‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ টোপটি আর কতদিন গিলতে হবে?
হজরত সুফিয়ান ইবনে সালিম (রা.) বর্ণনা করেছেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, 'মনে রেখো, যদি কোনো মুসলমান অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকদের পক্ষাবলম্বন করবো।' (আবু দাউদ)
মহানবী (সা.) অন্যায়ভাবে অমুসলিমের জান ও মালের ওপর হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন। কারণ এর পরিণতি হবে জাহান্নাম। হজরত আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, 'যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।' (মুসনাদে আহমাদ)
পবিত্র ধর্ম ইসলামকে ব্যবহার করে যখন অধার্মিক, বকধার্মিক ও ধর্ম ব্যবসায়ীরা সচল হয়ে ওঠে, তখন তাদের প্রতিহত করার জন্য প্রগতিশীল সুস্থ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হয় যথাযথ যুক্তি ও অস্ত্র নিয়ে। অবশ্য ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধর্মাধর্মের মূল কথা নিয়ে মাথা ঘামান না। তারপরেও সাধারণ মানুষকে যেন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সহজেই মোটিভেট করতে না পারে, সেজন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
অমুসলিমদের সঙ্গে ব্যবহার প্রসঙ্গে হাদিসে যা বলা হয়েছে, তার কোনো উত্তর আছে সেইসব 'তৌহিদি জনতা'র কাছে? তারা কি এর বিরোধিতা করতে পারবে?
নড়াইলের সাম্প্রতিক ঘটনা এবং এর আগের কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে কেবলই মনে হচ্ছে, ছোটকালে পড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ন্যায়দণ্ড' কবিতার দুটি লাইন। 'অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে; তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে'। মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তাদের তো এই অন্যায় সহ্য করে যেতেই হয়। যখন নড়াইলে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যখন অংক ও বিজ্ঞানের শিক্ষককে জেলে ঢুকানো হয়েছে, যখন শিক্ষককে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেলা হয়েছে বা উত্তরায় শিক্ষকের বাসায় জুম্মার নামাজের পর মৌলবাদী গোষ্ঠী 'নারায়ে তাকবীর' শ্লোগান দিয়ে হামলা চালিয়েছে, তখনও অনেকেই দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছি, বিচার চেয়েছি, ক্ষোভে-দুঃখে ফেটে পড়েছি। কিন্তু ক্ষমতা না থাকায় দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে পারিনি। কাজেই বাধ্য হয়ে এইসব বড় বড় অন্যায়-অবিচার আমাদের সইতে হচ্ছে এবং হয়।
কিন্তু রাষ্ট্র কেন এইসব সহ্য করবে? কেন বাড়তে দেবে ধর্মান্ধ অপশক্তিকে? রাষ্ট্রের ক্ষমতা তো সবচেয়ে বেশি। কাজেই সরকার ও রাষ্ট্র যখন ভেদবুদ্ধির বলি হয়, তখন সেটাকেই অন্যায় সহ্য করা বলে। রাষ্ট্র যখন অন্যায় মেনে নেয় বা চুপ থাকে, তখন নিপীড়িত জনতার মনে কষ্ট ও ক্ষোভ জমা হয়।
দেশের শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত ও নিরক্ষর সমাজের একটা অংশ, প্রগতিশীল নামধারী অনেকে, পেশাজীবীদের একটা বড় অংশ যেহেতু মৌলবাদী গোষ্ঠীর 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' বিষয়ক টোপটি গিলছি, তাই তারাও কোমর বেঁধে এই টোপটিই আমাদের গেলাচ্ছে। তারা দেখেছে এই 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' কথাটি বলে এবং 'নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার' ধ্বনি দিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে অনেক কিছুই উদ্ধার করে ফেলা সম্ভব।
এই অস্ত্র কাজে লাগিয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের বাড়িতে হামলা চালানো যায়, তাদের মা-বোনদের ইজ্জত নেওয়া যায়, ঘরবাড়ি-ভিটেমাটি দখল করা যায়, দোকানে আগুন লাগানো যায় এবং জেলেও পুড়িয়ে দেওয়া যায়। এই একই কথা বলে প্রকৃত মুক্তচিন্তার মানুষকে একঘরে করে ফেলা সম্ভব হয়।
বিশ্বখ্যাত চিত্রকর এস এম সুলতানের জেলা নড়াইলে যা ঘটলো সেই ভিডিও যারা দেখেছেন, তারা বুঝতে পারবেন কতটা ভয়ংকর। ফেসবুকে মুসলমান ও অমুসলিম ২ বন্ধুর কমেন্টের জের ধরে দিঘলিয়া গ্রামে ব্যাপক ভাঙচুর, দোকান লুট, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। উত্তেজিত জনতা রাত ৯টার দিকে আখড়াবাড়ী সার্বজনীন পূজামণ্ডপে আগুন ধরিয়ে দেয়।
প্রশাসন বরাবরের মতোই কাজ করেছে। অভিযুক্ত ছেলেটিকে না পেয়ে তার বাবাকে আটক করেছে। পরে অবশ্য অভিযুক্ত ছেলেটিও আটক হয়েছে। সবাইকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
আমরা অপেক্ষায় ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মর্তুজা কী করেন, তা দেখার জন্য। এলাকার মানুষ তাকে ভালবেসে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, যেখানে সর্ব ধর্মের ভোটার ছিল। তিনি কি খোঁজ নিয়েছেন ঘটনাগুলো কারা এবং কেন ঘটাচ্ছে? এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে, নাকি ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি? অবশ্য এটাও জানতে হবে সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসন আসলে কতটা ক্ষমতা রাখেন উগ্রবাদী ধর্মীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে?
মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তমনের মানুষ ছোট ভাই আরিফ জেবতিক এ প্রসঙ্গে তার ফেসবুক পেইজে যে কমেন্ট করেছে, আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করছি। সে লিখেছে, 'কিছু কিছু ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের মেসেজ খুব ক্লিয়ার। যেসব বিষয়ে মেসেজ ক্লিয়ার সেই বিষয়ে মেসেজ একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়াটাও আওয়ামী লীগ খুব ভালোভাবে পারে।'
হিন্দুদেরকে মারা হবে কি রাখা হবে, এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সেই সিদ্ধান্ত যতদিন নিবে না, ততদিন এই হিন্দু মারা চলতেই থাকবে।
কিছুদিন আগে এক অধ্যক্ষকে জুতা পরিয়ে কলেজ থেকে বের করার ভিডিওটা আরেকবার দেখেন। সেখানে দাঙ্গাবাজ মানুষের চেয়ে পুলিশ অনেক বেশি ছিল। এখানে অধ্যক্ষকে জুতা পরানোর ঘটনা না হয়ে বিরোধী দলের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, এরকম হলে এই পুলিশই কিন্তু ভিন্ন মূর্তি ধারণ করত। কারণ তাদের কাছে মেসেজটা ক্লিয়ার আছে যে, কাকে কখন পেটাতে হবে। যেহেতু হিন্দু অধ্যক্ষ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা ক্লিয়ার না, তাই এত পুলিশ থাকতেও তারা কোনো হস্তক্ষেপে যায়নি। বরং জুতা পরানোতে পরোক্ষ সাহায্য করেছে।
নড়াইলের ইউএনওর ফেসবুক স্ট্যাটাসটা দেখেন (ধরে নিচ্ছি এটা ইউএনওর একাউন্ট)। ইউএনও বা তৃণমূল প্রশাসনের কাছে বার্তা পরিষ্কার না যে হিন্দু রাখা হবে কি না। তাই তৃণমূল প্রশাসন ধর্মে ও জিরাফে সমান তালে তাল দিয়ে যায়।
ধরুন, আওয়ামী লীগ আজ বলল যে, নাহ, দেশে ডাইভার্সিটি, ইকুইটি আর ইনক্লুশন দেখানো দরকার। হিন্দু মারা বন্ধ। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন সব মিডিয়া সাম্প্রদায়িক হামলার বড় বড় নিউজ করা শুরু করেছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট হাইকোর্ট নিয়ে মিছিল বাদ দিয়ে হিন্দু মারা নিয়ে মিছিল বের করা শুরু করবে। পূর্ববর্তী হামলার আসামি কয়েকটাকে ধরে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনে প্রেস কনফারেন্স করবে র্যাব। হেফাজতের যেসব নেতা এখনও জেলের বাইরে আছে, তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং করে তারপর ফতোয়া দিবে যে হিন্দুরা আমাদের আমানত। কেউ বলে ফেলতে পারে যে হিন্দুদের ওপর হামলা করলে বিবি তালাক হয়ে যাবে। সবমিলিয়ে একটি ইন্টিগ্রেটেড মার্কেটিং কমিউনিকেশন (আইএমসি)।
এরপরেও বলতে চাই নড়াইলের সংসদ সদস্য মাশরাফি সাহেব তো হালাল এয়ার ফ্রেশনারের বিজ্ঞাপন করেছেন। তিনি কি জোর গলায় বলতে পারছেন না, হাদিসে আছে 'তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেকো, যদিও সে কাফির হয়। কেননা কোনো মজলুমের মাঝে আর আল্লাহর মাঝে পর্দা থাকে না।' (মুসনাদে আহমাদ)
শুধু হাদিস নয়, পবিত্র কোরআনেও বলা হয়েছে, দ্বীনের (ইসলামি জীবন ব্যবস্থার) ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালোবাসেন।' (সুরা মুমতাহিনা: আয়াত ৮)
মহানবী (সা.) মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সম্মান করেছেন। হোক সে মুসলমান কিংবা অমুসলিম, কাফির, ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান। একবার মহানবীর (সা.) সামনে দিয়ে এক ইহুদির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এসময় তিনি ওই মরদেহের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন হজরত জাবের (রা.) বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! এটি তো ইহুদির লাশ! রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, সে কি মানুষ নয়? (বুখারি)
তিনি অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানের পক্ষ অবলম্বন করেননি। কাজেই আমাদের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রশাসনেরও উচিৎ নয় অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানের পক্ষ অবলম্বন করা।
ফরাসি উপন্যাসের ছোট একটি অংশ তুলে ধরে লেখাটি শেষ করছি। সম্প্রতি একটি লেখায় পেলাম ফরাসি লেখক পিয়েরে বুল এর 'ল্য প্ল্যানেত দ্য সা'জ' বা 'বনমানুষের গ্রহ' উপন্যাসটি সম্পর্কে এই ধারণা। ল্য প্ল্যানেত দ্য সা'জ-এর ওপর ভিত্তি করে 'প্ল্যানেট অব দ্য এপস' নামে কল্পবিজ্ঞান বা সাইফাই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক ফ্র্যাঙ্কলিন জে. শ্যাফনার।
প্ল্যানেট অব দ্য এপস উপন্যাসের মূল কাহিনী এগিয়ে যায় এক ফরাসি সাংবাদিক ইউলিস মেরোকে অনুসরণ করে, যিনি কোনো একটি দূরের গ্রহে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেই গ্রহে সাংবাদিক ইউলিস মেরো দেখতে পান, সেখানে বাকহীন, পশুপ্রবৃত্তির মানুষ বাস করে।
সেখানে বাস করা একটি উন্নতর বুদ্ধি ও প্রযুক্তির এপ বা বনমানুষ সমাজ ওই বাকহীন মানুষদের ধাওয়া করে ধরে তাদের দাসে পরিণত করে নানা ধরণের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করায়। ওই বনমানুষ সমাজে বনমানুষের প্রজাতিগুলোই সমাজে বেশ উঁচু পদে আসীন। তারাই বাকহীন মানুষকে পরিচালিত করছে।
এই কাহিনীতে মানুষকে ব্যঙ্গ বা কটাক্ষ করার জন্য কেঙ্গার মতো ব্যাম্বুতি পিগমিদের সঙ্গে তুলনা করা করা হয়নি। জাতিকে কেঙ্গার মতো বা এপসদের সঙ্গে তুলনার কারণ হলো, মানুষ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে তাদের ক্ষমতা ও শক্তিকে শুধু চর্চা না করা ও কাজে না লাগানোর ফলে অনেক মানবীয় দক্ষতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে আমরা কেঙ্গাদের বা এপসদের মতো হয়ে যাচ্ছি সেটা বলার চেষ্টা করা। একটু ভেবে বলুন তো, কথাটা কি আদতেই সত্য হয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবনে?
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments