিকেটের একটি আদেশে বলা আছে, ৮ বছরের বেশি কোনো শিক্ষার্থী ঢাবির নিয়মিত ছাত্র হিসেবে অধ্যয়ন করতে পারবেন না। এই ৮ বছরের মধ্যে ৬ বছরে স্নাতক ও ২ বছরে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে হবে।

চাকরিজীবীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ডিজাইন করা সান্ধ্য কোর্সে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে ১ থেকে ২ বছর সময় লাগে।

ঢাবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আকতার হোসেন ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে ও সদস্যসচিব আমানউল্লাহ আমান ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ভর্তি হন ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে।

আল নাহিয়ান খান জয় আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ থেকে আবার স্নাতকোত্তর (সান্ধ্য কোর্স) করছেন। লেখক ভট্টাচার্য ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন ওই ইনস্টিটিউটেই আবার স্নাতকোত্তর (অন্য বিষয়ে সান্ধ্য কোর্স) করছেন।

ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস আইন বিভাগে ভর্তি হন ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন একই বিভাগে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন।

গত বছর পর্যন্ত ছাত্রত্বের মেয়াদ থাকা সাদ্দাম হোসেন ছাত্রলীগের শীর্ষ ৪ নেতার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তবে তার স্নাতক শেষ করতে ৮ বছর লাগে। অনুষদের ডিনের বিশেষ অনুমতিতে তাকে অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়েছিল।

ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

এ বিষয়ে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা সত্য যে, অনার্সের জন্য ৬ বছর এবং মাস্টার্সের জন্য ২ বছরের নিয়ম আছে। তবে অনেক সময় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়।'

আল নাহিয়ান খান জয় ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগ কর্মীরা ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতিতে অংশ নিতে পারেন।'

'ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই আমার চেয়ে ১০ বছরের বড়। নিয়মিত ছাত্র না হওয়ার কারণে ছাত্রদল নেতাদের হলে থাকতে দেওয়া হয় না', বলেন তিনি।

যদিও ডেইলি স্টার ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস এবং সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনসহ অন্তত ৭০ জন কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখার নেতাদের খোঁজ পেয়েছে, যারা নিয়মিত ছাত্র নন তবুও অবৈধভাবে হলে অবস্থান করছেন।

ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয়দেব ভট্টাচার্য ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষ এবং সাধারণ সম্পাদক রাশেদ শাহরিয়ার ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র।

ঢাবি শাখা ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী) সভাপতি সালমান সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক প্রগতি বর্মণ তমা ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন।

৪ জনের কেউই আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র নন।

এ বিষয়ে সালমান সিদ্দিকী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়েছে।'

ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ ও সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন।

ফয়েজ উল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের নেতৃত্ব আমাদের নিজস্ব সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত হয়। ছাত্রত্ব কোনো মাপকাঠি হতে পারে না, মূলত ছাত্র রাজনীতি থেকে আমাদের দূরে রাখার জন্যই বিষয়টি উত্থাপন করা হচ্ছে।'

ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একাংশের সভাপতি রাশিদুল হক ঢাকা কলেজে ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষ এবং সাধারণ সম্পাদক মাসুদ আহমেদ ঢাবিতে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন।

ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি কাজী আব্দুল মোতালেব নিয়মিত ছাত্র নন এবং সাধারণ সম্পাদক অতুলন দাস একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করছেন। সংগঠনটি তাদের ঢাবি ইউনিটের কাউন্সিল আয়োজনের জন্য ৭ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে।

ছাত্র ফ্রন্ট ঢাবি শাখার সভাপতি রাজীব কান্তি রায় ও সাধারণ সম্পাদক সুহাইল আহমেদ শুভ ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের নিয়মিত ছাত্র।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি আমার ৫২ বছরের কর্মজীবনে কখনো দেখিনি যে, ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়, যেমন- আবাসন, লাইব্রেরি ও শ্রেণিকক্ষ সংকট নিয়ে পরস্পরের মধ্যে মারামারি করেছে।'

'তাহলে আমরা কী করে বলি যে এগুলো ছাত্রসংগঠন?', প্রশ্ন রাখেন তিনি।

অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান মনে করেন যে, অছাত্ররা ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে উঠে আসার একটি কারণ হলো- নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন না হওয়া।

'এই তথাকথিত ছাত্র নেতারা সাধারণত সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে... তারা সার্বক্ষণিক তাদের অভিভাবক সংগঠনের স্বার্থ সিদ্ধিতে সদা ব্যস্ত থাকে, যে কারণে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো উপকারে আসে না', যোগ করেন তিনি।

Comments