বিয়ের পর শুধু ছাত্রীদেরই হলে থাকা অপরাধ কেন

Dhaka University logo

বিয়ের পর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কি অপরাধ? যদি অপরাধ না হয়, তাহলে বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকা নিষিদ্ধ কেন? আর যদি অপরাধ হয়, তাহলে ছাত্রদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। সব নিয়ম শুধু ছাত্রীদের জন্য কেন?

বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে আসন বণ্টন নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ছাত্রী বিবাহিত হলে অবিলম্বে কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। অন্যথায় নিয়ম ভঙ্গের কারণে তার সিট বাতিল হবে। শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহিত ছাত্রীকে চলতি সেশনে হলে থাকার সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ছাত্র হলগুলোতে এই ধরনের কোনো নীতিমালা নেই।

প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন ছাত্রদের জন্য এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে বিয়ে যদি ছাত্রীর জন্য অপরাধ হয়, তাহলে ছাত্রের জন্যও তা অপরাধ হওয়া উচিৎ।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি দেশের সংবিধান বিরোধী আইন করতে পারে? দেশের সংবিধান প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে। সেখানে কেন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই বৈষম্যমূলক নীতি? সংবিধানের ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী আগের সব আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ।

এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ছাত্রীর অন্তঃসত্ত্বা হওয়াও আরেকটি অপরাধ। বিয়ে হলে একজন নারী মা হতেই পারেন। মাতৃত্ব কোনো লুকিয়ে রাখার বিষয় নয়। মা এবং তার সন্তান সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পত্তি। তাদের ২ জনকে সুস্থভাবে রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কেন অন্তঃসত্ত্বা মাকে হলে থাকতে দেবে না? কোন আইনে মায়ের এই অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে তারা? আমরা কি দিনে দিনে অগ্রসর হচ্ছি, নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি? বিশ্বের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কি এমন নিয়ম আছে? একদিকে দেশ উন্নত বিশ্ব হবে বলে ধাবিত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতি চালানো হচ্ছে ছাত্রীদের উপর।

কোনো অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রী যদি হলে থেকেই থাকেন, সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবাসিক ডাক্তারের প্রতি নির্দেশনা দেবে যেন তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয় এবং বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়। তবে হ্যাঁ, এই সময় নারীর বিশেষ যত্নের দরকার হয়। যেকোনো সময় যেকোনো জরুরি অবস্থা তৈরি হতে পারে। সে জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করারও দরকার আছে। আমরা জানি মা হওয়ার সময় পরিবারের কাছেই একজন মেয়ের থাকা উচিৎ। কিন্তু যদি কোনো কারণে কোনো ছাত্রী থাকতে না পারে, তাহলে সে কোথায় থাকবে হল ছাড়া?

এক্ষেত্রে কোনোভাবেই সিট বাতিল করা যাবে না। হলে থাকা অবস্থায় নিশ্চয় হরদম ছাত্রীরা মা হন না। খুব অল্প কয়েকজন ছাত্রী হয়তো কালেভদ্রে মা হন। তাদের দেখভালের দায়িত্ব না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উল্টো হল থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার যে তাল করছে, তা অন্যায়।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়সের পর নারীদের বিয়েতে আইনগত কোনো বাধা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় অনেক ছাত্রীরই বিয়ে হয়ে যায়। এর সঙ্গে তার শিক্ষার সব অধিকারের কোনো ধরনের সংঘর্ষ হওয়ার কারণ নেই। বরং আমরা চাই বিবাহিত হলেও নারীরা যেন পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন।

নানান কারণে একটি মেয়ের পড়ার সময় বিয়ে হতে পারে। মেয়েটির পরিবার বা স্বামীর পরিবার ঢাকা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহরে নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই ছাত্রী কোথায় থেকে তার পড়াশোনা শেষ করবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবাহিত ছাত্রীদের হলে থাকার যে বিধি-নিষেধ এবং প্রচলিত নিয়ম, তা নিয়ে নতুন করে হৈচৈ শুরু হওয়ায় সবার সামনে এই অদ্ভুত নিয়মটি উঠে এলো।

ছাত্রীর বিবাহিত হওয়ার সঙ্গে তার হলে থাকা না থাকার কোনো সম্পর্ক বা যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। একজন ছাত্রী বিবাহিত না অবিবাহিত, তা দেখে কেন হলে সিট বরাদ্দ হবে? হলে তো মেধা অনুযায়ী বৈধ সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। হলে সিট পাওয়া ছাত্র বা ছাত্রীর অধিকার। এটা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো দয়ার বিষয় নয়।

করোনার দীর্ঘ ছুটিতে অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি বাল্যবিয়ের শিকার হলেও তারা যেন আবার পড়াশোনার জগতে ফিরে আসতে পারে, তাদের প্রণোদনা দেওয়ার দাবি তুলছি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিয়ে হয়ে গেলে ছাত্রীর জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ভাবতেই অবাক লাগে!

প্রশ্ন উঠেছে একজন বিবাহিত ছাত্রীর যদি হলে থাকা অপরাধ হয় তাহলে হলের হাউস টিউটর ও প্রভোস্টরা বিবাহিত হয়ে হলের আবাসে থাকছেন কিভাবে? তাদেরও নিশ্চই অবিবাহিত হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি তাহলে এমন নিয়ম করে দেবে যে বিবাহিত হলে হাউস টিউটর ও প্রভোস্টরা হলের কোয়ার্টারে থাকতে পারবেন না? ছাত্রীদের পক্ষ থেকে এই দাবি মোটেই অযৌক্তিক নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নানান ধরণের সমস্যা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী আসন না পাওয়া, গাদাগাদি করে থাকা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নোংরা টয়লেট, ডাইনিংয়ে খাদ্যের নিম্নমান, মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদের রুম দখল করে রাখা, শক্তিধরদের অন্যায় অত্যাচার, ক্যাডারদের পেশি শক্তি প্রয়োগ—কোনোটিই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফয়সালা করতে পারে না। শুধু পারে ছাত্রীদের ওপর নিয়ম চালু করতে।

প্রশাসনের উচিৎ সেইসব শিক্ষার্থীকে টার্গেট করা, যারা হলে সিট পেয়েও হলে থাকে না বা অন্যদের থাকতে দেয়। এটা অন্যায়। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। হলে সিট কম এবং গাদাগাদি করে থাকার সমস্যা নিয়ে কখনো কি কেউ কথা বলেছেন? সেখানে নীতি-নৈতিকতা কোথায় ছিল বা আছে?

হলের ডাইনিংয়ে মানহীন খাবার নিয়ে নাটক, সিনেমা, জোকস অনেক হয়েছে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন কি হয়েছে? শুনছি এখন অবস্থা আরও খারাপ। শিক্ষার্থীরা কিনে বা রান্না করে খেতে বাধ্য হন। বাইরে খেয়ে বা হলের ডাইনিংয়ের বাজে তেলের রান্না খেয়ে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এসবই পত্রিকায় প্রকাশিত খবর।

ছাত্রীদের হলে প্রবেশের নিয়ম নিয়েও কর্তৃপক্ষ অনেক কঠোর নিয়ম বিধান দিয়েছেন। অথচ ছাত্রদের ব্যাপারে কোনো বিধি-নিষেধই নেই। বিবাহিত ছাত্রীর হলের আসন বাতিল রোধ করার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এখন আরও এমনকিছু দাবি তুলেছেন যা খুবই ন্যায়সঙ্গত। একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে তারা এই দাবি তুলতেই পারেন।

তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে, শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মর্যাদা রক্ষায় সব ছাত্রী হলে 'লোকাল গার্ডিয়ান' বা 'স্থানীয় অভিভাবকের' পরিবর্তে 'ইমার্জেন্সি কন্টাক্ট' বা 'জরুরি যোগাযোগ' শব্দটি রাখা, আবাসিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা যেকোনো ধরনের হয়রানি ও অসহযোগিতামূলক আচরণ বন্ধ করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং শিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকা সাপেক্ষে অনাবাসিক ছাত্রীদের হলে প্রবেশের অধিকার পুনর্বহাল করা ও জরুরি প্রয়োজনে তাদের হলে অবস্থান করতে দেওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক উপাচার্য ছাত্রীদের ৪ দফা দাবির জবাবে বলেছেন, হল কর্তৃপক্ষ ও ডিনস কমিটির সভায় আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি বলছেন, 'আমাদের পূর্বপুরুষেরা মূল্যবোধ ও সামাজিক দিক বিবেচনায় নিয়মগুলো অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সেখানে অনেক ভালো নিয়মও আছে। তবে বর্তমান সময়ে তা যৌক্তিক কি না, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে।' তবে এই 'তথাকথিত জনহিতকর নিয়ম' কবে থেকে চালু হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানেন না বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

পূর্বপুরুষদের নেওয়া এই নিয়ম কতটা মূল্যবোধকেন্দ্রিক, সে আলোচনায় না গেলেও আমরা আশা করবো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে মানবিক ও অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে বৈষম্যমূলক ও অপ্রয়োজনীয় আইন এবং নীতিমালা শিথিল নয়, বাতিল করতে হবে। তা না হলে এর প্রয়োগ হতেই থাকবে যে কারো হাতেই। ছাত্রীদের টার্গেট করে, নারীর অধিকার বিরোধী কোনো আইন আমাদের কাম্য নয়।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Specific laws needed to combat cyber harassment

There is an absence of a clear legal framework and proper definitions when it comes to cyber violence against women, speakers said at an event yesterday.They urged for specific legislation to combat such crimes..The roundtable, titled “Scanning the Horizon: Addressing Cyber Violence agains

2h ago