গডফাদারদের দাপট অনেকটা কমে এসেছে, আরও কমবে: আইভী
উদ্যমী, সাহসী ও জনমানুষের নেতা হিসেবে ইতোমধ্যেই নিজের পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করেছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। গত ১৬ জানুয়ারি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে বেশ বড় ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের পর পর ৩ বারের নির্বাচিত মেয়র তিনি। নির্বাচন ও পরবর্তী কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: আগের দুইবারের চেয়ে এবার নির্বাচন কি আরও কঠিন বা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
সেলিনা হায়াৎ আইভী: সব নির্বাচনই কঠিন, চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু এবারের নির্বাচনে প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে একটি অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল। এ কারণে সব কিছু মিলিয়ে এটা একটু কঠিনই ছিল। তারপর আবার টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচন করেছি। আমি মানুষের সাড়া পেয়েছি যথেষ্ট। কিন্তু ভেতর-বাইরের ষড়যন্ত্রটা ছিল খুবই কঠিন। এ জন্যই এই নির্বাচনকে একটু আলাদা বলতে হবে। গভীর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বিজয়ী হতে হয়েছে।
ডেইলি স্টার: ষড়যন্ত্র কি দলের ভেতর থেকে?
আইভী: এবারের নির্বাচনে ষড়যন্ত্র ছিল চতুর্মুখী। ইন্টারনাল বলেন, এক্সটারনাল বলেন, সব ষড়যন্ত্রই ছিল অত্যন্ত গভীর। তবে লক্ষ্য করলে দেখবেন, এই ষড়যন্ত্রগুলো জনতার স্রোতের কাছে টিকতে পারেনি। আমি জনতার ওপর নির্ভর করেই ১৮ বছর ধরে টিকে আছি। প্রথম থেকেই বিশ্বাস ছিল, ষড়যন্ত্র যত গভীর হবে, আমার জন্য জনতার সাপোর্ট ততই শক্তিশালী হবে। আমার এই বিশ্বাসটাই সঠিক হয়েছে।
ডেইলি স্টার: আগের দুইবারের চেয়ে এবার ভোট তো কম পেয়েছেন। এটা কি জনপ্রিয়তা কমার ইঙ্গিত?
আইভী: সেটা আপনারা বিচার করবেন। আমি শুধু পরিস্থিতিটা বলছি। এবার আমি কিছু ভোট কম পেয়েছি তার কারণ আছে। প্রথমত, ইভিএমে ভোট নেওয়ার কারণে অনেক মানুষ ভোট দিতে পারেননি। নির্বাচন খুব স্লো হয়েছে। এ ছাড়াও, বিভিন্ন কেন্দ্রে নারী ভোটারদের বুথ ফেলা হয়েছে দোতলা বা ৩ তলায়। তাদের অনেকে উঠতে পারেননি। আবার একটি রুমে ২ থেকে ৩টি বুথ করা হয়েছে। খুব সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করে এমন কিছু কাজ করা হয়েছে, যার কারণে অনেক নারী ভোটার ভোট দিতে পারেননি। কারণ যারা ষড়যন্ত্র করেছেন তারা আমার শক্তির জায়গাটা জানেন। নারীরা যত বেশি ভোট দিতে আসবেন, আমি তত বেশি ভোট পাব। নারী ভোটারদের ঠেকানোর ষড়যন্ত্র হয়েছে শুরু থেকেই।
তারপরও আমি বলব আলহামদুলিল্লাহ।
ডেইলি স্টার: আপনাকে নারায়ণগঞ্জের মানুষ ভোট দেয় কেন? নিজে কখনো চিন্তা করেছেন বিষয়টি?
আইভী: নারায়ণগঞ্জের মানুষ আমাকে তাদেরই একজন মনে করেন। আমিও নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে ভালোবেসেছি, নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছি। ভালোবাসা কিংবা কাজের বিনিময়ে কারও কাছে কখনো কিছু চাইনি। আমি কোনোদিন সন্ত্রাস করিনি, চাঁদাবাজি করিনি, খুন-খারাবি করিনি। গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে শুধু গণমানুষের কথা চিন্তা করে জনমত নির্বিশেষে সবার জন্য কাজ করেছি।
ডেইলি স্টার: কিন্তু ঠিকাদারদের সুবিধা দিয়ে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ তো আপনার বিরুদ্ধে আনে আপনার প্রতিপক্ষ।
আইভী: আমি আমার ঠিকাদার দিয়ে কাজ করাই এবং তাদের থেকে সুবিধা নেই— এমন অভিযোগ যে মিথ্যা তা মানুষ জানেন। বিশ্বাস করেন।
এই অভিযোগ কেবল ৫ বছর পর পর ভোটের সময়ই শুনবেন। গত ১৮ বছরে আমি ১৮ টাকারও সুবিধা কারও কাছ থেকে নেইনি। নারায়ণগঞ্জ শহরে বাতাসে, নদীতে, বালুতে টাকা উড়ে। ঠিকাদার কেন, টাকা নেওয়ার ইচ্ছা থাকলে তো আমি যেকোনো জায়গা থেকে নিতে পারি। আমার কারও সঙ্গে এ ধরনের কোনো লেনদেন নেই। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এখন ই-টেন্ডারে কাজ হয়। এই প্রক্রিয়ায় নিজের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া বা সিন্ডিকেট করার কোনো সুযোগ নেই। আপনি বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঠিকাদারি করতে পারবেন। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ খুঁজে না পেয়ে কিছু একটা বলতে হবে তাই এই অভিযোগ তোলে। কোনো এককালে এসব অভিযোগ মানুষকে হয়তো বিশ্বাস করাতে পারত, কিন্তু এই সময়ে এসে আর সেটা সম্ভব না। সম্ভব না বলেই নারায়ণগঞ্জের মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচনে আমাকে বার বার বিজয়ী করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর আস্থা রেখেছেন। মনোনয়ন দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জবাসী আমাকে বিজয়ী করেছেন।
ডেইলি স্টার: ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভিযোগ তো তৈমূর আলম খন্দকার এনেছেন।
আইভী: আমার ধারণা তিনি এটা বলার জন্যেই বলেছেন। নির্বাচনে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং হয়নি। তৈমূর কাকা সকাল থেকেই বলছিলেন, ভোট ভালো হচ্ছে, সুন্দর হচ্ছে। রেজাল্ট নেগেটিভ হওয়ার পর হঠাৎ করেই তিনি বললেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কথা। আসলে এমন কিছুই হয়নি। আমার কাছের যারা আমার বিরোধিতা করেছে, তারা হয়তো জানে আমার ভোট ব্যাংকটা কোথায়। তারাই সূক্ষ্মভাবে কিছু কিছু জায়গায় এমন কিছু কাজ করেছে, যাতে আমার ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে কম আসে বা ভোট দেওয়ার সময় বা সুযোগ না পায়। এই ধরনের সমস্যার সঙ্গে ইভিএম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
ডেইলি স্টার: নির্বাচনের প্রতিপক্ষ কাকা তৈমূরের হাত আপনার মাথায়, আপনি তাকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। ইতিবাচক রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে যা এখন আলোচনায়।
আইভী: আমি কাকার কাছে আগেই বলেছিলাম নির্বাচনের পর আমি যাব তার বাসায় মিষ্টি নিয়ে। তিনি ব্যস্ত থাকায় সেদিন সকালে না গিয়ে বিকেলে গিয়েছি। তিনি বললেও আমি যেতাম, না বললেও যেতাম। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটাই এমন। তিনি বাসায় না থাকলেও আমি বাসায় যাতায়াত করতাম। আমি তার বাসায় যাব আর তিনি আমাকে রিসিভ করবেন না, এটা হতেই পারে না। কারণ আমি জানি ১৬ তারিখেই নির্বাচন শেষ। ১৭ তারিখেই তার সঙ্গে এই নির্বাচন নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। ভবিষ্যতের কথা বলতে পারি না, তবে আমার তরফ থেকে কোনোদিন কারও সঙ্গে সমস্যা তৈরি হয়নি আর কোনোদিন হবেও না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস কাকা আমাকে মন থেকেই দোয়া করেছেন এবং আমাকে সহযোগিতা করবেন।
ডেইলি স্টার: কাকা তৈমূরের সঙ্গে আপনার পারিবারিক সম্পর্কটা আসলে কেমন?
আইভী: আমার বাবার সঙ্গে তৈমূর কাকা সবসময় ছিলেন। বলা যায়, তৈমূর কাকা আমার বাবার শিষ্য। সবসময় তিনি আব্বার সঙ্গে থাকতেন। আব্বা তাকে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাও বানিয়েছেন। তারা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। দুই পরিবারের মধ্যে যাতায়াত ছিল। তারা আমাদের বাসায় আসতেন, আমরাও তাদের বাসায় যেতাম। আব্বা মারা যাওয়ার পরও তৈমূর কাকা আমার সঙ্গে ছিলেন। আব্বার স্মৃতি পরিষদের আমি সভাপতি ছিলাম, কাকা ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। বিএনপিতে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আমার আব্বার এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিএনপিতে যোগ দেওয়ার পরও আমার সঙ্গে সম্পর্কে কখনো টানাপড়েন হয়নি। আমি কখনো তাকে দলীয় কোনো ফেভার করিনি, কিন্তু ব্যক্তি সম্পর্ক ভালো রেখেছি।
ডেইলি স্টার: গডফাদারদের রাজত্ব, সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ যে পরিচিতি পেয়েছে তার পরিবর্তন করতে পারবেন?
আইভী: গডফাদারদের দাপট ও সন্ত্রাসের জনপদ থেকে নারায়ণগঞ্জের অবসান ঘটানোর চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করিনি, করব না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখল, হত্যা তথা গডফাদারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছি। তবে সন্ত্রাস, গডফাদারদের অবসান ঘটানোর জন্য প্রশাসনের আরও সক্রিয় সহযোগিতা লাগবে। আমি জানি না পুরোপুরি অবসান ঘটানো যাবে কিনা। তবে অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু গডফাদারদের রোধ করা গেছে। গডফাদারদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন আর মানুষ পছন্দ করেন না। আগের চেয়ে অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। আশাকরি ভবিষ্যতে আরও ভালো হবে।
ডেইলি স্টার: ত্বকী হত্যার বিচার হবে?
আইভী: আমরা আশা করি ত্বকী হত্যারও বিচার হবে। আমি এই জায়গায় কারও সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ করিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ত্বকী হত্যার বিচার হবেই। নারায়ণগঞ্জের মানুষ এখন আর এসব বরদাস্ত করবে না।
২০১১ সালের পর থেকে গডফাদারদের দাপট অনেকটা কমে এসেছে। আমার মনে হয় ভবিষ্যতে এটা আরও কমবে। সবকিছুরই কিন্তু অবসান হয়।
আমি চেষ্টা করব নারায়ণগঞ্জ যে বাণিজ্যিক পরিচয়ে পরিচিত ছিল সেই ধারাটা ফিরিয়ে আনতে। অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, খেলাধুলায় নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস ছিল। সেটা ফিরিয়ে আনার জন্য আমি কাজ করছি। প্রচুর খেলার মাঠ করছি, সাংস্কৃতিক কাজের জন্য উন্মুক্ত মঞ্চ করেছি, নাট্যমঞ্চ করেছি। মসজিদ, মন্দির, গির্জার জন্যও কাজ করেছি। এর পাশাপাশি খাল খনন, পুকুর খনন, সবই তো করছি সাধারণ মানুষের জন্য।
ডেইলি স্টার: হকারসহ বেশকিছু সমস্যা তো রয়ে গেছে বলে জানা যায়।
আইভী: হকারদের পুনর্বাসন করেছি। মার্কেট করে দিয়েছি। তাদের জন্য স্থায়ী কিছু একটা করে দেওয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আজ ৫০০ হকারকে পুনর্বাসন করলে দেখা যায় কয়েক মাসের মধ্যে আবার ২ হাজার জন রাস্তায় নেমে এসেছে। কাজেই এভাবে তো সবার জন্য করতে পারব না। এর জন্যও প্রশাসনের সহযোগিতা লাগবে। বিকল্প ব্যবস্থা তো করতেই হবে। মানুষকে রাস্তায় হাঁটতে তো দিতেই হবে। যদি প্রশাসন সহযোগিতা করে তাহলে হকার সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।
Comments