বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ওপর ‘মোরাল পুলিশিং’ আর কত?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল। ফাইল ছবি

স্লিভলেস পোশাক পরা তরুণীর ছবি তোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকার দ্বারা ফটোগ্রাফারকে হেনস্থা করার ঘটনাটি শুনে মনে হলো আমরা মধ্যযুগের কোনো সমাজে বিচরণ করছি। সেই শিক্ষিকা ও তার সহকর্মীদের মতে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে ছবি তোলাটা পর্নোগ্রাফির পর্যায়ে পড়ে। তারা এও মনে করছেন স্লিভলেস পোশাক পরা আর 'ন্যুডনেস' একই জিনিস। শুধু এখানেই শেষ নয়, অভিযোগ পাওয়া গেছে ছেলের বাবাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডিন ফোন করে বলছেন- 'আপনারা এই ঘটনা পত্র-পত্রিকা এবং গণমাধ্যমকে জানাবেন না।'

ফলে যা হওয়ার, তাই হয়েছে। ছেলে ও ছেলের পরিবার ভয় পাচ্ছে। তারা ভাবছেন তারা কি পারবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে? আর সেই মেয়েটাতো ভয়ে এখন পুরোপুরি চুপসে গেছে। এর মানে দাঁড়াল যে একজন শিক্ষিকার অপরাধ বা অভব্য আচরণ পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের কাঁধে নিতে চাইছে? কিন্তু কেন? কর্তৃপক্ষও কি তাই মনে করছে?

যে শিক্ষিকা শাড়ি এবং হাতা-কাটা ব্লাউজ পরাকে বাজে পোশাক বলছেন, যে শিক্ষিকা বলেছেন- কেউ মানবিক বিভাগে পড়া মানে সে বুদ্ধিহীন ও খারাপ ছাত্র, সেই শিক্ষিকার বুদ্ধি বিবেচনার মান নিয়েই তো প্রশ্ন ওঠা দরকার। অথচ তা না করে শিক্ষকদের কেউ কেউ এবং ছাত্রদের একটা অংশ তাকে সমর্থন দিয়েছে।

এই ঘটনা জানার পর আমার হঠাৎ মনে হলো ফেসবুকে প্রচলিত অত্যন্ত অশ্লীল ও নারীকে নির্যাতন করার তথাকথিত ভিডিও গেমের কথা। এই গেমগুলো লাখ লাখ ভিউ পাচ্ছে, বলা যায় এই ভিডিওগুলো আমাদের সমাজের কিছু মানুষের মানসিকতার উপর ভিত্তি করেই তৈরি হচ্ছে। অথবা বলতে পারেন মানুষের মনোজগতকে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক করে তোলার জন্যই এগুলো তৈরি করা হচ্ছে। সেই ভিডিওগুলোতে নারীকে যেভাবে মন্দ বলে দেখানো হয় ও হেনস্থা করা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষিকা ও তার সঙ্গের লোকেরা ঠিক সেইভাবেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।

ফেসবুকে এইসব অশ্লীল ভিডিও, নরসিংদী রেলস্টেশনে ছাত্রীকে হয়রানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে শিক্ষিকা কর্তৃক একজন ছাত্রীকে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে ফটোশুট করার দায়ে অপমান করা, এবং সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে আসা তথ্য  'দেশীয় পর্নোগ্রাফি অশ্লীলতার চাইতেও বেশি ব্যবহৃত হয় নারীকে অপমান ও নির্যাতন করার জন্য' সব একই সুতায় বাঁধা বলে আমি মনে করি।

খুব দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে যে বাংলাদেশের পর্ণ মুভির কনটেন্ট ঠিক করে দিচ্ছে যে এই সমাজে কে 'ভালো মেয়ে', আর কে 'মন্দ মেয়ে'? এই 'ভালো' বা 'মন্দ' নারীর সঙ্গে সমাজ কী আচরণ করবে সেটাও নির্ধারণ করছে এই সেক্টরটি। অর্থাৎ ডিজিটাল পর্নোগ্রাফির জগৎ এবং এইসব অশ্লীল ভিডিও সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে এক ধরনের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে একটা বড় অংশের দর্শক এইসব দেখে শুধু অশ্লীলতা আস্বাদনের জন্য নয়। এর চাইতেও বেশি দেখে নারীকে নিন্দা, নির্যাতন ও অপমান করার জন্য। নারীকে নিপীড়নের উপায় খুঁজে বের করার এবং নারীর পিঠে 'মন্দ মেয়ের তকমা' লাগানোর জন্য। গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে যে সমাজে নারীদের প্রতি সহিংস ও নির্যাতনমূলক আচরণ বেড়েছে বলে মনে করেন ৮২ ভাগ উত্তরদাতা।

গবেষণা বলছে একটি মেয়ে যখন খোলামেলা বা পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মেলামেশা করে, নিজের মতামত প্রকাশ করে, ছেলেদের সঙ্গে বাইরে বের হয় সেই মেয়েদের নানাভাবে হেয় করা হয় এবং তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা হয়, এমন ধারণা পোষণ করেন ৮১ ভাগ উত্তরদাতা। শতকরা ৬৪ জন মানুষ মনে করে এইসব মেয়েদের প্রতি কটূক্তি, সমালোচনা, তির্যক মন্তব্য ও অপমানজনক আচরণ করাই যায়।

নারী সম্পর্কে নেটদুনিয়াতে যেসব অবমাননাকর কনটেন্ট প্রচারিত হচ্ছে, তা দেখছে বা গ্রহণ করছে অসংখ্য মানুষ। গেম নামের এইসব অশ্লীল প্রডাক্ট সহজে পাচ্ছে মানুষ। এখানে নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য বা কনটেন্ট এর উপর ভিত্তি করে বাড়ছে নারীর প্রতি সহিংসতা। এইসব অনলাইন গেমে নারীর প্রতি অবমাননাকর যে ইমেজ দেখানো হয়, তা সমাজে প্রচলিত 'মন্দ মেয়ে'র ইমেজকে আরও শক্তিশালী করে। কারণ খেলাচ্ছলে তারা দেখাচ্ছে নারীর প্রতি টিটকারি, অবমাননা, প্রতিশোধ, ভার্চুয়াল সেক্স, সেক্স ট্রেড।

যেহেতু আমাদের সমাজের শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ মনে করে এই 'মন্দ মেয়ে'র মতো আচরণ সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত কারণ সেটা অন্য ছেলে-মেয়েদের নষ্ট করে ফেলবে, তাই 'মন্দ মেয়ে'র মতো আচরণ যারা করে, তাদের সেটা থেকে বিরত রাখা জন্য তাকে হেয় করা, মারধর করা, মন্দ বলা ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা সমাজের জন্য উপকারী।

সেই ধরনের কিছু ভ্রান্ত ধারণা থেকেই সম্প্রতি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের উপর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষ মরাল পুলিশিং করার চেষ্টা করেছেন। বেশকিছু শিক্ষার্থী আন্দোলনের সূত্রপাতই হয়েছে ছাত্রীদের মৌখিক ও দৈহিক নিপীড়ন এবং তার যথাযথ বিচার না হওয়া থেকে।

ছাত্রীদের চলাফেরা, পোশাক পরা, ছাত্রীদের বাইরে থাকার সময় কতটা হবে ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ের উপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মতামত দিলেও, ছাত্রী নির্যাতিত হলে বা যৌন নিপীড়নের শিকার হলে কোনো কথা বলেন না। উপরন্তু ছাত্রীদের ছোট করার চেষ্টা করেন। এরকম বহু নজির আছে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদকারীদের সম্পর্কে নানা ধরণের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন বা তাদের চরিত্র সম্পর্ক ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেন। এও কি শিক্ষকদের মাধ্যমে এক ধরনের নিপীড়ন নয়? কার্জন হলে ছেলেটি এবং মেয়েটির উদ্দেশে শিক্ষিকা যা বলেছেন, তিনি কি তা বলতে পারেন?

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নারী শিক্ষার্থীকে পাঁচ জন ছাত্র যৌন হয়রানি করে ভিডিও করা ও ধর্ষণ চেষ্টা করলে ছাত্রী অভিযোগ করেন। ঘটনার দুদিন পর তার লিখিত অভিযোগ গ্রহণ করা হয়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঢিলামি ও উদাসীনতার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। দেখা গেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ অভিযোগ আমলে নেন না। বরং ছাত্রী হয়রানি প্রসঙ্গে তারা এমন অদ্ভুত যুক্তি দেখান, যা ছাত্রীদের জন্য অবমাননাকর হলেও তা দোষীদের পক্ষে চলে যায়।

এদেশের সাধারণ মানুষ সবসময় 'ভিকটিম ব্লেমিং' করে শান্তি পায়। কোন নারী যদি যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হন, তখনও ওই নারীকেই দায়ী করা হয়। ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে উল্টো ভিকটিম ব্লেমিং করার ঘটনা খুব স্বাভাবিক বিভিন্ন ক্যাম্পাসে।

ছাত্ররাও বাদ যায়না এই ব্লেমিং এর হাত থেকে। যেমন, এই ২৫ জুলাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) বুলবুল আহমেদ নামে একজন ছাত্র ছুরিকাহত হয়ে নিহত হন। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ ও বিক্ষোভের মধ্যেই নিহত শিক্ষার্থীর জন্য আয়োজিত এক দোয়া মাহফিলে উপাচার্য বলেন, 'ইদানীং আমাদের ক্যাম্পাসে কোনো শৃঙ্খলা নেই। রাতে-দিনে যে যেভাবে পারে- সেভাবে অবাধ বিচরণ করছে; যা দেখলে আমরা নিজেরাও লজ্জিত বোধ করি।' (গীতি আরা নাসরীন এর লেখা থেকে নেওয়া)

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের জায়গা। সেখানে তাদের জন্য অবাধ বিচরণের পরিবেশ তৈরি না হলেই বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের লজ্জা বোধ করার কথা। সেটা না করে তারা দায় চাপিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের ওপর।

শাবিপ্রবি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ছাত্রীদের চলাফেরা নিয়ে যেসব কথা বলেছেন কিছুদিন আগে, সেটাও আমরা ভুলে যায়নি। স্বাধীনভাবে ছাত্রীরা চলাফেরা করলে যে ভালো বিয়ে হবে না এমন ভয়ও দেখিয়েছেন। অথচ যৌন-হয়রানিমুক্ত শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ তৈরিতে হাইকোর্ট প্রদত্ত নীতিমালার (২০০৯) ৪ ধারা অনুযায়ী শিক্ষকদের অনেক আচরণ যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। যেমন: অশালীন ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্যক্ত করা, যৌন-ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অভিভাবকত্বের নামে সংবিধান ও নীতিমালা পরিপন্থী কাজ করে বৈষম্য চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি কমিটি থাকা দরকার যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা, বাইরে থেকে ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসা অতিথি, এমনকি শিক্ষক/শিক্ষিকারাও কোনো ধরনের অন্যায় আচরণের শিকার হলে এসে কথা বলতে পারবেন, অভিযোগ জানাতে পারবেন। কোনো নিয়মকানুন ছাড়াই কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষার্থীদের নীতি ও নৈতিকতা বিষয়ে যে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তা খুবই অনভিপ্রেত। বিশ্বের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এহেন সংস্কৃতি চালু আছে কি না আমার জানা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকার কাছে যদি স্লিভলেস ব্লাউজ ও শাড়ি পরাকে ন্যুড বা নগ্নতা বলে মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার ধারণাগত সমস্যা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কি কোনো বিধিমালায় লেখা আছে যে এখানে কেউ হাতাকাটা পোশাক পরতে পারবেন না? অথবা এরকম পোশাক পরা থাকলেই কেউ চরিত্রহীন হয়ে যাবে? শিক্ষিকার কথা অনুযায়ী এরকম ছবি তোলা পর্নোগ্রাফি আইনের মধ্যে পড়েছে, সত্যিই কি তাই? তাছাড়া এই ছবি তোলা কি এতটাই ভয়াবহ অপরাধ যে তাদের বাবা মাকে ডেকে এনে যা তা কথা বলে, তাদেরর অপমানিত করা হলো?

বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অনেক বড় বড় অপরাধ ঘটে যেমন: খুন, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, অপহরণ, জিম্মি করা, ছাত্রদের পিটানো, রাজনৈতিক হানাহানি। কিন্তু কখনো কি এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের অভিভাবককে ডেকে আনা হয়েছে? অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে একদম তলানিতে পড়ে থাকছে, সেটা নিয়ে এই ধরনের শিক্ষকদের মাথা ঘামাতে দেখি না। তারা ব্যস্ত আছেন মোরাল পুলিশিং নিয়ে। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।

 

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

17h ago