ছাত্রলীগের কমিটিতে মন্দিরে হামলা, অস্ত্র-মাদক মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি

শয়ন আহমেদ শিখন একটি জুতার কারখানায় কারিগর হিসেবে কাজ করেন। ফারদিন তাহের রাহুল নাসিরনগরে মন্দির ভাঙচুর মামলার আসামি। ওবায়দুর রহমান বাবু মাদক মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। রবিউল আলম রবিন অস্ত্র মামলায় কারাগারে ছিলেন। সাইফুল ইসলাম উজ্জ্বল রেলস্টেশনে চা বিক্রি করেন।

এসব পরিচয় ছাপিয়ে এই ৫ জন এখন ছাত্রলীগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির নেতা। তাদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে গত ৩১ অক্টোবর জেলা ছাত্রলীগের ৩৪৯ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। ৭ সদস্যের আংশিক কমিটি গঠনের প্রায় ৪৫ মাস পর এই পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন পায়।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে অনুমোদিত কমিটিতে দেখা যায়, সেখানে শয়ন আহমেদ শিখনকে সহ-সম্পাদক করা হয়েছে। স্কুলের গণ্ডি পার না হওয়া এই যুবক শহরের পীরবাড়ি এলাকার একটি জুতার কারখানায় কারিগর হিসেবে কাজ করেন। নাসিরনগরে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ভাঙচুর মামলার আসামি একই উপজেলার বুড়িশ্বর গ্রামের বাসিন্দা ফারদিন তাহের রাহুলকে উপ-ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। রাহুল সেই বছরের ৪ নভেম্বর মন্দির ভাঙচুর মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগ শেষে জামিনে বের হয়ে বিদেশে চলে যান। মাস দুয়েক আগে তিনি দেশে ফেরেন।

গত বছরের ১১ এপ্রিল আখাউড়া থানায় দায়ের হওয়া মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ওবায়দুর রহমান বাবু। পরে একই বছরের ৩১ আগস্ট পুলিশ ওই মামলায় তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয়। তাকে সহ-সভাপতি করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ৯ জুন একটি পিস্তল ও দুই রাউন্ড গুলিসহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করা রবিউল আলাম রবিনও পেয়েছেন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদ। রেলস্টেশনে চা বিক্রি করা সাইফুল ইসলাম উজ্জ্বলকে একই কমিটির উপ-কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক ও উপ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক- এই ২ পদে রাখা হয়েছে।

বৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। গঠনতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে ৩০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়েও বড় ৩৪৯ সদস্যের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটিতে এই ৫ জন ছাড়াও ঠাঁই পেয়েছেন ইয়াবা ব্যবসায়ী, ছাত্রদল নেতা, হেফাজতের জ্বালাও-পোড়াও মামলার আসামি, অছাত্র, বিবাহিত, সন্তানের জনক, প্রবাসী, সহোদর ভাই, ফটোকপির দোকানের কর্মচারী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, স্কুলের গণ্ডি পার না হওয়া, ত্রিশের অধিক বয়সী, এসএসসি ফেল এবং মাদক, চুরি ও ছিনতাই মামলার আসামি।

অনুমোদিত কমিটির তালিকা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। কমিটিতে এমন বিতর্কিতদের স্থান দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীরা। গতকাল বিকেলে ছাত্রলীগের একটি অংশ এই বিতর্কিত কমিটি সংশোধনের দাবিতে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। তারা আগামী ৭ দিনের মধ্যে কমিটি সংশোধনের দাবি জানান।

বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অন্তত ২ শতাধিক লোককে স্থান দেওয়া হয়েছে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে। অনুমোদিত কমিটিতে ১৩৬ জনকে উপ-সম্পাদক, ৯০ জনকে সহ-সভাপতি, ৫৯ জনকে সহ-সম্পাদক, ৪০ জনকে সদস্য, ১১ জনকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও ১১ জনকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। ছাত্রলীগের ইতিহাসে কোনো জেলা কমিটিতে একই পদে এত বেশি সংখ্যক লোককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

বিতর্কিত কমিটি নিয়ে জেলা পর্যায়ের ১ ডজনেরও বেশি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এই প্রতিবেদকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এটি কমিটি নয়, কমেডি হয়েছে। এর মাধ্যমে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি পুরনো ছাত্র সংগঠনের ঐতিহ্যকে ম্লান করে দেওয়া হয়েছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই কমিটি করার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

অনুমোদিত কমিটির ১৩ পৃষ্ঠার তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, জেলার কসবা উপজেলার পশ্চিম ইউনিয়ন শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবির মো. সোহাগকে জেলা ছাত্রলীগের সদস্য করা হয়েছে। ছাত্রদল নেতা মো. শাফী আলম এবং ছাত্রদল কর্মী মো. জাহিদ হাসানকে সহ-সভাপতি করা হয়েছে। স্কুলের গণ্ডি পার না হওয়া এবং ছিনতাইসহ একাধিক মামলার আসামি মো. মোজাম্মেল হককে সহ-সম্পাদক করা হয়েছে। সাইফুল ইসলাম উজ্জ্বল এবং শিশির আলমকে একই কমিটিতে ২ পদে রাখা হয়েছে। সরাইলের প্রত্যন্ত রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন রেজা ও তার ভাই আফজাল হোসেনকে কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে। বিবাহিত এই সহোদরের মধ্যে আলমগীর হোসেনকে সহ-সভাপতি এবং আফজাল হোসেনকে উপ-মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। বিবাহিত দম্পতি মিকাইল হোসেন হিমেলকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এবং তাহসীন চৌধুরী তানহাকে উপ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক পদে রাখা হয়েছে।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ১০ এর 'ক' ধারায় বলা আছে, জেলা ইউনিটের কমিটি ১৫১ সদস্যের নির্বাহী সাংসদ গঠিত হবে। গঠনতন্ত্রের ৫ এর 'ক' উপধারা মতে, অনূর্ধ্ব ২৯ বছর বয়সী বাংলাদেশের যেকোনো স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারবেন। ৫ এর 'গ' উপধারা ও ৫ এর 'ক' উপধারা অনুযায়ী বিবাহিত, ব্যবসায়ী ও চাকরিতে নিয়োজিত কোনো শিক্ষার্থী ছাত্রলীগে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাত্রলীগের এই কমিটিতে গঠনতন্ত্রের কোনো নিয়ম মানা হয়নি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান পারভেজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষকেই বাদ দেওয়া হয়নি। একেবারে যাচ্ছেতাই ও ঢালাওভাবে ছাত্রলীগের কমিটি করা হয়েছে। ছাত্রলীগের সর্বনিম্ন পর্যায়ের ওয়ার্ড ইউনিটে থাকার যোগ্যতাও নেই, এমন ব্যক্তিদের জেলা কমিটিতে রাখা হয়েছে। বিবাহিত, অছাত্র, মাদক ব্যবসায়ী, মাদকসহ বিভিন্ন মামলার আসামি প্রায় ১০০ জন এই কমিটিতে পদ পেয়েছেন, যা খুবই দুঃখজনক।'

তবে এই কমিটির বিষয়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেল বলেন, '২০১৪ সালে সর্বশেষ আমাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছিল। এর মাঝে দীর্ঘ ৭ বছর গ্যাপের কারণে কমিটিতে পদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। গঠনতন্ত্রের একটি ধারায় বলা আছে- কোনো কারণে কমিটি গঠনে বিলম্ব হলে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি কমিটিতে পদের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।'

কমিটিতে বিতর্কিতদের পদ পাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বিদেশ সফর শেষে দেশে ফেরার পর বিষয়টি তাদেরকে অবগত করে কমিটি থেকে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়া হবে।'

প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল-নহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য।

কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী বলেন, 'আমার ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব নেওয়ার আগে এই কমিটি দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে বিতর্কিত কেউ থাকলে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দেশে ফেরার পর তাদেরকে বিষয়টি জানানো হবে এবং অবশ্যই এর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিতর্কিত কিংবা অনুপ্রবেশকারী কেউ থাকলে ছাত্রলীগ কখনোই তাদেরকে সাপোর্ট করবে না।'

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই কমিটি করতে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতারা জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা করেনি। তারা আমাদের পরামর্শ না নিয়ে কমিটি করেছে। এই ধরনের অনিয়ম হওয়া উচিত নয়, আমরা এটি পছন্দ করিনি।'

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারি রবিউল হোসেন রুবেলকে সভাপতি ও শাহাদাৎ হোসেন শোভনকে সাধারণ সম্পাদক করে ৭ সদস্যের একটি আংশিক কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

Comments

The Daily Star  | English

‘Salma was killed by tenant, not her son’

Salma was killed by her “drug peddler” tenant, not by her 19-year-old son, said police yesterday contradicting Rab’s claim.

3h ago