গভীর সংকটে থাকা ফেসবুক কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?

ছবি: মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুক থেকে নেওয়া।

ফেসবুকের ১৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দৈনিক সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যা কমেছে। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শেষ ত্রৈমাসিকে ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৯২ কোটি ৯০ লাখ। এর আগের ত্রৈমাসিকে এই সংখ্যা ছিল ১৯৩ কোটি। অর্থাৎ ওই ৩ মাসে ১০ লাখ ব্যবহারকারী হারায় ফেসবুক।

এই খবরের প্রভাবে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মস ইনকরপোরেশনের শেয়ারের দাম কমে যায়। একদিনে ২৯ বিলিয়ন ডলার হারান সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ। একইসঙ্গে তিনি ছিটকে যান বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনী ব্যাক্তির তালিকা থেকে।

তবে ফেসবুকের জন্য এ ধরনের সংকট এবারই প্রথম নয়।

২০১২ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আগে ফেসবুক বেশ ঝামেলায় ছিল। তাদের রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার ধীর হয়ে আসছিল, পরিচালন ব্যয়ও বাড়ছিল। গ্রাহকদের স্মার্টফোন ও অন্যান্য মোবাইল ডিভাইসে ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ানোর সময়টাতে তারা প্রতিযোগী প্ল্যাটফর্মগুলোর তুলনায় বেশ পিছিয়ে ছিল।

তবে ২ বছরের মধ্যে ফেসবুক ঘুরে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালের প্রথম ৩ মাসে তার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তাদের রাজস্ব ৭২ শতাংশ বাড়ে। সবচেয়ে আগে মোবাইল বা 'মোবাইল ফার্স্ট' দর্শনকে আঁকড়ে ধরার পর তাদের মুনাফাও বেড়ে যায় ৩ গুণ।

সম্প্রতি ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তিত হয়ে 'মেটা' হয়েছে। তবে এখন আবারও ফেসবুক নিজেদের ১০ বছর আগের সেই একই ধরণের সংকটের মুখোমুখি দেখতে পাচ্ছে।  গত সপ্তাহে ফেসবুক জানায়, গত প্রান্তিকের তুলনায় তাদের এ প্রান্তিকে রাজস্ব কমে গেছে। গ্রাহক সংখ্যাও বাড়েনি। আর বছরের শুরুতে তাদের রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনাও খুব একটি ইতিবাচক নয়। যা ওয়াল স্ট্রিটসহ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছে।

ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাকারবার্গ ভার্চুয়াল ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি প্রযুক্তির সমন্বয় করছেন, যেটিকে তিনি নাম দিয়েছেন 'মেটাভার্স'। তিনি মেটাভার্সকে অভিহিত করেছেন 'মোবাইল ইন্টারনেটের উত্তরসূরি' হিসেবে।

তবে ১ দশক আগে যেভাবে মোবাইল প্রযুক্তি ফেসবুককে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেকাংশেই ভিন্ন। ২০১২ সালে মোবাইল ইন্টারনেটের গ্রহণযোগ্যতা আকাশচুম্বী না হলেও বেশ বড় পরিসরেই ছিল। ফেসবুককে নতুন করে কিছু বানাতে হয়নি। তারা শুধু সেখানে তাদের 'ঘাঁটি' তৈরি করেছে। তবে মেটাভার্সের ব্যাপারটা পুরোপুরি ভিন্ন। তারা ভাবছেন এখানে তারা পরাবাস্তবতার সুবিশাল জগত তৈরি করবেন।  যেখানে সবাই তাদের বন্ধুবান্ধব ও অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে ডিজিটাল এভাটারের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন। এটা মেটাভার্সের 'ভিশন'। তবে তার বাস্তবায়ন হতে এখনো অনেক বছর বাকি। 

২০১২ সালে মোবাইল প্ল্যাটফর্মে ফেসবুকের সেবা বিস্তৃত করতে খুব একটি সমস্যা হয়নি। কারণ, মানুষের হাতে কোটি কোটি হ্যান্ডসেট ছিল। এর বিপরীতে, ২০২১ সালে মেটাভার্স ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেটের বিশ্বব্যাপী বিক্রির প্রাক্কলিত সংখ্যা মাত্র ৯৪ লাখ। প্রযুক্তি বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিসি এ তথ্য দিয়েছে। ভিআর ও এআর (অগমেন্টেড রিয়েলিটি) প্রযুক্তিও এখনো প্রাথমিক অবস্থায় আছে।

ইতোমধ্যে, মেটা কিংবা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ফেসবুকের ব্যবসা বিভিন্ন দিক থেকে হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। এককালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মহীরুহ ফেসবুকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমছে। সেইসঙ্গে বর্তমান ব্যবহারকারীদেরও বয়স বাড়ছে। আইফোন নির্মাতা অ্যাপলের অপারেটিং সিস্টেমে সাম্প্রতিক গোপনীয়তার শর্ত পরিবর্তনের কারণে ফেসবুকের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস বিজ্ঞাপনের ওপর বড় আঘাত এসেছে। এছাড়াও, বেশ কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরে এসেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ওপর আরোপিত হয়েছে কিছু বিধিনিষেধ। এখন চাইলেও নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে অধিগ্রহণ করে রাতারাতি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ খোলা নেই মেটার সামনে।

মেটাভার্সের অনিশ্চিত যাত্রা

মেটাভার্সের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখার জন্য ফেসবুক অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেদের 'মেটা' নাম দিলেও অনেক বিশ্লেষকের মতে, কিছু প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান তাদের চেয়ে মেটাভার্সের বিবর্তনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

সিএফআরএ রিসার্চ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক অ্যাঞ্জেলো জাইনো অ্যাপলের পণ্য ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি  জনপ্রিয় সফটওয়্যার রোবলক্স অথবা টিকটক ও স্ন্যাপচ্যাটের অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ব্যবহারকারীদের মেটাভার্সের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার বেশি সম্ভাবনা দেখছেন।

ফেসবুককে আজকাল বয়স্ক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ভিআর ও এআর প্রযুক্তির সম্ভাব্য প্রারম্ভিক ব্যবহারকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বলেও  জানান জাইনো।

মেটাভার্সের চেয়ে বাস্তব জীবনের সমস্যা বেশি কঠিন!

গত বছর ফেসবুক তাদের নাম পরিবর্তন করার সময় অনেক বিশ্লেষক মত প্রকাশ করেন, এটি ফেসবুকের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সমস্যা থেকে নজর সরানোর প্রচেষ্টা। সম্প্রতি প্রকাশিত আর্থিক বিবরণীতে এটি স্পষ্ট যে, আর্থিক সমস্যা ফেসবুককে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রভাবিত করছে।

অ্যাপলের আইওএসের ১৪ দশমিক ৫ আপডেট মোটামুটি এক ধাক্কায় আইফোন ও আইপ্যাড ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আসা অর্থকে অনিশ্চিত করে দিয়েছে। ফেসবুকের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা ডেভ ওয়েনারের পূর্বাভাস, ২০২২ সালে এ ধাক্কার খেসারত ১০ বিলিয়ন ডলারে দাাঁড়াতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, ফেসবুকের নতুন ব্যবহারকারী খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। টিকটকের মত অ্যাপগুলো ফেসবুকের কাছ থেকে 'সময়' কেড়ে নিচ্ছে। ফেসবুকে একজন গ্রাহক যত বেশি সময় বা মেগাবাইট খরচ করেন, ততই বাড়তে থাকে ফেসবুকের বিজ্ঞাপন থেকে আয় করার সম্ভাবনা। তবে এ সময়টা এখন চলে যাচ্ছে অন্য অ্যাপে, যার ছাপ পড়েছে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে।

ইতোমধ্যে ৩০০ কোটি গ্রাহক থাকায় ফেসবুকের হাতে এখন আর নতুন গ্রাহক সংগ্রহের জন্য যথেষ্ঠ 'মানুষ' নেই।

টিকটকের সঙ্গে পাল্লা দিতে মেটা বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছে যে, তারা 'ইন্সটাগ্রাম রিলস' এর দিকে বিশেষ নজর দেবে। গঠনগত দিক থেকে টিকটকের সঙ্গে এর তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তবে মেটার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফেসবুক রিলস থেকে অর্থ উপার্জন খুব একটা সহজ নয় এবং ফেসবুকের অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী ব্যবহারকারীদের কাছে এই সেবার গ্রহণযোগ্যতা কেমন হবে, সেটা নিয়েও তারা সন্দিহান।

২০১২ সালে এই ধরনের পরিস্থিতিতে ফেসবুক ইন্সটাগ্রাম অধিগ্রহণ করে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। ২০১৩ সালে তারা স্ন্যাপচ্যাট কেনার চেষ্টা চালায়। কিন্তু এখন আর সেরকম পরিস্থিতি নেই। এই মুহূর্তে মেটা ইন্সটাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণ সংক্রান্ত অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা লড়ছে। যদিও এই দুই প্ল্যাটফর্ম অনেক আগে থেকেই মেটার অংশ।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ২০১২ সালে ফেসবুক যত সহজে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল,  ১০ বছর পরে এসে সে পরিস্থিতি অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে অনেক বেশি সংখ্যক অনুঘটক যুক্ত হয়েছে। জাকারবার্গ যত সহজে মেটাভার্সের সাফল্যের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, বাস্তবতা তার থেকে এখন অনেকটাই ভিন্ন।

এত কিছুর পরেও প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। পাশাপাশি নগদ ৪৮ বিলিয়ন ডলার, ক্যাশ ইকুইভ্যালেন্ট ও মার্কেটেবল সিকিউরিটি নিয়ে বছর শেষ করেছে।

সুতরাং, এখনই মেটাকে বাতিলের খাতায় ফেলতেও রাজি নন বিশ্লেষকরা।

Comments

The Daily Star  | English
Banking sector crisis

Why is the banking sector crisis so deep-rooted?

The regime-sponsored immorality to protect or pamper the financial gangsters not only eroded the future of the banking sector, but also made the wound too difficult to recover from.

5h ago