চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতির প্রতিবাদে শাহবাগে সমাবেশ

জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতির প্রতিবাদে প্রতিবাদ সমাবেশ। ছবি: সুচিস্মিতা তিথি/স্টার

জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতির প্রতিবাদে রাজধানীর শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সারাদেশের ৩৩টি চলচ্চিত্র সংগঠনের চলচ্চিত্রকর্মীরা।

আজ সোমবার বিকেল ৫টায় 'জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদান ২০২১-২২' এর সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপন ঘোষণার প্রেক্ষিতে এবং বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিক অসঙ্গতির প্রতিবাদে এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

এতে বক্তব্য রাখেন চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ, চলচ্চিত্র নির্মাতা জাহিদুর রহিম অঞ্জন, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিক্ষক ও চলচ্চিত্রকার মানজারে হাসিন মুরাদ, নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরী, নির্মাতা ফরিদুর রহমান, নির্মাতা হুমায়রা বিলকিস, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী শিয়ান শাহরিয়ারসহ আরও অনেকে।

আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা অপরাজিতা সংংগীতা।

বক্তারা জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদানে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দেওয়ার সমালোচনা করেন এবং অনুদানে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের জন্য আলাদা পরিকল্পনা নেওয়ার দাবি জানান।

চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, 'প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র ইতিহাস যেমন অসম্পূর্ণ তেমনি আমাদের যাপিত জীবন, ইতিহাস ঐতিহ্যও অসম্পূর্ণ। শিল্প মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে একটি নয়, একাধিক প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।'

প্রতিবাদ সমাবেশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ সদস্যদের সংগীত পরিবেশনা। ছবি: সুচিস্মিতা তিথি/স্টার

নির্মাতা ও চলচ্চিত্রকর্মী মানজারে হাসিন বলেন, 'জনগণের অর্থে যে চলচ্চিত্র দেশের কথা বলবে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবে, আমাদের সংস্কৃতির কথা বলবে, আমাদের মানুষের সংগ্রাম এবং অর্জনের কথা বলবে সেই চলচ্চিত্রের জন্যই অনুদান চালু হয়েছিল। অনুদানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে গত ৩ বছর ধরে মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।'

এ বছর অনুদানপ্রাপ্ত বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'আমি কাউকে অসম্মান করছি না কিন্তু সাকিব খান কি একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে পারেন না? তাকে সরকারি অনুদান দিতে হবে কেন? আর তিনিওবা কেন সরকারি অনুদান নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন কেন? সরকারি অনুদান পৃথিবীর কোনো দেশেই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রকে দেওয়া হয় না।'

তিনি অভিযোগ করেন, 'আমি এর আগে এখানে উপস্থিত অনেকের মতোই এ অনুদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম৷ আমি জানি কী হয়। আমি এবার একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রের জন্য আবেদন করেছিলাম। আমি পাইনি তাতে কিছু যায় আসে না। ঘোষণায় আছে প্রামাণ্যচিত্রের জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া যাবে। কিন্তু আমি ভেতরের খবর জানি। কোনো প্রামাণ্যচিত্রেরই প্রস্তাবনা নির্বাচকমণ্ডলীর সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। আমি এবং আমার মতো আরও ৭ জন যারা অনুদানের জন্য প্রস্তাবনা জমা দিয়েছিলেন তাদের সবারই এর পেছনে ২-৩ মাসের শ্রম আছে, সময় আছে, অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। শুরুতেই বলে দেওয়া হতো যে প্রামাণ্যচিত্রে অনুদান দেওয়া হবে না।'

নির্মাতা জাহিদুর রহিম বলেন, 'অনেকেই খুশি যে এবছর ২০টি চলচ্চিত্রে অনুদান দেওয়া হয়েছে। টাকাও অনেক বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আপনি যদি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন আগে ৫টা ছবিকে অনুদান দেওয়া হতো এর মধ্যে অন্তত ৩টা ছবি ভালো হতো। গত ৫ বছরের তালিকা দেখেন ২০টা ছবিকে অনুদান দিয়ে আসলে কোনো লাভ হচ্ছে না। এটার সঙ্গে রাজনৈতিক যে লোকগুলো জড়িত তারা দেখেছে যে এটাতে অনেক টাকা আছে। ফলে তারা এখানে প্রস্তাবনা দিচ্ছে এবং অনুদান পাচ্ছে। জনগণের অর্থে এ ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অনুদান চলতে পারে না।'

সমাবেশে আলোচনা শেষে প্রতিবাদী গণসঙ্গীত ও ১০ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়।

দাবিগুলো হলো-

১। জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদানে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের জন্য পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

২। অনুদান নীতিমালায় ও প্রস্তাব আহ্বানকালে প্রামাণ্যচিত্রের উল্লেখ থাকলেও গত তিন বছর ধরে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রে কোন অনুদান দেওয়া হয়নি। কাহিনীচিত্রের সমপরিমাণ অর্থ ও সংখ্যা সাপেক্ষে প্রতি বছর প্রামাণ্যচিত্রে অনুদান নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও প্রামাণ্যচিত্রের জন্য পৃথক জুরি বোর্ড গঠন করতে হবে, যার সদস্যগণ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা/প্রযোজক/শিক্ষক অথবা দীর্ঘসময় প্রামাণ্যচিত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি হতে হবে।

৩। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার আশঙ্কাজনক হারে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অনুদানের সংখ্যা কমে গেছে।  প্রতিবছর নূন্যতম ২০ টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অনুদান প্রদান এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য ১৫-৪০ মিনিট সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে।

৪। নির্মাতার উপর অপ্রয়োজনীয় বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। যেহেতু এফডিসির বাইরেও কারিগরি সহায়তার সুযোগ আছে, তাই এফডিসির কারিগরি সরঞ্জাম ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা লোপ করতে হবে। এছাড়াও এফডিসির এবং অন্য কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন: পরিচালক সমিতি ও প্রযোজক সমিতি প্রভৃতির ছাড়পত্র গ্রহণের বাধ্যবাধকতা লোপ করতে হবে।

৫। চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নির্মাতাকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিতে হবে। এজন্য ১ম কিস্তিতে প্রোডাকশন খরচের সম্পূর্ণ অর্থ (প্রদানকৃত অনুদানের নূন্যতম ৬০ ভাগ) প্রদানের নিময় চালু করতে হবে, মেন্টর পদ্ধতি বিলোপ করতে হবে, চলচ্চিত্রের নির্মাণকালের সময়সীমা বৃদ্ধি করতে হবে।

৬। নির্মিত চলচ্চিত্র সিনেমা হলে মুক্তির দায় প্রযোজককে না দিয়ে চলচ্চিত্রের প্রদর্শনের ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।

৭। অনুদান প্রদানের জন্য স্বতন্ত্র বোর্ড/দপ্তর গঠন করে বাছাই কমিটি, অনুদান কমিটি ও প্রিভিউ কমিটিতে যোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত এবং এই প্রক্রিয়াগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। অনুদান সংশ্লিষ্ট মিটিং/প্রিভিউ মন্ত্রণালয়ের বাইরে উক্ত বোর্ডে কিংবা তথ্য ভবনে করার উদ্যোগ নিতে হবে।

৮। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে অনুদান নীতিমালার সংশোধন করতে হবে এবং মন্ত্রণালয়কে নীতিমালা মেনে চলতে হবে।

৯। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে অনুদান প্রদানের চুক্তিপত্রে বিদ্যমান শর্তাবলী সংশোধন করতে হবে।

১০। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর বাছাইকৃত প্রস্তাবকদের সাথে সাক্ষাৎকার গ্রহণ রীতি চালু ও তার ফলাফল প্রকাশ করতে হবে।

এ সমাবেশে একাত্মতা প্রকাশ করেছে- বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট প্রাক্তনী সংসদ, বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম, বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ, বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট অ্যালামনাই এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ এলামনাই এসোসিয়েশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটি, জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ (জাবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সিনে সোসাইটি, চলচ্চিত্র আন্দোলন (জাবি), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম ক্লাব, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি ক্লাব, ঢাকা চলচ্চিত্র আন্দোলন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র, বরেন্দ্র ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটি, ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম ক্লাব, খুলনা ফিল্ম সোসাইটি, সিলেট ফিল্ম সোসাইটি, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, চোখ ফিল্ম সোসাইটি (শাবিপ্রবি), শ্রীমঙ্গল চলচ্চিত্র সংসদ, কাকতাড়ুয়া (স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন), কীর্তনখোলা ফিল্ম সোসাইটি (ববি), হীরালাল সেন চলচ্চিত্র কেন্দ্র, টাঙ্গাইল চলচ্চিত্র সংসদ, এনলিভেন সিনেমা ক্লাব, টরেন্টো ফিল্ম ফোরাম,স্ট্যামফোর্ড ফিল্ম ফোরাম এবং  ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া। 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

17h ago