প্রশ্নপত্র ফাঁস যখন ‘মানবীয় ভুল’

অধ্যাপক আবুল বারকাত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির

গত ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংকের কর্মকর্তা (ক্যাশ) নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠলে শুরুতে তা অস্বীকার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ওইদিন বেলা ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ১ হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন চাকরিপ্রত্যাশী। বাংলাদেশ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় পরীক্ষাটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।

পরে প্রশ্নফাঁস হওয়ার প্রমাণ সামনে আসার পরিপ্রেক্ষিতেই ৬ নভেম্বরের পরীক্ষা বাতিলের পাশাপাশি আরও একাধিক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এ ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটিকে কেন কালো তালিকাভুক্ত করা হবে না, তার ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে চিঠি দেয় ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি।

চিঠির জবাবে আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ প্রশ্নফাঁসের ঘটনাটিকে অভিহিত করেছে 'মানবীয় ভুল' হিসেবে। বিপরীতে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে জালিয়াত চক্রের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্বেগজনক খবর আসছে গণমাধ্যমে।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যেসব মৃদু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা কি লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থীর উৎকণ্ঠা কমাতে পারবে? এর সমাধান তাহলে কোথায়?

এসব কিছু নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত এবং ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে।

এ ব্যাপারে প্রথমেই নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন অধ্যাপক আবুল বারকাত। যিনি ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, 'আমি একটা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলাম। ২০০৯ থেকে ২০১৪। ওই ৫ বছরে অন্তত ৫ হাজার লোকের চাকরি হয়েছে। তখন তো প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রশ্ন আসেনি। তাহলে এখন এটা হচ্ছে কেন?'

তার মতে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের 'আসল উৎসে' কেউ হাত দিচ্ছে না। তিনি বলেন, 'এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে কেবল সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যখন এটা হয়নি, সেটা কেন অনুসন্ধান করা হচ্ছে না?'

এ পর্যায়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই সভাপতি। বলেন, 'ব্যাংকগুলো যখন পরীক্ষার জন্য কাউকে হায়ার করে তখন শুরুতে পত্রিকায় অ্যাড দেওয়া হয়। সেই অ্যাডের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু অর্গানাইজেশন রেসপন্স করে। কোথাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স ফ্যাকাল্টি করে, কোথাও আইবিএ করে, অর্থনীতি বিভাগ করে, বুয়েট করে, আহছানউল্লা করে। পাবলিক প্রক্রিওরমেন্ট রুলস অনুসারে যারা সবচেয়ে কম মূল্যে কাজটা সম্পাদন করতে পারবে তারাই কাজটি পায়।'

তার ভাষ্য, 'দুনিয়ার সবকিছু লোয়েস্ট দিয়ে হয় না। আপনি যদি মনে করেন আমি লো কস্টে ভালো প্রাইমারি এডুকেশন দেবো- ইটস অ্যা রং মেসেজ।'

তাই ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষার ব্যবস্থাপনার জন্য যোগ্য প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, 'আপনি খুঁজে বের করেন। ভাগনে মামা চাচা এগুলো বাদ দেন। কোয়ালিটি প্রডিউস যারা করতে পারে তাদের দায়িত্ব দেন। সিরিয়াস লোকদের দেন।'

'আমি যতটুকু জানি আহছানউল্লা লো কস্ট বিড করে। তাহলে লো কস্ট কোয়ালিটিই পাবেন। সব চোর-ডাকাতগুলো পাবেন। তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে যে যার মতো আয়-ব্যয় করবেন।'

এ ছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়া তদারকির দায়িত্ব স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়ার পরামর্শও দেন এই অর্থনীতিবিদ। বলেন, 'ব্যাবস্থাপনাসহ ব্যাংকের বোর্ডকে সব দায়িত্ব দিয়ে দেন। শর্ত থাকবে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে বোর্ড, ম্যানেজমেন্ট সব ফায়ার হয়ে যাবে। তাহলে দেখেন প্রশ্নপত্র কোথায় ফাঁস হয়? কোথাও হবে না।'

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, 'এসবে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন? সব ব্যাংকের ওপরে রেগুলেটর হিসেবে বসে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেটর কে?'

'যার কাজ তাকে সব দায়-দায়িত্ব দেন। রেসপনসিবিলিটি দেন। অথরিটি দেন। অ্যাকাউনটেবল করেন।'

এদিকে প্রশ্নফাঁসের জন্য আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটিকে কেন কালো তালিকাভুক্ত করা হবে না, তার ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠানো ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির চিঠির জবাব দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে সিলেকশন কমিটির সদস্য ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তারা (আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ) এটাকে মানবীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। তারা এটাকে অর্গানাইজ ক্রাইম বলতে রাজি না। এখন তাদের এই বক্তব্য কতটা যুক্তিগ্রাহ্য, কতটা সত্য কিংবা মিথ্যা সেটা দেখার দায়িত্ব ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির। এটা আমরা এফোর্ড করতে পারব না। কারণ সেই ক্যাপাবিলিটি, ম্যানেজমেন্ট আমাদের নেই।'

চিঠির জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে এখন আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির বলেন, 'একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে। পিপিআর অ্যাক্টের আওতায়। এখন তাদের বহাল রাখা বা বাদ দেওয়া আমরা যাই করি- একটা লিগ্যাল প্রসিডিংসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যাতে কোনো ফাঁকফোকর থেকে না যায়। এর জন্য আমাদের যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ দরকার। আমরা কর্তৃপক্ষের (গোয়েন্দা সংস্থা) কাছ থেকে এমনটাই প্রত্যাশা করব, যাতে আমরা তাদের ফাইন্ডিংসগুলো ফরমাল ওয়েতে পেতে পারি।'

কালো তালিকাভুক্তির বাইরে আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে কিনা জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, 'এটা এখন বলতে পারছি না। আমরা ওভারঅল বিষয়টাকে তুলে আনব। বাকিটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যাপার।'

Comments

The Daily Star  | English
gold price hike in Bangladesh

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori in Bangladesh, compared to $1,189 in India, $1,137 in Dubai

2h ago