নারীর পোশাক বিতর্ক: যত দোষ নন্দ ঘোষ

ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ফুটেজ নিয়ে তোলপাড় চলছে চারদিকে। ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব পরে ক্লাসে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যম সরগরম হয়ে উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে খুবই যুৎসই কথা বলেছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। তিনি মুসলিম শিক্ষার্থীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে টুইট করেছেন। টুইটে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেন, 'তারা কী পোশাক পরবেন, তা তাদের নিজেদের পছন্দের বিষয়। এই অধিকার সংবিধানের মাধ্যমে সুরক্ষিত।'

এছাড়াও টুইটে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেছেন, 'বিকিনি হোক, ঘোমটা হোক, জিনস হোক বা হিজাব হোক; তিনি কি পরতে চান, তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একজন নারীর। নারীদের প্রতি হয়রানি বন্ধ করুন।'

আমাদের কাছেও ঠিক এই প্রশ্নটাই গুরুত্বপূর্ণ। নারীর পোশাক নিয়েই সবসময় এত বিতর্ক ও সমালোচনা কেন? আজকে যদি এই মেয়েটাই বোরকা বা হিজাব পরিহিত না হয়ে প্যান্ট-শার্ট পরা হতো, তখন হয়তো এই গেরুয়া ঝাণ্ডা হাতে জয় শ্রীরামধারীরা না হয়ে, অন্য কোন পোশাকধারী ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা উন্মত্ত হয়ে উঠত।

এই ধরণের হিংসার মনোভাবাপন্ন অমানুষদের লক্ষ্য একটাই, তা হচ্ছে নারীকে লাঞ্ছনা করা, সেটা ভারতই হোক, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানেই হোক। এরা কখনো ধর্মকে, কখনো উৎসব, কখনো রাজনীতিকে আশ্রয় করে নারীকে হেনস্থা করার উপায় খুঁজে বের করে।

ভিডিও ফুটেজে দেখা গেল, এক মুসলিম ছাত্রী বোরকা ও হিজাব পরে স্কুটি চালিয়ে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতেই হেনস্তার মুখে পড়ে। তার উদ্দেশ্যে একদল উন্মত্ত তরুণ জাফরান রঙা স্কার্ফ নেড়ে 'জয় শ্রীরাম' বলে চিৎকার করতে করতে ধাওয়া করছে। মনে হচ্ছিল, তারা মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে দূরে সরে যেতে যেতে 'আল্লাহু আকবর' বলে পাল্টা জবাব দেয়। পরে মেয়েটিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ নিরাপদে সরিয়ে নেয়।

সম্প্রতি কর্ণাটক রাজ্যের উদুপি জেলার একটি সরকারি কলেজের কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম-সংক্রান্ত কিছু বিধিবিধান জারি করেছিল, তা আমরা অনেকেই সেভাবে জানতাম না। ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া বোরকা পরিহিত মেয়েটির তেজোদীপ্ত সেই 'আল্লাহু আকবর' স্লোগানটি দেখে সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এই ঘটনার প্রতি।

সেই বিধিবিধানে বলা হয়েছিল হিজাব পরে ক্লাস করা যাবে না। কারণ, তা বৈষম্য সৃষ্টিকারী। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী, ছাত্রীরা 'স্কার্ফ' পরতে পারবে। এই নিয়মের প্রতিবাদ জানায় মুসলমান ছাত্রীরা। এ নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের আরও কয়েকটি জায়গাতে।

বিজেপি'র ভারত এতটাই হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে উঠেছে যে, হিজাবের বিরুদ্ধে হিন্দু শিক্ষার্থীদের একাংশকে গেরুয়া চাদর ও ওড়না পরতেও দেখা গেছে। দুই ধর্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তর্কাতর্কিও হয়েছে কোথাও কোথাও।

শুধু কি ভারতে? আমাদের দেশেও মেয়েদের পোশাক, সাজসজ্জা নিয়ে কথার অন্ত নেই। কিছুদিন আগেও জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী তার মায়ের সঙ্গে ফেইসবুকে ছবি দেয়ার পর চারদিকে হট্টগোল শুরু হলো। বিষয় হচ্ছে চঞ্চল চৌধুরীর মা সিঁথিতে সিঁদুর ও টিপ দিয়েছেন বলে। কিন্তু কেন এমনটা হবে? একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীতো সিঁদুর পরবেনই। এটা নিয়ে কথা বলতে হবে কেন ? তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে কেন?

যারা হিজাব পরতে চাইবেন, তারা তা পরবেন, যারা পরতে চাইবেন না, পরবেন না। ইসলাম ধর্ম জোরজবরদস্তির পক্ষে না। অথচ মেয়েদের পোশাক ও চলাফেরা নিয়ে জোরজবরদস্তি, বাজে মন্তব্য চলমান।

এ প্রসঙ্গে নিজের একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার না করে পারছি না। একদিন ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বেঞ্চের উপর বসে থাকা হিজাব পরিহিত একজন অপরিচিত নারী আমাকে বললেন, 'মাথায় কাপড় দিয়া চলেন না কেন? গোনাহ হইবো।' আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চলেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ থেমে বললাম,'আপনি যে হিজাব পরেছেন, আমি কি তা সরাতে বলেছি? বলি নাইতো। কারণ এটা পরা আপনার ইচ্ছা। তাহলে আপনি আমাকে মাথায় কাপড় দিতে বলবেন কেন? আপনি আমাকে চেনেন না তাও উপদেশ দিচ্ছেন কেন? আপনার ইচ্ছা হলে আরও একটা হিজাব পরেন। কিন্তু অন্যকে এসব নিয়ে কথা বলবেন না।'

এই ঢাকা শহরে টিএসসি প্রাঙ্গনে বহুবছর আগে নববর্ষ উদযাপনের রাতে বাঁধনকে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল যখন, তখন অনেকেই বাঁধনকে দায়ী করেছিলেন এবং বাঁধনের বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন। এ যাবৎকালে দেশে যতোবার নারী নিগৃহীত, নির্যাতিত, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে, ততোবার সমাজ নারীকেই দায়ী করেছে।

মেয়েটি শার্ট-গেঞ্জি, জিনস পরে ঘুরবে কেন? পুরুষতো পেছনে লাগবেই। মেয়েটির শাড়ি পরার ঢং উগ্র কেন? পুরুষতো কথা বলবেই। জামা পরে ওড়না নেবে না কেন? ছেলেরাতো বুকের দিকে তাকাবেই। মেয়েরা স্কার্ট পরবে কেন? পুরুষতো শরীরে হাত দেবেই। মেয়েটা দুই পা ফাঁকা করে মোটরসাইকেল চালায়, এ মেয়ের স্বভাব ভালো না। মেয়েটা মাহরাম সঙ্গী ছাড়া একা একা ঘুরে? ছি ছি সত্বীত্ব নাই নাকি এই মেয়ের! যতো দোষ নন্দ ঘোষ। কিন্তু নিয়মিত পর্দা-পুসিদার মধ্যে থাকা মেয়েরাও কি ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে পারেন?

মেয়েরা গলার স্বর উঁচু করে যখন ধর্ষণবিরোধী মিছিলে স্লোগান দেয়, যখন রাত জেগে গণজাগরণ মঞ্চ কাঁপিয়ে স্লোগান দিয়েছে তারা, তখনো আমার পরিচিত একজন শিক্ষিত মানুষকেই বলতে শুনেছি, 'মেয়েদের কি এভাবে রাস্তায় নেমে গলা বাড়ানো ধর্মসম্মত?'

তাহলে মুসকানের এই প্রতিবাদী 'আল্লাহু আকবার' স্লোগানকে এই মানসিকতার লোকগুলো এখন কী চোখে দেখছেন? কম বয়সী এই মেয়েটা স্কুটি থেকে নেমে এতগুলো উম্মাদ ছেলের সামনে গিয়ে চিৎকার করে, হাত উঁচু করে বলছে- 'আল্লাহু আকবার'।

আর এই ধ্বনির মাধ্যমে মুসকান শক্তি খুঁজে পেয়েছে তার বিশ্বাসের পক্ষে। মুসকানের এই ভিডিও অনেক শেয়ার হয়েছে। ঘাড় উঁচু করে, হাত উপরে তুলে, কোনোরকম ভয় না পাওয়ার এই শক্তিকে অনেকেই প্রশংসা করেছেন, পোষ্টার করেছেন ও কবিতা লিখেছেন।

অথচ এই মেয়েটিকেও ফেইসবুকে কুরুচিকর মন্তব্য করতে ছাড়েনি সেই দানবেরা, যারা পুরুষ হয়ে দেখেছে মেয়েটির বুক, পিঠ, কোমর। চোখে পড়েনি তার সাহসিকতা ও বিপ্লব। এক আহাম্মক বদমায়েশ ফেইসবুকে মন্তব্য করেছে বোনটির প্রতিবাদের ভিডিওটি দেয়া ঠিক হয়নি। এতে বাতাসে তার বুকের কাপড় সরে গেছে। আর এই পোষ্টে লাইক দিয়েছে আরো ৫৬ জন শয়তান।

শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালে হেফাজত যখন নাদিয়া ছাড়াও ৩ জন নারী সাংবাদিককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিল, তখন কিন্তু এদেশের অনেকেই মন্তব্য করেছিল, হেফাজতীরা ধর্ম নিয়ে কাজ করে, তাদের অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে মেয়েদের পাঠানোর দরকার কী ছিল?  হেফাজতের রাজনীতি তাদের মৌলবাদী মনোভাব সম্পর্কে সবাই জানে। অথচ তখন কিন্তু তারা হেফাজত সমর্থক হয়ে নারী রিপোর্টারদের বিরোধিতা করেছে। হেফাজতকে সমর্থন করা আর জয় শ্রীরাম স্লোগানধারীদের সমর্থন করা একই ব্যাপার। এরা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

হিজাব পরা নিয়ে কর্ণাটকের এই ঘটনা সামনে আসার পর ভারতজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। শাহরুখ খান লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্যে গিয়ে থু থু ছিটিয়েছেন বলে একশ্রেণীর কট্টর হিন্দুত্ববাদী যখন গুজব ছড়িয়েছে, সেটা নিয়েও সকলপক্ষ সোচ্চার হয়েছেন। হিজাব-বিতর্কের অবসানে কিছু মুসলমান ছাত্রী কর্ণাটক হাইকোর্টে মামলাও করেছে।

মুসকান নির্ভীক চিত্তে বলেছেন উত্ত্যক্তকারী ছাত্রদের মুখোমুখি হওয়া নিয়ে চিন্তিত নন। তিনি বলেছেন, 'আমি আমার কলেজ ক্যাম্পাসেই ছিলাম। আমার সকল শিক্ষকরা আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। এরপর ক্লাসে যাবার পরও শিক্ষকরা আমাকে সাহায্য করেছেন। এ জন্য আমার ভয় লাগেনি। আমি হিজাব পরার অধিকার রক্ষার এই লড়াই চালিয়ে যাবো।'

আমরা আশা করবো, বাংলাদেশে যখন নারীর ধর্ম, পোশাক ও অধিকার নিয়ে কুরুচিকর কথা বলা হবে মাইকে, পরিবারে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, তখন প্রতিবাদ হবে চারদিক থেকে।

বিজেপির আমলে ভারতের মতো দেশে মুসকান নামের একজন কালেজছাত্রী যে সাহস দেখিয়েছেন, আমাদের দেশে আমরা কি পারতাম তেমনটা দেখাতে? বাংলাদেশে এমন কিছু হলে মেয়েটাকে উল্টো দোষী সাব্যস্ত করা হতো। বলা হতো, মেয়ে হয়ে স্কুটি চালিয়ে কলেজে যাওয়া কেন রে বাপু? এখন বুঝো। মেয়ে হয়ে প্রতিবাদ করা মানায় না। অন্য ধর্মের নারী হলেতো কথাই নেই। তাই বলছি, সকল দেশে শুধু ধর্ম নয়, সকল ধরনের লৈঙ্গিক বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নাম হোক মুসকান।

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Specific laws needed to combat cyber harassment

There is an absence of a clear legal framework and proper definitions when it comes to cyber violence against women, speakers said at an event yesterday.They urged for specific legislation to combat such crimes..The roundtable, titled “Scanning the Horizon: Addressing Cyber Violence agains

2h ago