সন্তান দুজনের, তাহলে মাতৃত্বকালীন ছুটি কেন শুধু নারীর?
'নারী দিবসে' নারীর মাহাত্ম্য, 'মা দিবসে' মা হওয়ার মহত্ত্ব নানাভাবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু নারীর মা হওয়ার সময়কালটাকে অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে নেওয়া হয় না। বরং চেষ্টা করা হয় নারী কর্মীরা যেন এই সুবিধা দাবি না করেন বা কাজ ছেড়ে চলে যান। মালিকপক্ষের এই মানসিকতার কারণে অনেক নারী কর্মী গর্ভধারণ নিয়ে পরিকল্পনা ও গর্ভকাল নিয়ে খুবই উদ্বেগের মধ্যে থাকেন।
গর্ভস্থ অবস্থায় এবং শিশু জন্ম নেওয়ার পর একজন শিশুর বেড়ে ওঠার দায়িত্ব শুধু একা মায়ের নয়। তাহলে শুধু সন্তান ধারণ করতে হচ্ছে বলে নারীকে কেন চাকরি নেওয়ার সময় মুচলেকা দিতে হবে, মা হবেন না বলে? মা হতে গিয়ে কেন তাকে কাজের জায়গায় হেনস্থা হতে হবে? কেন তাকে কাজ ছাড়তে বাধ্য করা হবে? কেন তার মাতৃত্বকালীন সুবিধা কেটে নেওয়া বা সংকোচন করা হবে? অথচ 'মাতৃত্বকে মর্যাদা' দেওয়ার ধারণা থেকে এই মাতৃত্বকালীন ছুটির কথা ভাবা হয়েছে।
বাংলাদেশে কাগজে কলমে মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রচলিত। শ্রম আইন ২০০৬ এর ৪৫ ধারা অনুযায়ী চাকরিরত নারী ১২০ দিন পূর্ণ সুবিধাসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু সরকারের দেওয়া এই সুবিধা কর্মক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হচ্ছে? একজন গর্ভবতী নারী কি আদৌ তার জন্য দেওয়া এই অধিকার ভোগ করতে পারছেন? পারলে কতটা?
ধরে নেওয়া হয় মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগের মতো 'দামী' ছুটি ভোগ করার সুযোগ আছে শুধু আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীর। কিন্তু আমরা কি জানি এই শিক্ষিত নারীদেরও কতভাবে বঞ্চিত করা হয়? কর্মক্ষেত্রে তাকে এমন প্রশ্ন করা হয়, যা একজন নারীকে মা হওয়ার ব্যাপারে দশবার ভাবতে বাধ্য করে।
কর্মরত নারীটি ভাবতে বাধ্য হন বাচ্চা হবে এমন খবর শোনার পর তার চাকরিটা থাকবে তো? অফিস তাকে মাতৃত্বকালীন ছুটি পুরোটা দেবে তো? ছুটি দিলেও বেতন কেটে রেখে দিবে কিনা? অথচ বর্তমানে নারী শক্তির হাত ধরেই দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে।
নারীশক্তি দ্বারা চালিত এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী সবচেয়ে বড় উৎস, অর্থাৎ তৈরি পোশাক শিল্প কারখানাতেই নারীর অবস্থা সবচেয়ে করুণ। এই খাতে কাজ করছেন, এরকম অনেক নারী আছেন যারা গর্ভবতী হওয়ার কারণে চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছেন। অনেকেই কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
কেউ কেউ বাচ্চা হওয়ার ২ মাসের মাথায় চাকরি রক্ষার জন্য কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক নারী শ্রমিককে বিদেশি ক্রেতাদের ভয়ে গর্ভকালীন সময়ের আর্থিক সুবিধাদি দেওয়া হলেও, তাদের বেতন কেটে রাখা হয়। যদিও মালিকপক্ষ বলে যে তারা সুবিধা দিতে চায়, কিন্তু নারী শ্রমিকরা এইসব দাবি না জানিয়েই কাজ ছেড়ে চলে যান।
অথচ যেসব সংস্থা গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তারা দেখেছেন, গর্ভবতী নারীর প্রতি এমন আচরণ করা হয় যে, তিনি গর্ভধারণ করে অপরাধ করেছেন।
এতো গেল তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার কথা, এবার বলি চা বাগানের নারী শ্রমিকদের কথা। চা শিল্পে কর্মরত নারীর সংখ্যা পুরুষের সমান বা বেশি। 'দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশের' ছবি বলতে চা বাগানের নারীদের ছবি ভেসে উঠলেও তাদের জীবনের বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন জীবনের ছবি খুব কষ্টের।
শুধু মৌলভীবাজারের ৯৩টি চা বাগানের নারী শ্রমিকেরা মাতৃত্বকালীন ছুটিতে না গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। কখনো বাগান কর্তৃপক্ষের চাপে আর কখনো মজুরির আশায় তারা দিনের আট ঘণ্টা পরিশ্রম করছেন। গর্ভকালীন সময়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন টানা আট ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পরিশ্রম করায় মা ও গর্ভের সন্তান দুজনেরই ক্ষতি হয়। (বাংলানিউজটোয়েনটিফোর)
দেশের প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী প্রসূতি কল্যাণের অংশ হিসেবে একজন নারী শ্রমিককে প্রসবের আগের আট সপ্তাহ ও প্রসব পরবর্তী আট সপ্তাহ ছুটি দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, গর্ভকালীন সময়ে সর্বসাকুল্যে ছয় সপ্তাহের ছুটি দিয়ে থাকে। তাও সবেতন ছুটি নয়। একজন নারী শ্রমিককে গর্ভবতী হলেও বেতনের জন্য তাকে প্রসব পূর্ব অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে বাগানে কাজ করতে হয়।
দেশের হাতেগোনা কিছু বেসরকারি সংস্থা ও বড় মাপের কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান ছাড়া সুযোগ-সুবিধাসহ নারী কর্মীদের ১২০ দিন গর্ভকালীন ছুটি দেওয়া হয় না বললেই চলে। কেউ কেউ দিলেও সুবিধাদি কেটেছেঁটে দেয়। চাকরিদাতারা এই ছুটি দেওয়ার জন্য আইনত বাধ্য হলেও অধিকাংশ কর্তৃপক্ষ এটা মানে না।
অথচ বাংলাদেশ লেবার ফোর্স সার্ভের (২০১৬-১৭) হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট শ্রমশক্তি হচ্ছে শতকরা ৫৮.৩। এর মধ্যে পুরুষ ৬৫ শতাংশ আর নারী ৩৫ শতাংশ। মোট শ্রমশক্তির মধ্যে ৩১.৭ শতাংশ ইয়ুথ বা তরুণ শ্রমশক্তি। এই তরুণ শ্রমশক্তির মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা শতকরা ১১ ভাগ বা ৭০ লক্ষ।
আমাদের এখন মূল আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত এই ৭০ লক্ষ ইয়ুথ নারী কর্মশক্তিকে নিয়ে। তারা কি ভবিষ্যতে মা হওয়ার কথা ভাববেন, নাকি চাকরি হারানোর ও পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভয়ে তারা চাকরির মাঠ ছেড়ে দিতে চাইবেন?
কারণ আমাদের দেশের কর্ম-সংস্কৃতিতে দেখা গেছে বা যাচ্ছে নারী কর্মী বা শ্রমিকের বিশেষ একটি সময়ের জন্য কিছু ছুটি-সুবিধাদি দরকার হয়, তখন মালিকপক্ষ তা দিতে গড়িমসি করেন। সরকার জেন্ডার সমতা আনার জন্য সুবিধাসহ মাতৃত্বকালীন ছুটির কথা বারবার বলছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি তুলে ধরার জন্য নীতি এবং কর্মসূচি নির্দিষ্ট করাটা এখন বৈশ্বিক আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
নারীকে অর্থনৈতিকভাবে আরও সক্ষম করে তোলার জন্য নারীর ওপর থেকে কাজের দায়ভার কমানো এবং পারিবারিক কাজের পুনঃবণ্টন করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে, যেন নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আসে এবং নানা ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ পায়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার সমতার আলোকে সরকারের ছয়টি মন্ত্রণালয়ের বাজেট (জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০১৯) পুনর্মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করেছে। এই পুনর্মূল্যায়ন থেকে চারটি বিষয় উঠে এসেছে। যেমন: অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা, জনপ্রশাসন ও গৃহস্থালি কাজে নারী-পুরুষের সমান দায়িত্বভাগের বিষয়টি তুলে ধরা।
কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেন নারী অর্থনৈতিক কাজে ব্যাপকহারে এগিয়ে আসতে পারেন। যেমন শিশুবান্ধব কর্মক্ষেত্র, ডে-কেয়ার সুবিধা, মাতৃত্বকালীন সময়ে নারীর জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থাসহ অনেক কিছু।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় এসব বাধ্যবাধকতা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিভিন্ন সনদের শ্রম মানদণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে, যেমন: মাতৃত্ব সুরক্ষা সনদ নম্বর ১৮৩ (২০০০), যার লক্ষ্য নারী কর্মীদের জন্য যথাযথ সুরক্ষা, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুবিধা নিশ্চিত করা।
এত আইন, এত সনদ থাকার পরও একজন গর্ভবতী নারী তার প্রতিষ্ঠান থেকে কতটা সুবিধা ভোগ করতে পারছেন? মায়ের এই ছুটিটা কিন্তু এমনি এমনি দেওয়া হয় না। দেওয়া হয় এজন্য যে সন্তানসম্ভবা মা যেন কাজের জগত থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে এবং সন্তানকে পরিপূর্ণভাবে সময় দিতে পারেন। একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য মায়ের যত্নটা সবচেয়ে জরুরি।
সবশেষে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলছি। ২৬ বছর আগে সন্তান জন্মানোর তিন মাসের মাথায় যখন নতুন করে কাজের খোঁজ করছি, তখন একটি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ডেকে বললেন, মেয়েদের চাকরি দেওয়াতো খুব ঝামেলার ব্যাপার। বাচ্চাকাচ্চা হবে, ছুটি দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি চাকরি পাওয়ার জন্য এতটাই মরিয়া ছিলাম যে বললাম, আমাকে নিয়ে সেই ভয় নাই। আমার সবেমাত্র বাচ্চা হয়েছে। আগামী পাঁচবছরের মধ্যে আর হবে না। কথা সত্য, এরপর আমার আর কোনো সন্তানই হয়নি। সেই প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য এখন মাতৃত্বকালীন ছুটি দিচ্ছে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে অবস্থা এখনো সেই ২৬ বছর আগের মতোই রয়ে গেছে।
অধিকাংশ কাজের জায়গায় নারীকে যদি তার নিজের এই মৌলিক সুবিধার জন্য যুদ্ধ করতে হয় বা অবনত হতে হয়, তাহলে দেশে নারী শ্রমশক্তির হার কমতে বাধ্য হবে এবং সরকারের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বপ্ন পূরণ হবে না।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments