পাপের শহরে
সম্প্রচার দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শো দ্য ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রডকাস্টারস বা এনএবি-তে যোগ দিতে লাসভেগাসে গিয়েছিলেন সম্প্রচার পেশায় থাকা গণমাধ্যম কর্মী মাসুদ মারফি। সম্মেলন শেষে ঘুরেছেন লাসভেগাস। জানার চেষ্টা করেছেন এই পাপের শহরের হালহদিস।
এ
নএবি (দ্য ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রডকাস্টারস) শো ব্রডকাস্ট দুনিয়ার সর্ববৃহৎ বার্ষিক সম্মেলন এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রযুক্তির এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী। পেশাদার প্রযুক্তিবিদ এবং সম্প্রচার শিল্পের সঙ্গে জড়িত সব মাধ্যমের সৃজনশীল মানুষদের এক মহাসমাবেশ। এটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এবং ভোক্তা চাহিদার সমন্বিত এক মিলনমেলা; এখানে প্রদর্শিত নতুন নতুন গবেষণালব্ধ উদ্ভাবন ও এর ব্যবহার সম্প্রচার শিল্পকে নিয়ে গেছে অনন্য মাত্রায়।
তথ্য ও সম্প্রচার দুনিয়ার সর্ববৃহৎ এই কনভেনশনে ১৮৭৪টি কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব ছিল এবার। আর ১০৬৩৩৮০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে ছিল এই আয়োজন, যা প্রায় ৩৩টি ফুটবল মাঠের সমান। এই প্রদর্শনীতে দেখেছি নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কী করে প্রযুক্তি তার বহুমাত্রিক প্রভাব বিস্তার করেছে। আরো দেখেছি মিডিয়া কী করে প্রযুক্তিকে তার সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। অপরদিকে প্রযুক্তি কী করে অগ্রসর ও প্রতিযোগিতামূলক মিডিয়াকে সুনিপুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিভিন্ন সেমিনার ও সম্প্রচার মাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তাদের প্রযুক্তি ভাবনা, যা আমাদের দেশের ক্রমবিকাশমান মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির জন্য অত্যাবশ্যক। আর আয়োজকদের ভাষায় এনএবি-শো ভোক্তা, পরিবেশক ও বহুমুখী সৃজনশীল মানুষদের জন্য অবশ্যম্ভাবী এক প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে।
‘হোয়্যার কনটেন্ট কামস টু লাইফ’Ñ এই স্লোগানে ১৯২৩ সালে শুরু হওয়া এই কনফারেন্সের এবার ছিল ৯৩তম আয়োজন। সম্মেলনস্থল লাসভেগাস কনভেনশন সেন্টারে ১৬-২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হল এবারের এনএবি শো-২০১৬। সারা দুনিয়ার ১৮৭ দেশ থেকে আসা ১,০৩,০১২ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে আমিও ছিলাম এই আয়োজনের একজন হিসেবে। এই সম্মেলন উপলক্ষে এখানে আগমন ও পরিচয় সিন সিটি লাসভেগাসের সঙ্গে। যে ক’দিন ছিলাম, সম্মেলন শেষ করে জানার চেষ্টা করেছি এই শহরের ইতিকথা, বোঝার চেষ্টা করছি এই পাপের শহরের শানে নযুল।
দিনের বেলা দ্রুত তাপ গ্রহণ করে উত্তপ্ত হয়ে রাতেই আবার সেই উত্তাপ হারিয়ে ঠা-া হয়ে যাওয়া মরুভূমির মাঝে গড়ে ওঠা শহর লাস্যময়ী লাসভেগাসের বহুল প্রচলিত স্লোগান ‘হোয়াট হ্যাপেনস ইন লাসভেগাস, স্টেজ ইন ভেগাস’Ñ মানে ভেগাসে যা ঘটবে তা শুধু ভেগাসেই থাকবে। বাইরে যাবে না, বাইরের কেউ জানবে না।
আমেরিকার নেভাদা প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে লাসভেগাসের অবস্থান। ১৯০৫ সালে এই শহরের জন্ম হলেও নগরের মর্যাদা পায় ১৯১১-তে। মরুভূমির মধ্যে যে এ রকম একটা আধুনিক শহর গড়ে উঠতে পারে, তা ভেবে অবাকও হয়েছি যথেষ্ট! মোহাভি মরুভূমির একটা অংশে এই শহরটি গড়ে উঠছে। এখান থেকেই দূরের পাহাড় শ্রেণি দেখা যায়। শীতকালে আশপাশের পাহাড়ে বরফ পড়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দু’হাজার ফুট ওপরে এই মরুশহর। আয়তন প্রায় ৩৫২ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু আয়তনের অনুপাতে লোকসংখ্যা অনেক কম!
লাসভেগাসকে মনোরঞ্জনের রাজধানী বলাই যেতে পারে! কেননা, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে পর্যটকরা এখানে শুধু মনোরঞ্জনের জন্যই আসেন প্রতি বছর। সবসময়ে ভিড় তাই লেগেই থাকে।
মূলত এখানকার হোটেলগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে চিত্তবিনোদন তথা আমোদ-প্রমোদের রাজধানী লাসভেগাসের আনন্দ বাণিজ্য। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ২৫টি হোটেলের ১৮টিই এই লাসভেগাসে। প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ খেলে চলেছে লাখ লাখ ডলারের জুয়া। এই ক্যাসিনোগুলোতে সময় দেখার জন্য কোনো ঘড়ি থাকে না, থাকে না বাইরের আলো আসার কোনো ব্যবস্থা। কিন্তু আলো না থাকলে কী হবে, অন্ধকারের ভিড়
ঠেলে ঠিকই চলে আসে ফ্রি অ্যালকোহল। উদ্দেশ্য একটাই, জুয়ার টেবিল কিংবা স্লট মেশিনে বসে যেন দিন-রাতের হিসাব না থাকে। নিঠুর ছলনায় নিঃস্ব করার কি সুনিপুণ আয়োজন! শুধু হোটেল বা ক্যাসিনো নয়, এই শহরের এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে গ্যাস স্টেশন, সুপার মার্কেট থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ সব জায়গাতেই সাজানো স্লট মেশিন। সিকিউরিটির কোনো অভাব নেই। দুনিয়া ভুলে খেলারাম খেলে যা, কেউ বিরক্ত করবে না আপনাকে।
বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষেরা ধ্যানমগ্ন হয়ে জুয়া খেলছে দিন-রাত। মধ্যবয়সী জুয়াড়িদের দেখলেই মনে হয় এরা অনেক পরিণত ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলছে। বুড়োবুড়িদের দেখেছি খুব সামলে খেলতে, ছোট ছোট বেট নিয়ে টুক টুক করে খেলে। আর অল্প বয়সীরা খেলে লাগামছাড়া।
সারা দুনিয়ার অনেক বড় বড় মাফিয়া ডনদের আস্তানা এই শহর। কারণ এখানকার ক্যাসিনোগুলো থেকে প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন কৃষ্ণ মুদ্রা রাতারাতি শুভ্র আর হালাল হয়ে ওঠে। আসন্ন আমেরিকান নির্বাচনে রিপাবলিকান মনোনীত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান কিন্তু ক্যাসিনো ব্যবসা থেকেই। জীবন থেকে হারিয়ে যেতে চাইলে পকেট ভর্তি ডলার নিয়ে চলে আসেন, সিন সিটিতে স্বর্গের দেখা পেয়ে যাবেন।
লাসভেগাসের বেশিরভাগ নামী-দামি হোটেলগুলো যে রাস্তায় অবস্থিত তার নাম লাসভেগাস বুলেভার্ড। রাতের বেলা এই স্ট্রিপ কৃত্রিম আলোর ছটায় এত বেশি আলোকিত থাকে যে মহাকাশ থেকে দেখতে পাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে আলোকিত জায়গা যে এই স্ট্রিপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এক একটা হোটেল আয়তনে বড় ফুটবল মাঠের মতো। যেমন উঁচু, তেমনই তার গঠনশৈলী। এমন বিশাল বিশাল হোটেলের সমারোহ কোনো দিন দেখিনি! প্রতিটি হোটেল তৈরি করতে যে কত কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই! সাত থেকে মোটামুটি ১০তলা একটা হোটেল ঘুরে দেখতে দু’তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। আর এখানে হোটেলই আছে কয়েকশ’। যে কোনো হোটেলেই পর্যটকরা অবাধে ঘুরতে পারেন। হোটেলের নামগুলোও বেশ বিচিত্রÑ বেলাজিও, সার্কাস সার্কাস, নিউইয়র্ক, প্যারিস, লুক্সর, সিজার প্যালেস প্রভৃতি।
জৌলুসের রকমভেদ যে কত প্রকার হতে পারে তার সর্বোত্তম নিদর্শন এই হোটেলগুলো। তার ওপর আছে চমৎকার রুচিশীলতা। এছাড়া নির্মাণশৈলীর প্রশংসা না করে উপায় নেই। ৫ তারা বা ৭ তারা মানের হোটেলগুলো নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন থিমকে ঘিরে। কোনোটা নিউইয়র্কের, কোনোটা প্যারিস, আবার কোনোটা মিসরের ফারাও রাজাদের কেন্দ্র করে নির্মিত। ভেনিস শহরের নামে নামকরণ করা হোটেল ভেনিসিয়ার চারপাশে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম জলপথ।
একসময়কার সর্বাধিক দামি হোটেল, এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম হোটেল বেলাজিও বিখ্যাত একটি হোটেল। ভেতরে অদ্ভুত সুন্দর ডেকোরেশন করা বিভিন্ন ছোটখাটো দর্শনীয় জিনিস নিয়ে তৈরি। এক জায়গায় ছোট একটি শহরের মডেল তৈরি করা আছে। আরেক জায়গায় দেখলাম ছাদের ওপর কাচের তৈরি কচুরিপাতার মতো লাল-নীল বিভিন্ন রঙের ডেকোরেশন। হোটেলটা অনেক বড় আর সমস্ত হোটেল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে শপিং মল, ক্যাসিনো, বার, খাবারের দোকান, পার্টি সেন্টার ইত্যাদি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো হোটেলের সামনের লেক। অদ্ভুত সুন্দর এই লেকে রাতের বেলায় ফাউনটেইন ড্যান্স হয়। বিভিন্ন গানের তালে তালে ঝরনাগুলো নাচতে থাকে। হোটেল এমজিএমের মূল থিম হল সিংহ; আর তাই বিভিন্ন সিংহতোরণ দেখা যায় এর বাইরে এবং ভেতরে।
হোটেল মিরাজের থিম আফ্রিকা। এর সামনের লেকে ডলফিনের প্রতিকৃতি দেখা যায়। ভেতরে আছে হোয়াইট লায়ন আর হোয়াইট টাইগারের খাঁচা, রেইন ফরেস্ট, অ্যাকুয়ারিয়াম ইত্যাদি। প্রতি সন্ধ্যায় ভলকানো শো নামে এর লেকের পানিতে আগুনের ভেল্কিবাজি শো হয়।
হোটেল ট্রেজার আইল্যান্ড তৈরি হয়েছে বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস ট্রেজার আইল্যান্ডের থিমের ওপর ভিত্তি করে। হোটেল মিরাজের সিস্টার হোটেল এটি, তাই এই দুই হোটেলের মধ্যে ট্রাম আছে এপার-ওপার করার জন্য। হোটেল ট্রেজার আইল্যান্ডের ভেতরকার থিম দেখে মনে হবে আপনি সেই ট্রেজার আইল্যান্ডের ভেতরেই আছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় এবং সাড়ে ৮টায় দুটো নাট্যাংশ অভিনীত হয় হোটেলের লেকের সামনে, কল অভ ট্রেজার আইল্যান্ড নামে।
সিজারস প্যালেস হোটেল সিজারদের সময়কার থিমে তৈরি। অসাধারণ সব শিল্পকর্ম দিয়ে সাজানো এই হোটেলের ভেতর ঢুকলে মনে হয় রোমে চলে এসেছি। এক জায়গায় ট্রয়ের ঘোড়াটাও দেখতে পেলাম।
কোনো হোটেলের ভেতরে রয়েছে কৃত্রিম পাহাড়, গুহা, ঝরনা, সাজানো বাগান। কোথাও আবার নানা রকমের পাখি, সারস কৃত্রিম লেকের জলে তারা ভিড় করেছে। কোনো হোটেলের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম নীল-সাদা রঙের আকাশ আর মেঘ। মনে হয়, আকাশের খুব নিচেই যেন আমরা রয়েছি! একটা হোটেলের মধ্যে দেখেছি কৃত্রিম ক্যানাল। এঁকেবেঁকে অনেক দূর পর্যন্ত গেছে। আর তার ওপর দিয়েই চলেছে সুদৃশ্য গন্ডোলা। অনেকেই তাতে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতিটিতে দু’জন করে চালক আছেন। তাদের পরনে জমকালো পোশাক। কোনো হোটেলে রয়েছে বিশাল বিশাল অ্যাকুয়ারিয়াম। নানা রকমের এবং আকৃতির মাছ সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ভেগাস আসলে গ্যাম্বলিংয়ের রাজধানী; জুয়ার জান্নাত। এখানকার শ্রেষ্ঠ ক্যাসিনোগুলোতে রয়েছে নানা ধরনের গ্যাম্বলিং প্রচলিতÑ স্লটস, রুলে, ব্ল্যাক জ্যাক থেকে শুরু করে ভিডিও হর্স রেসিংও। এক সেন্ট থেকে যে কোনো মূল্যের বেটিংয়ের সুযোগ আছে এখানে। মায়াবি আলো,
বাতানুকূল সুরম্য কক্ষের আহ্বান, লাস্যময়ী নারীদের সান্নিধ্য, অবারিত মদিরার আয়োজন, আদিম রিপুর আবেশে বয়ে চলে সময়। রাত ছাড়িয়ে ভোর হয়ে যায়। এই মায়ানগর বয়ে চলে নিজের ছলনাময়ী খেয়ালে!
সন্ধ্যে নামতেই ভেগাসের চেহারা বদলাতে থাকে। রকমারি আলোয় হোটেলগুলো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। রাস্তার দু’পাশে বড় বাতিস্তম্ভগুলো নানা রকম বিজ্ঞাপনের মোড়কে চমকাতে থাকে। মাইলের পর মাইল চোখ জুড়ানো আলোর বন্যা। প্রতিটা হোটেলের সামনেই নানা রকম আলোর বাহার। কোনো কোনো হোটেলের সামনে বিশাল জলাশয়ের মধ্যে আবার কৃত্রিম ঝরনা! তার ওপর বিভিন্ন রঙের আলোর বিচ্ছুরণে এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি হয়! কোনো হোটেলে রয়েছে সুদৃশ্য লেজার রশ্মির শো। কোথাওবা বাচ্চাদের জন্য আছে নানা রকমের রাইড। দেখে মনে হয় যেন কোনো মেলায় এসে হাজির হয়েছি। কোনো হোটেলে আছে সার্কাস দেখানোর ব্যবস্থাও।
আমেরিকার কোনো ছোট্ট একটি শহরের হোটেল ভাড়া রাত প্রতি প্রায় একশ’ ডলার অথচ লাসভেগাসের অনেক হোটেল আপনি অনায়াসে পেয়ে যাবেন পঞ্চাশ-ষাট ডলারের মধ্যেই। কারণ হোটেলগুলোর আয়ের অন্যতম উৎস তাদের ক্যাসিনো। তাই হোটেল ভাড়া থেকে তাদের বিজনেস না করলেও ক্ষতি নেই। হোটেলগুলোর আয়ের আরেকটা উৎস লাইভ শো। ডেভিড কপারফিল্ড, ব্রিটনি স্পিয়ার্স, এলটন জন, সেলিন ডিয়নের মতো তারকারা রীতিমতো আস্তানা গেড়ে বসেছেন এখানে। একশ’-দুশ’ ডলার একেকটা শোর টিকেট মূল্য।
ভেগাসের রাস্তাঘাট সবসময়ই প্রাণবন্ত। সবাই আনন্দের মুডে থাকে। ফুটপাথে হাঁটতে থাকলে কিছুদূর পরপর দেখা যাবে হাত বাড়িয়ে লিফলেট, কার্ড বিলি করে বেড়াচ্ছে। একটা কার্ড হাতে নিয়ে চোখ বোলাতেই দেখি নাউজুবিল্লাহ। ছবিসহ ফোন নম্বর দেয়া। প্রতিরাতে মাত্র একশ’ টাকা গুনলেই অপ্সরা, কিন্নরিরা চলে আসবে রুমে।
ছাদ খোলা ট্যুরিস্ট বাসে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল সারি সারি ওয়েডিং ক্যাসেল। গাইড জানালো, ঝামেলাবিহীন বিয়ে করতে চান? তো চলে আসুন লাসভেগাসে। তাই প্রতিদিন প্রায় এক থেকে দেড়শ’ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই শহরে। আমেরিকার নানান প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এখানে কেবল বিয়ে করতে। এখানে এসে সত্যিই মনে হবে বিয়ে করা জিনিসটা পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ। শুধু ফটো আইডি আর পকেটে সত্তর ডলার থাকলেই হবে। নিমিষেই বদলে ফেলতে পারবেন আপনার ফেসবুকের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস।
বিখ্যাত জাদুঘরগুলোর কথা বলতে গিয়ে মাদাম তুসোর জাদুঘরের নাম চলে আসবে এমনটাই তো স্বাভাবিক। মাদাম তুসোর মোমের প্রতিমূর্তির জাদুঘর সম্পর্কে সবার কম-বেশি ধারণা আছে নিশ্চয়ই। বিখ্যাত সেলিব্রিটিদের অবিকল মোমের প্রতিমূর্তি বানিয়ে রাখা হয় এই জাদুঘরে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ পর্যটকের ভিড় লেগে থাকে এই রোমাঞ্চকর জাদুর দরবারটি একবার ঘুরে দেখতে। মাদাম ম্যারি তুসো নামীয় এক ফরাসি মহিলা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সংগ্রহশালাই পরবর্তীকালে মাদাম তুসো জাদুঘর নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত শহরগুলোতে আছে এই জাদুঘর। আমেরিকার লাসভেগাস ছাড়াও আছেÑ হলিউড, নিউইয়র্ক আর ওয়াশিংটনে। ইউরোপে আছে আমস্টারডাম, বার্লিন, ব্ল্যাকপোল, লন্ডন আর ভিয়েনাতে। এশিয়ায় আছে ব্যাঙ্কক, হংকং, টোকিও আর সাংহাই শহরে। অস্ট্রেলিয়াতে পাবেন সিডনিতে। একদিন ঢুঁ মারলাম মাদাম তুসোর জাদুঘরে। বিভিন্ন সেলিব্রিটি মডেলের সঙ্গে মনের সাধ মিটিয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুললাম। শুনলাম এই জাদুঘরের বেশ মজার কিছু তথ্য :
* এই জাদুঘরে রক্ষিত মোমের মূর্তিগুলোর মাথায় প্রতিটি চুল পৃথকভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়। একটি মূর্তির মাথায় চুল প্রতিস্থাপন করতে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ সময় লাগে।
* জাদুঘর খোলার আগে প্রতিদিন দুটি রক্ষণাবেক্ষণ দল মূর্তিগুলো দেখভাল ও পরিপাটি করে থাকে।
* একজন ব্যক্তিত্বের মূর্তি বানানো সম্পূর্ণ করতে প্রায় চার মাস সময় লাগে।
* মোমের মূর্তি বানাতে প্রায় ২৫০ বার শরীরের মাপ নিতে হয় এবং বিভিন্ন কোণ থেকে প্রায় ১৮০টি ছবি তুলতে হয়। এ ক্ষেত্রে যদি ওই ব্যক্তিত্ব অনুপস্থিত থাকেন, তবে জাদুঘরের স্টুডিও ভাস্কর তার কয়েকশ’ ছবি আর ভিডিও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে এটি বানান।
* মোম ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়, তাই মোমের মূর্তি সেলিব্রিটির শরীর থেকে প্রায় দুই শতাংশ বড় করে বানানো হয়।
* লাল সিল্কের সুতা দিয়ে মূর্তিগুলোর অক্ষিগোলকের শিরা বানানো হয়।
* পরিচর্যার অংশ হিসেবে নিয়মিত মূর্তিগুলোর চুল ধোয়া ও মেকআপ করা হয়।
* প্রতিটি মূর্তি বানাতে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার খরচ হয়।
ভেগাসের যেখানেই গিয়েছি, শুধুই সুদৃশ্য হোটেলের ছড়াছড়ি। বেশির ভাগ বড় হোটেলগুলো মূল রাস্তার দু’পাশে। ওই রাস্তা ধরে প্রায় চার মাইল এগোলেই ডাউনটাউন এলাকা। আরো জমজমাট সেই জায়গা। হোটেল আর রেস্তোরাঁর প্রতিযোগিতা লেগেছে যেন এখানে! প্রত্যেকটাই অপরূপভাবে সাজানো। এত গরমের মধ্যেও কী রকম প্রাণবন্ত সব!
এক রাতে ফ্রিমন্ট স্ট্রিটে ঘুরছিলাম। সেটা ডাউনটাউনে। অত রাতেও সেখানে মানুষের প্রচুর ভিড়! চারদিকে জমজমাট আলো। প্রায় ৩০০ মিটার লম্বা রাস্তার পুরোটাই আচ্ছাদনে ঢাকা। তিলধারণের জায়গা নেই। প্রত্যেকেরই চোখ ওপরের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে লেজার রশ্মির চোখ ধাঁধানো খেলা শুরু হলো। নানা রকমের দৃশ্য বিভিন্ন বর্ণের আলোর রশ্মিতে তৈরি হতে থাকে। আর সেই সঙ্গে রক সংগীতের ব্যঞ্জনা। প্রতি আধাঘণ্টা অন্তর এই শো দেখানোর ব্যবস্থা আছে।
ফেরার সময় মনে হলো লাস্যময়ী সুন্দরী ভেগাস যেন আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলছে, মাত্র কয়েকটা দিন আমার কাছে থাকলে? কতটুকুইবা জানলে আমাকে!
ছবি : লেখক
Comments