আমাদের সময়ে ঈদ নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
বাংলা ভাষার অন্যতম কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একাধারে শিক্ষাবিদ, সাহিত্য সমালোচক ও লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে (ইউল্যাব) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক।
নিজের বেড়ে ওঠা, শৈশবের ঈদ, সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
দ্য ডেইলি স্টার: একজন গল্পকার হয়ে ওঠার পেছনে আপনার শৈশব কতটা ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: শৈশবের স্মৃতিগুলো এখনো উজ্জ্বল। শৈশবে যে সমাজ আমি দেখেছি, তাতে হিংসা-দ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা ছিল না, বিত্তের চমক ছিল না। তাতে ছিল সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং শিশুদের জন্য স্নেহ। শৈশবে খেলার মাঠ ছিল, একটা জেলা শহরের ভেতরে জঙ্গল ছিল, পাহাড়ি ছড়া ছিল, বড় বড় দিঘী ছিল। শহরে ৩টি লাইব্রেরি ছিল, সেগুলোতে আমাদের প্রবেশাধিকার ছিল।
আমাদের পাড়ায় মণিপুরি সম্প্রদায় ছিল, তাদের বড় একটি মণ্ডপ ছিল, হিন্দুদের বড় ২টি মন্দির ছিল, মসজিদ ছিল। সম্প্রীতির এবং আদান-প্রদানের একটা পরিবেশের মধ্যে আমি বড় হয়েছি। অন্যদিকে আমার শৈশব কেটেছে কুমিল্লা ও সিলেটে। এই ২ শহরে আমার ২ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেক রকমের মানুষ দেখেছি তবে সবাই সবাইকে সম্মান করত।
শৈশবে আমি আমাদের লোকজ গল্পকথার ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। গল্প বলার শৈলীর সঙ্গে, এসব গল্পের ভেতরের সম্ভব-অসম্ভবের ভুবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছে। এসবই আমার গল্প লেখার পেছনে শক্তি যুগিয়েছে।
ডেইলি স্টার: পারিবারিকভাবে বেড়ে উঠতে মুক্ত চিন্তার সুযোগ পেয়েছেন। সেই সঙ্গে জীবনের শুরুতে কোন বইটি পড়ে মনে হয়েছে লেখক হতে হবে, যা লেখালেখির জগতে আসতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমাদের পরিবারে মুক্তচিন্তার চর্চা হতো। কারণ বাবা-মা দুজনই ছিলেন শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মা আমার জন্মের আগে থেকেই শিক্ষকতা করতেন। বাবা শিক্ষা বিভাগে চাকরি করতেন, কর্মজীবনের শেষ ৪ বছর একটি জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তারা দুজনই বই পড়তে ভালবাসতেন, আমাদেরও বই পড়তে উৎসাহ দিতেন। জন্মদিনে মা বই কিনে দিতেন। এজন্য পড়ার বইয়ের কোনো অভাব ছিল না।
জীবনের শুরুতে যেসব বই পড়তাম সেগুলো ছিল রূপকথার, অ্যাডভেঞ্চারের, হাসির। সেগুলোতেই ডুবে থাকতাম, তাদের ভুবনে আনন্দ নিয়ে ঘুরতাম। লেখক হতে হবে, এ রকম কথা কখনো মনে হয়নি।
ডেইলি স্টার: সময় সমাজ অনেক বদলেছে। এই বয়সে এসে আপনাদের সময়ের ঈদ আনন্দ কেমন অনুভূতির সৃষ্টি করে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আগেই বলেছি, আমাদের সময় বিত্তের চমক ছিল না, প্রদর্শনের সংস্কৃতিও ছিল না। দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় বানিয়ে নীতিকথা শোনানোর ব্যাপারটাও ছিল না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাড়া-পড়শিদের আমন্ত্রণ ছিল। ফলে ঈদ নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না, বরং নির্মল আনন্দ ছিল। ঈদের কেনাকাটা হতো সীমিত পরিসরে। প্রতিবছর নতুন জামা-জুতো সব পাওয়া হতো না, পারলেও অনেক পরিবার তা সীমিতভাবেই তা দিতো। কারণ সৎ উপার্জনেই মানুষ চলত। এজন্য আমাদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও বাহুল্য ছিল না। পরিবারগুলোতে উৎসবের মেজাজ তৈরি হতো আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে আহার গ্রহণের মধ্য দিয়ে। ঈদের দিনে ভুরি-ভোজের আনন্দটাই ছিল আলাদা।
ঈদ প্রসঙ্গে একটা স্মৃতির কথা বলি। আমার এক বন্ধু ছিলেন, তার বাবা লন্ডনে থাকতেন। তিনি কোনো কোনো বছর আসতে পারতেন না। যেবার আসতেন না, সেবার ঈদের নতুন জামা পাঠিয়ে দিতেন। একবার আসতে পারেননি, কিন্তু নতুন জামা পাঠিয়ে দিলেন। চকচকে জামা পরে বন্ধু খেলার মাঠে এসে উপস্থিত। কিছুক্ষণ থাকার পর সে চলে গেল। আবার যখন ফিরে এলো গায়ে তার পুরোনো একটা জামা। আমি জিজ্ঞাস করলাম কেন এটা পরছ? সে বলল, মা বলছেন তোমার বন্ধুরা অনেকে নতুন জামা কিনতে পারেনি, তোমাকে দেখলে মন খারাপ করবে।
ডেইলি স্টার: আমাদের আধুনিকতা, উন্নয়ন এগিয়ে যাওয়ার গল্প দেশের মানুষকে শান্তির পথে নিচ্ছে কি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: শান্তির পথ কথাটা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। কোন শান্তির পথ? টি এস এলিয়ট তার দ্য ওয়েস্টল্যান্ড কবিতায় আধুনিক পশ্চিমের পোড়ো জমির ছবি এঁকে শেষ পর্যন্ত মানুষকে যে শান্তির পথের নির্দেশ দিয়েছেন, তা তার ভাষায় 'জ্ঞান-বুঝের অতীত'। অর্থাৎ যে শান্তি বাস্তব পৃথিবীর রাস্তা দিয়ে আসবে না, আসবে চিত্তের উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে। সেই শান্তি? আধ্যাত্মিক, নাকি জাগতিক? ব্যক্তিগত, নাকি পারিবারিক, নাকি সামষ্টিক? আধুনিকতা, উন্নয়ন, এগিয়ে যাওয়া এগুলো তো আধ্যাত্মিক শান্তি দিতে পারে না। তারা জাগতিক শান্তি দিতে পারে, যদি জগৎ আত্মশুদ্ধির পথে যায়। জগৎ কি যাচ্ছে? না তৃতীয় একটা বিশ্বযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে?
আমাদের সমাজে আধুনিক হওয়াটা মনের দিক থেকে সংস্কারমুক্ত, উদার এবং মানবিক হওয়া বোঝায় না। আধুনিকতার অর্থ বিত্ত, শিক্ষা, সামাজিক সক্রিয়তা, ক্ষমতা এসব নির্ধারণ করে দেয়। উন্নয়নও নির্ধারিত হয় বস্তুর এবং টাকা পয়সার হিসাবে। এগিয়ে যাওয়া মানে বাকিদের পেছন ফেলে, দৌড়ঝাঁপ করে সামনে যাওয়া।
আমরা কি মনের দিক থেকে আধুনিক হতে পারছি?
না। পারছি না। শান্তির পথটা ব্যক্তিকেই খুঁজে নিতে হয়। কিন্তু ব্যক্তি কি বিত্ত, প্রভাব আর ক্ষমতাকেই প্রধান মানতে শুরু করছে না? তাহলে? আমার বাবা বলতেন শিক্ষকরা সমাজের নায়ক।
ডেইলি স্টার: আজকের অনেক শিক্ষক চৌর্যবৃত্তিসহ নানান অপকর্মে জড়িত। বিষয়টা একজন শিক্ষক হিসেবে আপনাকে কি পীড়া দেয় ?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: শিক্ষকদের নিয়ে একটা অদ্ভুত দ্বিত্বতা কাজ করে। সমাজ ধরে নেয় শিক্ষকরা আধপেটা খেয়ে তাদের সন্তানদের মানুষ করবে, তাদের জীবনমান উন্নত করার প্রয়োজন নেই। অথচ সমাজ ক্রমাগত বিত্তের দিকে যাচ্ছে, চমকের দিকে যাচ্ছে, দুর্নীতি এখন গৃহীতই শুধু নয়, বহুল চর্চিতও। সমাজ যদি শুদ্ধতার চর্চা করত, তাহলে শিক্ষকদের সেই চোখে দেখার একটা না হয় যুক্তি থাকত। কিন্তু যে সমাজে প্রাইমারি স্কুলের একজন হেডমাস্টারকে দ্বিতীয় শ্রেণির চাকুরের মর্যাদা দেওয়া হয়, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে শিক্ষকদের টিউশন করতে হয়, তাদের দিকে সমালোচনার তীর ছোঁড়া হয়, সে সমাজে শিক্ষকরাই শুধু সুনীতির পরাকাষ্ঠা হবেন? তা কী করে ভাবা যায়?
শিক্ষকদের অপকর্মের অথবা চৌর্যবৃত্তির আমি সাফাই গাচ্ছি না, সবচেয়ে কঠোর ভাষায় নিন্দা করছি। কিন্তু শিক্ষকরা তো সমাজেরই অংশ, সমাজের অনুকম্পা, অনুগ্রহপ্রাপ্ত অংশ। তাদের যদি আমরা সেই অবস্থানটা দিতাম, যেন জীবনধারণের জন্য তাদের পর্যাপ্ত বেতনভাতা এবং সম্মান দেওয়া হত, তাহলে তাদের প্রতি সমাজের সুবিধাভোগী অংশ, বড় বড় অপকর্ম-অপরাধের ব্যাপারে নীরব লোকজনের সমালোচনাটা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া যেত।
শিক্ষকদের (প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত) একটা অংশ সচ্ছল, সুবিধাপ্রাপ্ত। তারা অপরাধ করলে তাদের বিচারের সম্মুখীন অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু যেসব শিক্ষক কোনোরকমে জীবনধারণ করছেন, তাদের ব্যাপারে সমালোচনামুখর হওয়ার আগে নিজেদের অবস্থানটা পরিষ্কার করে নেওয়া উচিৎ।
ডেইলি স্টার: যে কোনো দেশের জন্য স্বাধীনতা ও মুক্তি আলাদা বিষয়। সামাজিক মানুষের মুক্তি কতটা ঘটেছে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: রাজনৈতিকভাবে একটা নব্য-উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়াটা ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে বড় সফলতা। কিন্তু সামাজিক মুক্তির যে প্রসঙ্গটি তোলা হয়েছে, সেটি অর্জন করা অনেক কঠিন। অনেক উন্নত দেশেও সামাজিক মুক্তি এখনো অর্জিত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসী মানুষগুলো, এক বড় সংখ্যার দরিদ্ররা এখনো সামাজিক মুক্তি পায়নি। যে দেশে ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতিগত হানাহানি, বর্ণবাদ ইত্যাদি সক্রিয়, সে দেশে সামাজিক মুক্তি ঘটে না। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা সামাজিক মুক্তির সমার্থক নয়।
আমার মতে সামাজিক মুক্তির জন্য অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সেটি আমাদের দেশের ২০-২৫ শতাংশ মানুষ হয়ত অর্জন করেছে। পাশাপাশি শিক্ষা, বিশেষ করে শিক্ষার যে একটি সংস্কৃতি আছে যা মানুষকে আলোকিত করে, বিভিন্ন পেশা ও উদ্যোগের জন্য তৈরি করে কিন্তু তাদের মানবিকতা, উদার নৈতিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদি শেখায়, সেই শিক্ষাও অত্যাবশ্যক। তা কি আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের দিতে পারছি? আমাদের বিভেদমূলক রাজনীতি, ধর্ম নিয়ে উগ্রতা, মানুষের মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব, এসব কি সামাজিক মুক্তি ঘটায়? তাছাড়া যে সমাজে সততার সংজ্ঞা হচ্ছে 'সুযোগের অভাব' (যদিও অনেক সৎ মানুষ এই সংজ্ঞার বাইরে) সে সমাজের মুক্তি কীভাবে আসে?
সমাজ মানে ব্যক্তির সমষ্টি। ব্যক্তি সৎ হলে, তার পৃথিবীটা উদার হলে, মানবিক হলে, সুন্দর হলে সমাজও সে রকম হয়। এ সবের যোগফলটাই তখন সামাজিক মুক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
ডেইলি স্টার: আপনার একটা বই পড়েছি 'অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প'। বইটির বিষয়বস্তু এ সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: হ্যাঁ, আমি সমাজে অন্ধকার দেখেছি, আলোও দেখেছি। আগেই বলেছি, সমাজ হচ্ছে ব্যক্তির সমষ্টি। আমি এমন অনেক ব্যক্তিকে দেখেছি যাদের ভেতরে আলো আছে প্রজ্ঞার, ভালবাসার, মানবিকতার। আবার এমন অনেককেও দেখেছি, যাদের সংখ্যা দু:খজনকভাবে, কমছে না। তাদের ভেতর আছে হিংস্রতা, উগ্রতা, অবজ্ঞা, অসূয়া ও উগ্রতা। এরা অন্ধকারের প্রতিনিধি। আমার বইটি যখন প্রকাশ পায়, সমাজ নিয়ে আমার যে অস্বস্তি ছিল, এই এত বছর পরেও তা থেকে আমি নিষ্কৃতি পাইনি।
ডেইলি স্টার: সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের অনেক আলোচনা, নানারকম দ্বন্দ্ব। কিন্তু সঠিক সংস্কৃতি চর্চার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বাজেট ১ শতাংশ বরাদ্দও হয় না। তাহলে সংস্কৃতির গুরুত্বের ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: সংস্কৃতির নানা রূপ আছে, তার একটি মূল্যবোধ সংক্রান্ত, যেন কিছু সুনীতি, সৌন্দর্যজ্ঞান আর মনুষ্যত্ব-মানবিকতার প্রকাশ প্রাধান্য পায়। সংস্কৃতির আরেক রূপ এর নিত্যদিনের চর্চা, যা হয় আমাদের সামাজিক আচার থেকে খাদ্যগ্রহণ ইত্যাদি অনেক কিছুর সমন্বয়ে। এগুলোর জন্য বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন নেই, কোনোকালে ছিলও না। আমার শৈশবের যে সংস্কৃতি দেখেছি, তাতে কোনো বস্তুগত মূল্য সংযোজন ছিল না।
সংস্কৃতির আরেকটি রূপ ধরা পড়ে এর চর্চায়। যেমন, একসময় আমি পুঁথি পাঠ শুনেছি, উৎসবে-পার্বণে গান শুনেছি, যাত্রাপালাও দেখেছি। এগুলোর সংস্থান করত ব্যক্তি অথবা সমাজ। সেখানেও বাজেট বরাদ্দের প্রসঙ্গটা ওঠে না।
যে সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক, যেখানে অর্থের সংস্থান প্রয়োজন, বাজেট বরাদ্দ সেখানে প্রয়োজনীয়। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যেখানেই বাজেট বরাদ্দ হয়, সেখানেই টাকার নয়ছয়। সেজন্য বেশি বাজেট বরাদ্দ হলেই যে সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটবে, সে রকম জোর দিয়ে বলা যায় না।
আমি অবশ্যই চাই সংস্কৃতিতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ুক। প্রতিটি শহরে উন্নতমানের অডিটোরিয়াম হোক, গণগ্রন্থাগার হোক, বছরব্যাপী নাট্য-সঙ্গীত-চারুকলা উৎসব হোক। কিন্তু বেশি অংকের বরাদ্দ বাজেট যেন স্বচ্ছতার সঙ্গে খরচ হয়, প্রকৃত সংস্কৃতিসেবীরা এর সুফল পান, তা দেখতে হবে।
কিন্তু যে সংস্কৃতি মানুষকে পরিশীলিত করে, যার উৎপত্তি প্রথমত পরিবারে এবং যার বিকাশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও সমাজে, সেই সংস্কৃতিটাই তো নেই। ব্যক্তি কি এখন সংস্কৃতিমনা? সংস্কৃতি লালন করবে যে ব্যক্তি তার ভেতরটাই তো ক্রমাগত সংকীর্ণ হচ্ছে। বাজেট বরাদ্দ কখনো তাকে মানবিকতার পক্ষে সক্রিয় করতে পারবে না।
ডেইলি স্টার: সবাই পরামর্শ দেয় লিখতে হলে পড়তে হবে। কিন্তু পড়ার সঙ্গে দেখার চোখ আর বোধ কতটা জরুরি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: এ কথা অনস্বীকার্য যে একজন লেখকের দেখার চোখ আর বোধটা থাকা জরুরি। বড় সাহিত্যিকদের পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা অপরিসীম। এই দেখার মধ্যে বিশ্ব ভূগোলের পাশাপাশি ঘরের পাশের মাঠে ঘাসের মধ্যে যে শিশির বিন্দু জায়গা করে নেয় শরতে, তাও থাকতে হবে। একজন স্রষ্টা তাই দ্রষ্টাও। তার বোধ-অনুভূতিও থাকে তীব্র।
তবে একজন লেখকের দেখার চোখ আরও শাণিত হয় যখন দেশের ও বিশ্বের নানান লেখক-সাহিত্যিকের চোখ দিয়ে দেখা তাদের জগতটা তার জানা হয়। তার বোধের ঘরেও কিছু বাড়তি অনুরণন সৃষ্টি করবে তার পাঠের অভিজ্ঞতা। এজন্য একজন লেখকের পড়তে হবে। পড়ার সঙ্গে দেখার অভিজ্ঞতা, দেখার চোখ জরুরি।
ডেইলি স্টার: কবিতা-গল্প লেখার জন্য বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনা ও নন্দনতত্ত্ব কীভাবে সহায়তা করে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: দুটি আলাদা প্রশ্ন। প্রথমটি বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার সংযুক্তি নিয়ে, দ্বিতীয়টি নন্দনতত্ত্বের ভূমিকা নিয়ে। একজন লেখক যিনি গল্প বা উপন্যাস লেখেন, নাটক অথবা কবিতা লেখেন, তাকে নির্ভর করতে হয় বাস্তবের অভিজ্ঞতার উপর। সেই বাস্তবকে তিনি তার কল্পনায় নানাভাবে ধারণ করে লেখাটি সাজান। এমনকি কল্পবিজ্ঞানেও বিজ্ঞান তার বাস্তবকে ধারণ করেই কল্পনার রাস্তা ধরে এগোয়। সমাজের কোনো ঘটনা নিয়ে একজন একটি পত্রিকার জন্য প্রতিবেদন লিখলে তাতে সত্যটাই হয় প্রধান। অথচ একজন এ নিয়ে একটা গল্প লিখলে সেই বাস্তবের ওপর কল্পনার একটা মাত্রা ফেলে তিনি সত্যকে বদলে ফেলতে পারেন।
রূপকথায় কল্পনা প্রধান বাস্তবকে তার মতো করে রাঙায়। জাদুবাস্তবতার গল্পে জাদুর জগতটা বাস্তবের পাশাপাশি চলে, আড়াআড়ি থাকে, বাস্তবে ঢুকে পড়ে বিভ্রম, অতিপ্রকৃতি। এমনকি ঘোর বাস্তববাদী গল্পেও কল্পনার উপস্থিতি থাকে। আবার অনেক লেখকের কল্পনা একটা বাস্তবই তৈরি করে ফেলতে পারে, যা আমাদের ইট-কাঠ-লোহালক্কড়ের বাস্তবকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, সেই বাস্তবকে অস্বীকারও করতে পারে। কল্পনা ও বাস্তবতার সংযুক্তিটা তাই স্বত:সিদ্ধ।
সাহিত্যের জন্য নন্দনতত্ত্ব নয়, নন্দনচিন্তা ও নন্দন বোধটাই বেশি জরুরি। এই নন্দনবোধ গড়ে দেয় সংস্কৃতি। সাহিত্য হিংসা শেখায় না, বীভৎসতা শেখায় না। সাহিত্য পাঠ বরং মনের মধ্যে সুন্দরের অনুভূতি জাগায়। এজন্য একজন সাহিত্যিকের নন্দনবোধ থাকাটা এই বাজারশাসিত, উগ্র চিন্তাশাসিত সময়ে আরও বেশি জরুরি। যদিও এই থাকাটা স্বত:সিদ্ধও বটে।
ডেইলি স্টার: পুনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদ বিশ্বাস করেন? পুনর্জন্ম হলে কোন পেশায় আসতে চাইবেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: না, পুনর্জন্মে আমার বিশ্বাস নেই। বরং শিক্ষকতা করে একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পেরে আমি আনন্দিত। এই আনন্দটা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকলেই আমি নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান বলে মনে করব।
Comments