যে কারণে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে ইউক্রেন

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য জোরালোভাবে ইউক্রেনকে কথা দিয়েছিল, আক্রান্ত হলে 'পাশে' থাকবে। ইউরোপের শক্তি জার্মানি, ফ্রান্সসহ পুরো ইউরোপ নরম সুরে 'পাশে' থাকার অঙ্গীকার করেছিল।

ইউক্রেন আক্রান্ত হয়েছে। আগ্রাসী পুতিনের আগ্রাসনে ইউক্রেন তছনছ হয়ে গেছে। স্থলভাগের আগ্রাসন এক সঙ্গে ৩ দিক থেকে এবং আকাশে অত্যাধুনিক রুশ যুদ্ধবিমান। সঙ্গে ক্ষেপনাস্ত্র হামলা।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ একের পর এক নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিচ্ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। তারা যত জোর দিয়ে আরও নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিচ্ছে, তারচেয়ে জোর দিয়ে চলছে পুতিনের আক্রমণ। আমেরিকা, ন্যাটো নিশ্চিত করেছে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানো হবে না। ইউরোপের পরাশক্তি জার্মানি, ফ্রান্স নিরবতা ভেঙে 'পাশে' থাকার অংশ হিসেবে অস্ত্র পাঠাচ্ছে ইউক্রেনে।

ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক শক্তির কোনো তুলনাই চলে না। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিভুক্ত ইউক্রেন এক সময় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউরোপের চাপে তারা এখন পারমাণবিক অস্ত্রহীন দেশ। গ্যাসের মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে কিছু পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়াকে দিতে বাধ্য হয়েছিল, কিছু ধ্বংস করেছিল। আজ রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেন অসহায়। রাশিয়া দাবি করেছে, ইতোমধ্যে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে।

অসম শক্তি হয়ে রাশিয়ান আগ্রাসন প্রতিরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে ইউক্রেন। রাশিয়ান ট্যাংক পৌঁছে গেছে রাজধানী কিয়েভের কাছে। রাশিয়ান আগ্রাসন প্রতিরোধ করে টিকে থাকার সামর্থ্য ইউক্রেনের নেই। জো বাইডেন প্রস্তাব দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট জেলোনস্কিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার। জেলোনস্কি দেশবাসীকে ফেলে এভাবে পালাতে চাননি, যুদ্ধাস্ত্র চেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ যা দিতে শুরু করেছে।

এই অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেন রাশিয়াকে প্রতিরোধ করতে পারবে? সাধারণ নাগরিকদের হাতে এই অস্ত্র তুলে দেওয়ার তাৎপর্য কী?

আগ্রাসনের ২ দিনের মধ্যে ইউক্রেন বুঝে গেল তার ২ লক্ষাধিক সামরিক বাহিনীর সদস্য রাশিয়াকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম নয়।

প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী যেখানে সক্ষম নয়, সেখানে প্রশিক্ষণহীন জনগণ অস্ত্র হাতে রাশিয়াকে প্রতিরোধ করবে?

নিঃসন্দেহে সাধারণের গেরিলা যুদ্ধ রাশিয়ার বিপদের কারণ হতে পারে। কিন্তু কতটা?

'পাশে' থাকাওয়ালারা অস্ত্র সরবারাহের আগে থেকেই হুংকার দিচ্ছে, কঠিন মূল্য দিতে হবে রাশিয়াকে। দেওয়া হবে কঠোর থেকে কঠোরতম অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া কঠিন বিপদে পড়বে কি পড়বে না, সেই বিতর্কে যাব না। ধরে নিচ্ছি, রাশিয়া কঠিন বিপদে পড়বে। অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার চীনের একচ্ছত্র সহায়তা ও সমর্থনেও তার বিপদ কাটবে না। এই বক্তব্য সত্য হলে, অর্থনৈতিকভাবে ভয়াবহ বিপদে পড়বে রাশিয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মৌলিক প্রশ্ন একটি, এতে ইউক্রেনের কী লাভ বা উপকার হবে?

রাশিয়া দুর্বল হলে লাভ হবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইউরোপের। রাশিয়াকে চাপে রাখা তাদের জন্য সহজ হবে। আর এই সময়কালে ইউক্রেনের ভাগ্যে কী ঘটবে?

দুটি অঞ্চল রাশিয়ার সমর্থনে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। ক্রিমিয়া রাশিয়ার দখলে। বোমা-গুলিতে শুধু ইউক্রেনের অবকাঠামো নয়, অর্থনীতিও ধ্বংস হয়ে যাবে। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী পোল্যান্ডসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে শরনার্থীর জীবন কাটাবে। নিহত-আহতের সংখ্য হাজার না লাখে হিসাব হবে, তা বলা মুশকিল।

তাহলে 'পাশে' থাকার গল্পটা কী? বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ পারমানবিক শক্তিধর রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স বা জার্মানি যে যুদ্ধে জড়াবে না, তা পরিস্কারই ছিল।

'পাশে' থাকার এই গল্প সার্বজনীন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটু মিলিয়ে দেখেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত, চীন, রাশিয়া, আশিয়ানভূক্ত দেশগুলো সবসময় বলে বাংলাদেশের 'পাশে' আছি। আসলে তারা কেউ বাংলাদেশের সঙ্গে নেই। তারা আছে মিয়ানমারের সঙ্গে। কারণ মিয়ানমারে তাদের স্বার্থ আছে। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের 'পাশে' থাকার কথা বলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কথা বলে। এর তাৎপর্য হলো, তাদের অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষে নয়। চীনের একক আধিপত্যে যেহেতু তারা মিয়ানমারে তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারছে না, ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলছে। এখানে রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশ তাদের বিবেচনার বিষয় নয়। তাদের মূল বিষয় নিজেদের স্বার্থ।

ঠিক একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সম্পূর্ণ নিজেদের স্বার্থে ইউক্রেনকে ব্যবহার করতে চেয়েছে।

মহৎ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ইউক্রেনীয়দের ভাগ্যেন্নয়নে বা ভালোবাসে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ তাদের ন্যাটো জোটে নিতে চেয়েছে, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়ার আগ্রহ ইউক্রেনের যতটা ছিল, হয়ত তার চেয়ে বেশি ছিল 'পাশে' থাকার প্রতিশ্রুতি যারা দিয়েছিল তাদের। পর্দার সামনে পেছনে নিশ্চয় আলোচনা হয়েছে। রাশিয়ার গা ঘেঁষে যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটোর সৈন্য থাকবে এমনটা বাস্তবে অসম্ভব, তা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র জানতো। জানতো ইউক্রেনও। কারণ রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল প্রকাশ্যে। কোনো রকম রাখঢাক গোপণীয়তা ছাড়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত হয়েছে ইউক্রেন। আগ্রাসী একনায়ক পুতিন যে আগ্রাসন চালাতে পারে, তা জেনে বুঝেই যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে বিপদে ফেলেছে।

আগ্রাসী পুতিন কি বিজয়ী হয়ে ফিরবেন ইউক্রেন থেকে? ইতিহাস তা বলে না। আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়ে ইতিহাসের লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল মহাপরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নকে। আফগানিস্তান থেকে লজ্জা নিয়েই ফিরে যেতে হয়েছে পৃথিবীর প্রায় একক অধিপতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়ার উদাহরণও সামনেই আছে। কোনো পরাশক্তি আগ্রাসন চালিয়ে বিজয়ী হতে পারেনি। তাহলে আফগানিস্তান বা সিরিয়া, লিবিয়া বা ইরাকে বিজয়ী হলো কে? আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় এসেছে বা সিরিয়ায় আসাদ ক্ষমতায় টিকে আছে, তারা কী আসলে বিজয়ী হয়েছে? এখানে হিসেবটা জয় বা পরাজয়ের নয়। তালেবানরা ক্ষমতায় এসেছে, আসাদ টিকে আছে, আফগানিস্তান বা সিরিয়া ধ্বংস হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার পছন্দের সরকার ক্ষমতায় বসিয়েছে, কিন্তু ধ্বংস হয়ে গেছে ইরাক বা লিবিয়া।

পুতিন হয়ত ইউক্রেনে তার পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে বা আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবে একনায়ক পুতিনের। ইউক্রেনের বর্তমান শাসকরা শেষ পর্যন্ত হয় নিহত হবেন বা ইউরোপের কোনো দেশে আশ্রয় নেবেন।

ইউক্রেনীয় বা ইউক্রেন দেশটির অবস্থা কী হবে?

বেসামরিক লোকজনদের অস্ত্র সরবারাহের উদ্যোগ ইউক্রেনের ভাগ্যে বিপর্যয় ডেকে আনবে। ইউক্রেন যদি আর কখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, তার অন্যতম কারণ হবে এই অস্ত্র সরবরাহ।

যুদ্ধ যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলে, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে ইউক্রেন। রাশিয়া যদি অল্প সময়ের মধ্যে ইউক্রেন ছেড়ে চলে যায়, তবুও ইউক্রেনের ভেতরে যুদ্ধ বন্ধ হবে না। রুশ বিরোধী, রুশ সমর্থক সবার হাতে থাকবে অস্ত্র। রুশ বিরোধীদের এখন অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ। পক্ষের গ্রুপগুলোকে আরও অস্ত্র দেবে রাশিয়া। ইউক্রেনের ভেতরে যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ স্থায়ী রূপ নেবে। ইউক্রেন ভেঙে রাশিয়া আরও কয়েকটি স্বাধীন দেশ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে, সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কূটকৌশলেই বিস্তৃতভাবে অস্ত্র ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইউক্রেনের সাধারণ জনগণের মাঝে। নববিবাহিত দম্পতি, সংসদ সদস্য, সাবেক রাষ্ট্রপতি দেশ রক্ষায় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন—মহত্বের রং লাগিয়ে এসব সংবাদ প্রচার করছে মার্কিন ও ইউরোপের গণমাধ্যম। আর ক্রমশ ইউক্রেন দখল করে নিচ্ছে রাশিয়া। ইতিহাস বলে, সবচেয়ে করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে সাধারণ ইউক্রেনীয়দের। ইতোমধ্যে পোল্যান্ডে লক্ষাধিক শরনার্থী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ তাদের পুঁজি করে রাজনীতি করবে। ইউক্রেনে তাদের ফিরে আসার কার্যকর উদ্যোগ নেবে না। অস্ত্রধারী ইউক্রেনীয়রা বহু দলে-গোত্রে বিভক্ত হয়ে নিজেরা রক্তাক্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র তার পছন্দের গ্রুপগুলোকে আরও অস্ত্রের যোগান দিয়ে যাবে। প্রতিপক্ষের কাছে অস্ত্রের যোগান আসবে রাশিয়া থেকে। যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ ইউক্রেনে স্থায়ী রূপ নেবে। পুতিনের জয়-পরাজয় বা পতন যাইহোক না কেন, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ইউক্রেন।

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

7h ago