সরকার কেন কৃষকের কাছে আবহাওয়ার খবর পৌঁছাতে পারে না?

পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে গত কয়েকদিন দেশের প্রায় সব জেলায় হঠাৎ করে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমাদের দেশের কৃষকরা। বিদেশ করে উত্তরাঞ্চলের আলুচাষিরা। উত্তরাঞ্চলের জেলা বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও রংপুরে এই সময়ে কৃষকের প্রধান ফসল আলু। যার বেশিরভাগ এখন পর্যন্ত উত্তোলনযোগ্য (কর্তনযোগ্য) হলেও এখনো মাঠে পড়ে আছে।
অসময়ের বৃষ্টিতে খেতে জমেছে পানি। পচন থেকে বাঁচাতে আলু তোলায় ব্যস্ত কৃষক। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে গত কয়েকদিন দেশের প্রায় সব জেলায় হঠাৎ করে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমাদের দেশের কৃষকরা। বিদেশ করে উত্তরাঞ্চলের আলুচাষিরা। উত্তরাঞ্চলের জেলা বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও রংপুরে এই সময়ে কৃষকের প্রধান ফসল আলু। যার বেশিরভাগ এখন পর্যন্ত উত্তোলনযোগ্য (কর্তনযোগ্য) হলেও এখনো মাঠে পড়ে আছে।

হঠাৎ এই বৃষ্টিতে আলুর জমিতে জমে গেছে পানি। গত শনিবার বগুড়া, গাইবান্ধা ও জয়পুরহাটের কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে যারা আলু চাষ করেছেন, সেই পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুরা সবাই মিলে আলুর জমি থেকে পানি নিষ্কাশনে ব্যস্ত। অনেকে আবার বেশি ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পানির মধ্যে থেকে উত্তোলন করছেন আলু।

উত্তরবঙ্গের আলুচাষিরা বলছেন, হঠাৎ বৃষ্টিতে এবার আলুর অনেক ক্ষতি হবে। যে কারণে বছর শেষ হওয়ার আগেই আলুর দাম বেড়ে যাবে অনেক।

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর বগুড়ায় আলুর আবাদ হয়েছে ৫৭ হাজার ৭০৫ হেক্টর, গতকাল পর্যন্ত উত্তোলন (কর্তন) হয়েছে ১৫ হাজার ৬৫ হেক্টর, দিনাজপুরে আবাদ হয়েছে ৫০ হাজার হেক্টরের ওপরে, কর্তন হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ, জয়পুরহাটে আবাদ হয়েছে ৪০ হাজার ২৮০ হেক্টর, গতকাল পর্যন্ত কর্তন হয়েছে ১০ হাজার ২৫০ হেক্টর, গাইবান্ধায় আবাদ হয়েছে ১ হাজার হেক্টরের বেশি, এ পর্যন্ত কর্তন হয়েছে মাত্র ১০০ হেক্টর, সিরাজগঞ্জে আবাদ হয়েছে ২ হাজার ৯১৫ হেক্টর, এ পর্যন্ত কর্তন হয়েছে ১ হাজার ২০ হেক্টর এবং পাবনায় আবাদ হয়েছে ৯ হাজার ১১ হেক্টর, যার কিছুই এখনো কর্তন হয়নি।

ওপরের এই তথ্যানুযায়ী বেশিরভাগ আলু এখনো জমিতে পড়ে আছে। কৃষকরা তুলতে পারেননি। তবে কৃষি কর্মকর্তা বলছেন, বেশিরভাগ জেলার আলু তোলার উপযুক্ত হয়েছে। কৃষকদের কাছে যদি এই মাঘ মাসের অসময়ে এত পরিমাণ বৃষ্টির খবর পৌঁছানো যেত, তাহলে কম করে হলেও ২৫ শতাংশ আলু পচনের হাত থেকে বাঁচানো যেত বলে জানান স্থানীয় কৃষকরা।

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

কানাডার সাচকাচুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ, যিনি তার ফেসবুকে ব্রেকিং নিউজ লিখেছেন এইভাবে যে, 'আগামী শুক্রবার ও শনিবার (৪ ও ৫ ফেব্রুয়ারি) তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা ১০০%।'

কেন এবং কী কারণে এই বৃষ্টিপাত হবে, এর ব্যাখ্যা তিনি তার বিভিন্ন পোস্টে গত ৯-১০ দিন আগে থেকে দিয়ে এসেছেন।

গতকাল সকালে লেখক ও কলামিস্ট আলতাফ পারভেজ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, 'কেন কৃষির এ সর্বনাশ মেনে নিতে হবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার এই যুগে?'

আলতাফ পারভেজ গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, 'আমেরিকার মডেলে এখন ১৬ দিন আগে আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতির পূর্বাভাস দেওয়া যায়। আর ইউরোপের মডেলে ১০ দিন আগে দেওয়া যায়। আমেরিকার মডেলে আজই আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের আবহাওয়ার কথা বলে দেওয়া যায়।'

'আমাদের আবহাওয়া বিভাগ যে মডেল ব্যবহার করছে, সেটাও আমেরিকার। আমাদের দেশে যন্ত্রপাতিরও নাকি সংকট নেই। তার মানে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু সেটা সময়মত কৃষকদের কাছে যাচ্ছে না। কেন?', প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

আলতাফ পারভেজ লিখেছেন, 'আমাদের আবহাওয়া বিভাগের জনবল খুব একটা কম নয়। দেশজুড়ে তাদের জনবল আছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক কেন্দ্র আছে। এখানকার জনবল দেশ-বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসছে। মৌলভীবাজারে শক্তিশালী রাডার বসানো আছে। অথচ আমাদের কৃষক এসবের কোনো সুবিধা পাচ্ছে না সময়মত। এই অবস্থা অবিলম্বে বদলানো দরকার। কৃষকের জন্য আবেগ নয়, প্রযুক্তিগত তথ্য সুবিধা দরকার।'

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের খবর যখন বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং বাংলাদেশ সরকারের যখন উপযুক্ত অবকাঠামো আছে, তবে কৃষক কেন পূর্বাভাস পান না? এ কথা সত্য যে, তথ্য-প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতায় যদিও কৃষক এখন আর আগের মতো রেডিও শুনেন না, কিন্তু তাতে কি কৃষকের কাছে আবহাওয়ার খবর পৌঁছানো যাবে না?

সরকারের সর্বনিম্ন কাঠামো ইউনিয়ন পরিষদ, যা আর আগের মতো কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর থাকে না। একেবারে গ্রাম পর্যায়ে রয়েছে সরকারের বিট  পুলিশিং। সরকার চাইলেই প্রান্তিক কৃষকদের কাছে এই কাঠামোর মাধ্যমে মাইকিং করে অগ্রিম বৃষ্টিপাতের খবর পৌঁছানো যেত। এটা খুব কঠিন কাজ নয়। ধরে নেই, যদি অর্ধেক আলুচাষিও এই খবর ঠিকঠাক পেতেন, তবে কম করে হলেও ২৫ শতাংশ আলু পচনের হাত থেকে রক্ষা পেত বৈকি।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বৃষ্টিতে কম করে হলেও ২৫ শতাংশ আলু খেতেই নষ্ট হয়ে যাবে। পানি যেখানে সহজে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই, সেখানে ক্ষতি হবে ৪০-৫০ শতাংশ আলু। বৃষ্টির পর যেসব কৃষক এই আলু উত্তোলন করবেন, তারাও এগুলো না বাড়িতে, না হিমাগারে সংরক্ষণ করতে পারবেন। ফলে কম দামে কৃষকদের এবার আলু বিক্রি করতে হবে। বাজারে বর্তমানে রকমভেদে প্রতি কেজি আলুর দাম ১৫-৩৫ টাকা হলেও কৃষক বিক্রি করতে পারছেন প্রতি কেজি আলু মাত্র ৭-৮ টাকায়।

মাঘ মাসের এই বৃষ্টিতে আলুর যে ক্ষতি হলো, তার কারণে অসময়ে আলুর দাম অনেক বেড়ে যাবে। অনেক কৃষক আশঙ্কা করছেন যে, জমি থেকে কম দামে এখন সব আলু বিক্রি দিলে, পরে সেই কৃষকরাই আর আলু কিনে খেতে পারবেন না। কারণ, এ বছরের শেষের দিকে আলুর বাজারমূল্য ৫০ টাকা কেজির ঊর্ধ্বে চলে যেতে পারে।

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

যে কৃষক গোটা জাতিকে আলুর যোগান দিয়ে যাচ্ছেন, সেই কৃষকরাই যদি আলু কিনে খেতে না পারেন, তাহলে কৃষকের প্রতি অন্যায় করা হবে না কি? আসলে কৃষকের খবর কে রাখে? আমাদের দেশের কৃষকের নেই কোনো দল, নেই কোনো গোষ্ঠী, নেই কোনো একতা। বর্তমানে কৃষকরা অনেকটাই একা। তাই তাদের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে তেমন পৌঁছায় না।

অন্যদিকে, সরকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য যে প্রণোদনা বা স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে, তার বেশিরভাগ টাকা পদ্ধতিগত নানা জটিলতায় কৃষকের কাছে পৌঁছায় না। এটাই হলো বাস্তবতা।

যারা কৃষক পরিবারে বড় হয়েছেন কিংবা গ্রামে কৃষকের সংস্পর্শে বেড়ে উঠেছেন, তারা জানেন কৃষকের সঞ্চিত কোনো অর্থ থাকে না। যেটুকু ফসল হয় তার ওপর নির্ভর করে সারাবছর পরিবারের সব চাহিদা মেটাতে হয়। যে কারণে বছর শেষে বেশিরভাগ প্রান্তিক কৃষককে বিভিন্নভাবে, নানান জায়গা থেকে অধিক সুদে ঋণ নিয়ে চলতে হয়। অধিকাংশ কৃষকের কিছু কিছু ঋণ সবসময়ই থাকে।

বর্তমান সরকার দেশকে ডিজিটালাইজেশনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার বেশিরভাগ সুবিধা প্রকৃতপক্ষে দরকার গ্রামীণ কৃষক সমাজের। অথচ দুঃখের বিষয় হলো, এই কৃষকরা সেই সুযোগ ঠিকঠাক ভোগ করতে পারছেন না শুধু সঠিকভাবে সেই সুবিধাগুলো কৃষকের কাছে পৌঁছায় না বলে। যদি এই সুবিধাগুলো কৃষকরা ঠিকঠাক পান, তবে কৃষিকে এখনো সব থেকে লাভজনক পেশায় পরিণত করা সম্ভব বলে মনে করি।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh ranks 84th among 127 countries in Global Hunger Index

The level of hunger in Bangladesh this year has been categorised as "moderate"

45m ago