মুদ্রানীতি প্রণয়নে জটিলতায় বাংলাদেশ ব্যাংক
অতিরিক্ত তারল্য ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বর্তমান অর্থবছরের আর্থিক মুদ্রানীতি তৈরিতে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত বছরের মার্চে দেশের করোনার সংক্রমণ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথাগত মুদ্রানীতির বাইরে গিয়ে একটি অপ্রথাগত নীতিমালা গ্রহণ করেছিল। একইসঙ্গে পলিসি রেট ও ক্যাশ রিজার্ভের অনুপাতটিকে (সিআরআর) পর্যায়ক্রমে কমায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেন বাজারে আরও তারল্য আসে এবং অর্থনীতির চাকা ঘুরতে থাকে।
এই সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির কারণে টাকার মূল্য অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় কমে এসেছে। এছাড়াও, বাংলাদেশ ব্যাংক মহামারিতে সৃষ্ট মন্দা মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বড় আকারের নগদ টাকা সরবরাহ করেছে।
এখন বাংলাদেশ ব্যাংক আরও একটি সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে, যেটি আগামীকাল উন্মোচিত হতে পারে।
তবে, এক্ষেত্রে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণের পাশাপাশি কীভাবে অতিরিক্ত তারল্য থেকে সৃষ্ট ঝুঁকি কমানো যা, সে বিষয় প্রশ্ন উঠেছে।
সরকার করোনা মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বারবার চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় এই অপ্রথাগত নীতিমালা প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করেনি।
যেহেতু মহামারির বিরূপ প্রভাব এখনো চলছে, তাই তহবিল সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনো ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এই মুহূর্তে কার্যকর থাকা মুদ্রানীতি অপরিবর্তিত রেখে দিতে চায়, সেক্ষেত্রে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আরও তারল্যের সৃষ্টি হবে।
নীতিমালা তৈরির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তারা এখনো এই সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও অতিরিক্ত তারল্য সংকটের মধ্যে একটি সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করছেন।
তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ৬৬ শতাংশ ও গত মাসের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি।
এই ধারাটির পেছনে দায়ী মূলত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির দুর্বল অবস্থা। এক্ষেত্রে গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে আট দশমিক ৪০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতিমালা বজায় রাখা। একই সঙ্গে, তাদের আর্থিক খাতে ঝুঁকি কমিয়ে আনার জন্যেও উদ্যোগ নিতে হবে এবং এটি বাস্তবায়নে অতিরিক্ত তারল্য পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'একটি সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়নে এতো অতিরিক্ত তারল্যের প্রয়োজন নেই, কারণ প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা মানুষের মাঝে পণ্যের চাহিদা বাড়াতে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে না।'
তারল্য বাড়ার পাশাপাশি দারিদ্র্য ও বেকারত্বের হারও বাড়ছে।
'প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা এখন তাদের অলস টাকা লাভজনক করতে পুঁজিবাজার ও গৃহায়ণের মতো অনুৎপাদনশীল খাত পছন্দ করছেন', জানান মনসুর।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বেঞ্চমার্ক সূচকটি গত কয়েক মাসে এই অতিরিক্ত তারল্যের কারণে অনেক বেড়েছে। ডিএসইএক্সের মান গতকাল ছিল ছয় হাজার ৩৮৯ পয়েন্ট, যা এক বছর আগের মানের চেয়ে ৫৪ শতাংশ বেশি।
মনসুর বলেন, 'যদি সরকার টাকা বাজার থেকে তুলে নিয়ে না আসতে পারে, তাহলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকবে। আমরা তারল্য সংকট চাই না, কিন্তু একইসঙ্গে বাজারে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি টাকা থাকুক, এটাও আমাদের কাম্য নয়।'
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত পর্যায়ক্রমে এই অপ্রথাগত আর্থিক নীতিমালাকে প্রথাগত নীতিমালায় রূপান্তর করা।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিভার্স রেপো (রিপার্চেজ চুক্তি) ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিল চালুর বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত, যেন ব্যাংকগুলো তাদের অতিরিক্ত অর্থকে কার্যকরভাবে বিনিয়োগ করতে পারে।
তিনি জানান, এতে তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হবে।
রিভার্স রেপো ব্যাংকগুলোকে দৈনিক চার শতাংশ হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তহবিল বিনিয়োগ করার সুযোগ দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিল আরেকটি মাধ্যম, যেটি ব্যবহার করে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য তহবিল জমা রাখতে পারবে। এক্ষেত্রে চাহিদার ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারিত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই দুইটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাংকের বিনিয়োগের সুযোগ প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে।
তারা জানান, বিনিয়োগের এই দুটি প্রক্রিয়া আবারও চালু করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একটি বিভাগ থেকে সম্প্রতি সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু আরেকটি বিভাগ বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে।
তারা জানান, একাধিক ব্যাংক এই সুবিধার আওতায় তাদের অলস তহবিল বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
মনসুর আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে সিআরআরে'র হার বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনা করতে পারে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকের মোট আমানতের একটি নির্ধারিত অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে জমা রাখতে হয়, যেটি সিআরআর হিসেবে বিবেচিত হয়।
সিআরআরের মান বেশি থাকার অর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে বেশি পরিমাণ টাকা রিজার্ভে রাখতে হবে এবং ফলশ্রুতিতে নগদ অর্থের প্রবাহ সংকুচিত হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, নতুন নীতিমালাটি বর্তমান অর্থবছরে সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রণয়ন করা হবে। উল্লেখ্য, বর্তমান অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে সাত দশমিক দুই শতাংশ ও পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ।
'আসন্ন নীতিমালাটি উৎপাদনশীল খাতের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ঋণের ব্যবস্থা করার জন্য লক্ষ্য স্থির করেছে', জানান তিনি।
মনসুর সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, রেমিট্যান্সের ওপর আরোপিত দুই শতাংশ প্রণোদনার হারকে প্রত্যাহার করে নিতে, কারণ ইতোমধ্যে রেকর্ড পরিমাণ প্রবাহের কারণে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
রেমিট্যান্সের কারণে বাজারে যে অতিরিক্ত ডলার আছে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনে নিয়েছে এবং এতে বাজারে মুদ্রা প্রবাহ আরও বেড়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যদি স্থানীয় বাজার থেকে টাকা উঠিয়ে নিতে চায়, তাহলে তাদেরকে বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে হবে।
মনসুর জানান, 'এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি একটি কার্যকর মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বাঁধার সৃষ্টি করবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে আগামী দুই-তিন মাস কোনো ধরণের মুদ্রাস্ফীতির চাপ আসবে না।
তিনি বলেন, 'তবুও, অতিরিক্ত তারল্য কমিয়ে এনে অর্থনীতির সামগ্রিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা উচিত।'
বাজারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তারল্য বজায় রাখতে হবে, কারণ উৎপাদনশীল খাত, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এটি খুবই প্রয়োজন।
সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কৃষি ও রপ্তানি নির্ভর শিল্পে ঋণের প্রবাহ অব্যাহত রাখার জন্যেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, 'এই উদ্যোগগুলো সাধারণ জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে।'
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, মানুষের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা থাকা উচিত যাতে পণ্যের চাহিদা কমে না যায়।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের পাশাপাশি অতিরিক্ত তারল্য কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
ইতোমধ্যে গতকাল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানিয়েছে, খাদ্য সামগ্রীর উচ্চ মূল্যের কারণে কিছু উদীয়মান বাজারে ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক আপডেটে তারা জানায়, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর উচিত হবে মুদ্রাস্ফীতির চাপের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য কিছু অন্তর্বর্তীকালীন উদ্যোগ নেওয়া।'
তবে, সংস্থাটি মূল্য নির্ধারণকারী প্রভাবকগুলোর বিষয়ে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার আগ পর্যন্ত কঠোর উদ্যোগ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের মুদ্রানীতি সম্পর্কে পরিষ্কার বার্তা দিলে মুদ্রাস্ফীতির পূর্বাভাসের একটি নির্ভুল চিত্র পাওয়া যাবে, যা এখনি মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে কঠোর কোনো উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টিকে এড়িয়ে চলতে সহায়তা করবে।'
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments