দুর্নীতি, উচ্চ ব্যয়ের জেরে লোকসানে ৯ ব্যাংক
আর্থিক কেলেঙ্কারি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে ২০২১ সালে নিট লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে ৯টি ব্যাংক। এর মধ্যে ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক।
এই ৯টি ব্যাংক হলো- জনতা ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংক।
ব্যাংকগুলোর নিট লোকসানের জন্য উচ্চ খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি, তহবিল আত্মসাৎকারীদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি এবং ঋণ মঞ্জুরিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
একটি ব্যাংকের মোট ব্যয় তার আয়কে ছাড়িয়ে গেলে তখন এটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
এই ৯টি ব্যাংকের মধ্যে জনতা ব্যাংক গত বছর সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা নিট লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। ২০২০ সালে ব্যাংকটি নিট লোকসান করেছিল ৫ হাজার ৫৪ কোটি টাকা।
ব্যাপক এই লোকসানের জন্য উচ্চ খেলাপি ঋণকে দায়ী করেছেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুস সালাম আজাদ।
তিনি বলেন, 'তবে সম্প্রতি খেলাপি ঋণ কমে যাওয়ায় নিট লোকসান কমেছে। এতে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।'
গত অর্থবছর জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১২ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৯ শতাংশ।
কিছু অসাধু ব্যক্তি এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠী যেমন- এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকটি থেকে বের করে নিয়ে যায়।
জনতা ব্যাংক সম্প্রতি এননটেক্সের ৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে।
আজাদ জানান, এননটেক্সের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ এই মাসে পুনঃতফসিল করা হবে, যা জনতা ব্যাংকের নিট লোকসান আরও কমাতে সাহায্য করবে।
তিনি আরও জানান, ক্রিসেন্ট গ্রুপের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পাওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে জনতা ব্যাংককে বেগ পেতে হচ্ছে।
দুর্নীতির কারণে 'ফারমার্স ব্যাংক' থেকে নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে 'পদ্মা ব্যাংক' হওয়া ব্যাংকটির গত বছরের নিট লোকসান হয়েছে ১ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। এর আগের বছর ব্যাংকটির নিট লোকসান ছিল ১৫১ কোটি টাকা।
পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খান বলেন, '২০২০ সালে নিট লোকসান নিরূপণের সময় ব্যাংকটি খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন আমলে নেয়নি।'
'তবে গত বছরের নিট লোকসান নিরূপণের সময় ব্যাংকটি প্রভিশনকে বিবেচনায় নিয়েছিল, ফলে এর আকার বড় হয়ে গেছে।', যোগ করেন তিনি।
পদ্মা ব্যাংক তার মূলধনের ভিত্তি শক্তিশালী করতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
তারেক রিয়াজ খান বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি বাংকটির ব্যালেন্স শিটে নিট লোকসানের তথ্য প্রকাশ না করার অনুমতি দিয়েছে। এই লোকসানকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত "ইনটেনজিবেল অ্যাসেট" হিসেবে দেখানো হবে।'
পদ্মা ব্যাংকের ক্রমবর্ধমান নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
বেসিক ব্যাংকের নিট লোকসান গত বছর বেড়ে হয়েছে ৩৯০ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে ছিল ৩৬৬ কোটি টাকা।
বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, 'খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের গতি না বাড়ালে নিট লোকসান আরও অনেক বাড়ত।'
অনিয়মের মাধ্যমে এই ব্যাংক থেকে অন্তত ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, এতে সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বোর্ড সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
আনিসুর রহমান বলেন, 'জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ৮ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে বেসিক ব্যাংক। গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটির লোকসান ছিল ১২৫ কোটি টাকা।'
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের নিট লোকসান ২০২০ সালে ৫৩৩ কোটি টাকা হলেও ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯৬ কোটি টাকায়।
এই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, 'আমরা কোনো সার্ভিস চার্জ ছাড়াই কৃষকদের ঋণ দিয়ে থাকি। তাই গত কয়েক বছরে আমরা খুব কমই লাভ করতে পেরেছি।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'করপোরেট সুশাসনের অভাবে কিছু ব্যাংক কয়েক বছর ধরে নিট লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে।'
'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংকগুলোকে চাপ দেওয়া যাতে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে জোর প্রচেষ্টা চালানো যায় এবং তাদের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও সম্মতি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয়,' বলেন তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় কিছু ব্যাংক ঋণ অনুমোদন করে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকার উভয়েরই উচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করা।
তিনি আরও জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে দক্ষ পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংকগুলোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া।
বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক গত বছর ১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা নিট লোকসানের সম্মুখীন হয়। ব্যাংকটি গত বছর কার্যক্রম শুরু করে।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন বলেন, 'বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক মাত্রই ব্যবসা শুরু করেছে এবং এখনও নতুন শাখা খুলছে। যেহেতু আমরা এখন কার্যক্রম প্রসারিত করছি, তাই নিট লোকসান অস্বাভাবিক নয়।'
Comments