‘ফিরে যাই ফিরে আসি’
বাংলা কথাসাহিত্যের কিংবদন্তি হাসান আজিজুল হক। ১৯৩৯ সালে বর্ধমান জেলার যব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার হাত দিয়ে বেরিয়েছে অনেকগুলো শক্তিমান ছোটগল্প। তার লেখা কিছু প্রবন্ধ সাধারণের ভাবনাকে আমূল পাল্টে দিতে পারে। তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ', 'জীবন ঘষে আগুন', 'আগুনপাখি', 'নামহীন গোত্রহীন' ইত্যাদি। সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি, আনন্দ পুরস্কার ও একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার। তার গল্প অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, রুশ ও চেক ভাষায়।
আজ সোমবার রাতে রাজশাহীতে নিজ বাসভবনে মারা গেছেন এই কিংবদন্তি সাহিত্যিক। তিনি ২০১৬ সালে দ্য ডেইলি স্টারকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হলেও বাংলায় এতদিন অপ্রকাশিত ছিল। সাক্ষাৎকারটি আজ বাংলায় প্রকাশিত হলো।
আপনার জীবনকালে দেখেছেন দেশভাগ, স্বাধীনতাসহ অনেক কিছু। পেয়েছেন দেশের জলমাটির গন্ধ। এ সব কী ধরনের সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি করে বলে আপনি মনে করেন?
হাসান আজিজুল হক: হিন্দু মিথের একটা গল্প বলি। পার্বতীর সঙ্গে তার শ্বশুরকুলের খুব গণ্ডগোল। শিবের পোশাক-আশাক, চলাফেরা এ সবের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকে। একদিন শিব পার্বতীকে চক্র দিয়ে কেটে ৫০ টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দিলেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল, প্রত্যেকটি টুকরো এক-একটা ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেল। এই সব মিলে আলাদা একটা ইতিহাসও তৈরি করে ফেলল। আমাদের অবস্থা হচ্ছে এমন। দেশভাগ, স্বাধীনতা অঞ্চলভেদে এক-একটা ঐতিহ্য যেমন আছে, সব মিলিয়ে সম্মিলিত সংস্কৃতির ভেতরে আছি আমরা।
সংস্কৃতির আবহে আমাদের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের জীবন কেমন? কিংবা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে?
হাসান আজিজুল হক: বর্তমানে এদের কোনো স্থিরতা নেই, দৃঢ়তা নেই। তারা কেবল উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। জিভ চাটে। এই সময়কালে একটা অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। বাঙালির স্বতন্ত্র কালচার বলে কিছু থাকছে? অতীত ভুলে তারা কেবল দৌঁড়াচ্ছে। দেশটার মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে।
আপনার লেখায় দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা এসেছে নিপুণভাবে। আপনার জীবনে দেশভাগ কোনো প্রভাব ফেলেছে?
হাসান আজিজুল হক: দেশভাগের ফলে নানাভাবে মানুষকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনে কিছু হয়নি। পারিবারিক কারণেই বাংলাদেশে এসে লেখাপড়া শুরু করি। তাছাড়া আমার দিদি থাকতেন খুলনায়, তার কাছেই আসি। আর তখন সেভাবে কিছু বুঝিনি যে পাকিস্তান নামের একটা দেশ আলাদা হয়েছে। কিন্তু পরে আমার মনে হলো দেশভাগ একটি ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। পুরো বাঙালি, বাংলা চিরকালের জন্য ভেঙে গেছে।
'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' ও 'আগুন পাখি' দেশভাগের যন্ত্রণা, হাহাকারের গল্প। দর্শনের জায়গা থেকে দেশভাগ নিয়ে কিছু বলুন।
হাসান আজিজুল হক: দেশভাগ নিয়ে ভেবেছি অনেক, এখনও ভাবি। একটা কথা বলি, দেশভাগ নিয়ে এখানকার মুসলমানের অনুভূতি আর পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের অনুভূতি কখনো এক নয়।
আমরা যতদূর জানি আপনি প্রথম জীবনে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে কারণে তৎকালীন সরকারের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে আপনাকে। সে সম্পর্কে জানতে চাই।
হাসান আজিজুল হক: এ সব নিয়ে কখনো ওভাবে লিখিনি। সামান্য ঘটনা। এই সমাজ, এই রাষ্ট্র নিয়ে ভাবছিলাম। মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র ভাবাটা একটা ব্যাপার। তবে এ সব নিয়ে যে মানুষ ভাবে না, সে মানুষ না। মানুষ মাত্রই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
স্মৃতি মানুষকে তাড়া করে। লেখক সে স্মৃতি নিয়ে লিখেন আত্মজীবনী। আপনার সে ধরনের কিছু লিখেছেন?
হাসান আজিজুল হক: কয়েক বছর আগে বেরিয়েছে 'ফিরে যাই ফিরে আসি'। আমি এটাকে আত্মজীবনী বলি না। বলি আমার স্মৃতিকে অবলম্বন করে সময়টাকে ধরার চেষ্টা করেছি। আর সময় তো ফাঁকা বস্তু নয়। সময় দেশ-কাল-মানুষ সব কিছু দিয়ে পূর্ণ থাকে। তার অর্থ, কিছু সূত্র বের করা, এগিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে যাওয়া, মানুষের বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকার ধরন, আর এ বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে জীবনের কোনো অর্থ বের করা। আর যে সমাজটাকে চোখের সামনে দেখি, সে সমাজটাকে সুস্থ বলব, কতটুকু অসুস্থ বলব, তার একটা চেহারা তুলে ধরা। জীবন কথা বলেই এটা লেখা, তার ছোট একটা অংশ যেটা প্রকাশিত হয়েছিল 'ভোর বেলাকার চোখে'। দ্বিতীয় অংশটা বের হবে সামনে।
আপনার এক জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন শিক্ষকতায়। অন্য পেশায় যাননি, নাকি যাওয়ার আগ্রহ হয়নি?
হাসান আজিজুল হক: ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকতার সুযোগ আসে। আমি দৃঢ়ভাবে বেছে নিলাম শিক্ষকতাকে। কেননা আমার মনে হয়েছিল লেখালেখির জন্য সবচেয়ে ভালো সময় পাওয়া যাবে অধ্যাপনা করলে। ওখানে মাথার ওপরে চোখ রাঙানিটা নেই। একটা স্বাধীনতা আছে। ফলে যখন পেছনের দিকে তাকাই, তখন মনে হয় না যে, ভুল করেছি।
দেশের খ্যাতিমান একজন লেখক হিসেবে নিশ্চয় আপনিও ভাবেন দেশ নিয়ে। নিরপেক্ষ জায়গা থেকে বলতে হলে, এই সময়ের কী মূল্যায়ন করবেন?
হাসান আজিজুল হক: নিজের অবস্থান থেকে বলতে গেলে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের পরে যে সংবিধান রচিত হয়েছে, তাতে আমাদের দেশকে পেয়েও পাইনি। এর ইতিহাসও খুবই হতাশাজনক। বাংলাদেশের মানুষ যে এত রক্ত দিল, আমরা যে কেঁদে ভাসালাম, গান গাইলাম 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে' এর সবই আমাদের ভণ্ডামি হলো না? এ রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে দেশের জনগণের কাছে যেভাবে তুলে ধরেছে, তাতে রাষ্ট্র কতিপয়ের ভোগের বস্তু নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের প্রচুর সম্পদ আছে। কিন্তু এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। যে পর্যায়ের উন্নয়ন হচ্ছে, এর সুবিধাভোগী জনগণ হতে পারছে না। যেহেতু এটি একটি গণতান্ত্রিক দেশ. সেহেতু এখন সবাই দাবি করছে-আমরা জনগণের প্রতিনিধি। সত্যিকারের গণতন্ত্র এখানে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত বা কার্যকর করতে গেলে রাজনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণ।
বয়সের দিকে দিয়েও আপনি অভিভাবক তুল্য। অস্থির সময়ে আমাদের চলার বিষয়ে আপনার কোনো পরামর্শ যদি থাকে।
হাসান আজিজুল হক: এইটুকুও তোমাকেই বের করতে হবে। কি করবে? যে কাজটা মনে হবে অন্ততপক্ষে আমার শক্তির মধ্যে দক্ষতার সঙ্গে সার্থকতার জন্য কাজটা করা দরকার। অজস্র কাজের মধ্যে এটা যদি তুমি এক ঘণ্টা করতে পারো যে, দিস ইজ মাই ওয়ার্ক, তাহলেই তুমি সুখী।
Comments