‘তেলা মাথায় ঢালো তেল, শুকনো মাথায় ভাঙো বেল’

প্রতীকী ছবি

আমার দাদা একজন আইনজীবী ছিলেন। কলকাতায় কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর গ্রামের বাড়ি নীলফামারী জেলায় নিজ গ্রামে এসে বাস করা শুরু করেছিলেন। বাসায় তদারকির অনেক লোক থাকা সত্ত্বেও দাদা নিজ হাতেই বাড়ির বাগান, গাছগাছালি, গোয়াল ঘর ইত্যাদি দেখাশোনা করতেন। তবে এসব কাজ করার সময় তার সঙ্গে থাকতেন হজো বেটা নামের এক ব্যক্তি। হজো বেটার কাজ ছিল দাদাকে সঙ্গ দেওয়া এবং দাদা যে কাজ করবেন, তাতে সায় দেওয়া।

হজো বেটা আর দাদার কথোপকথনের দৃশ্য ছিল এরকম, দাদা বাড়ির বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর হজো বেটা তার পেছনে পেছনে নতজানু ভঙ্গিতে হাঁটছেন। যেতে যেতে হঠাৎ দাদা বললেন, 'হজো এই বছর গাছে আম কিন্তু ভালোই হইছে।' হজো সঙ্গে সঙ্গে বললেন, 'জি জি জ্যাঠো, এক্কেবারে ঠিক কছেন। আম ভালোই ফইলছে।'

কিছুদূর এগিয়ে দাদা আবার বললেন, 'নারে হজো, আম কিন্তু সেই মতোন ভালো হয় নাই, তুই কি কছিত?' দাদার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই হজো বেটা বলে উঠলেন, 'সেইত্তো জ্যাঠো, সেইত্তো। গাছোত আম তো ভালো না হয়।'

অন্য কোনো সময় দাদা গাছের নীচে বসে বললেন, 'হজো এই বছর বেশ গরম পইচ্ছে। তুই কেমন বুঝিসিত?' হজোর তাৎক্ষণিক জবাব, 'হয় জ্যাঠো, ভালোই গরম পইচ্ছে।' কিছুক্ষণ পর হয়তো দাদা আবার বললেন, 'নারে হজো, এখনো সেইরকম গরম পড়ে নাই।' হজো বেটা উত্তর দিলেন, 'সেইত্তো দেইখবার পাছো জ্যাঠো, এখনো সেই মতোন গরম পড়ে নাই।'

একশ বছর আগে এই ছিল আমাদের বাড়ির হজো বেটা, যার চাকরিই ছিল শুধু দাদার কথায় সায় দেওয়া। মানে 'সেইত্তো জ্যাঠো, সেইত্তো জ্যাঠো' বলে দাদার পিছে থাকা। যদিও হজো বেটার উত্তরের কোনো প্রভাব দাদার কাজের ওপর পড়তো না। কিন্তু কেউ একজন অবলীলায় দাদার কথাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, এটাই বড় কথা। এ কারণে অবশ্য হজো বেটার জন্য বেশ কিছু সুবিধাদি বরাদ্দ থাকতো।

অনেকদিন পরে হজো বেটার কথা মনে হওয়ার একটা বড় কারণ হলো, চারদিকে অসংখ্য হজো বেটার ভিড় দেখতে পাচ্ছি। দাদার এই হজো কিন্তু একজনই ছিলেন এবং হজো এই কাজ করে কোনোরকম বাড়তি সুবিধা আদায়ের চেষ্টাও করেননি।

কিন্তু আমাদের দেশের এসব হজো বেটা প্রতিনিয়ত তেলের ভাণ্ড নিয়ে ঘুরছেন এবং যেখানে সেখানে তেল ঢালছেন। কাকে, কোথায়, কতটুকু তেল দিতে হবে, তা তারা জানেন না বা মানেন না। অথচ অতিরিক্ত তেল যে শরীর ও মনের জন্য ক্ষতিকর, সেটাও তারা ভুলে যান।

চোখে পর্দা লাগিয়ে এই তেলবাজির মহোৎসব চলছেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারের ভেতর, রাজনীতিতে, অন্যান্য পেশায়, বেসরকারি সংস্থায় যে যার মতো করে তেল দিয়েই যাচ্ছেন। উদ্দেশ্য নিজে কিছু একটা অর্জন করা বা পাওয়া, অন্যকে কিছু পাওয়া থেকে বিরত রাখা, নিজের প্রশংসা করার ফাঁকে ফাঁকে অন্যের বদনাম করা এবং সর্বোপরি বড় নেতা বা বসের মন আদায় করা।

এই তেলবাজিটা মাঝে মধ্যে এতটাই নগ্ন হয়ে যায় যে, সাধারণ মানুষ বিব্রতবোধ করেন, হাসাহাসি করেন কিন্তু তেলবাজ ব্যক্তি বুঝতে পারেন না অথবা বুঝেও ফায়দা হাসিলের জন্য কাজ চালিয়ে যান। তেল দেওয়ার সাড়াজাগানো গল্পের মধ্যে আছে, 'স্যার এই ইলিশ মাছটা আমার গ্রামের পুকুরের। তাই নিয়ে আসলাম।' অথবা দোকান থেকে দই বা মিষ্টি কিনে এনে স্ত্রী বানিয়েছে বলে চালিয়ে দেওয়া।

এ ধরনের ছোটখাটো তেলবাজি অফিস-আদালতে ও ব্যবসা ক্ষেত্রে চলে। এতে নিজের পদোন্নতি হাসিল করা যায়, কিছুটা বেতন বাড়ানো যায়, চাকরি পাকা করা যায়। কিন্তু ক্ষতিটা করা হয় প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এসব সংস্থা কখনো মানসম্মত কোনো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে না।

রাজনীতি ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তেলবাজিটা আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়, এর পরিণতিও হয় খুব খারাপ। রাজা রাজ্য শাসন করেন। তার কাজের ভালো-মন্দ, ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। এসব ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই রাজার অনেক মন্ত্রী, উজির, নাজির থাকেন। তাদের দায়িত্ব রাজার বা দেশ পরিচালনাকারীর কাজের ভালো-মন্দ বিচার করা, ভালো কাজকে গতিশীল করা, প্রজা সাধারণের দুঃখ-দুর্গতির কথা রাষ্ট্রনায়কের সামনে তুলে ধরা। সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের কাজে লাগছে, অথবা কোনটা লাগছে না, তা উপস্থাপন করা।

ইতিহাস আমাদের সে শিক্ষাই দিয়েছে যে, ভালো রাজা, ভালো রাষ্ট্রনায়কের এমন পরিষদ থাকবেন, যারা রাজাকে আরও যোগ্য করে তুলবেন। আর তা যদি না হয়, তাহলে বুঝতে হবে রাজা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন দিয়ে কতগুলো অকালকুষ্মাণ্ড পালছেন। এরা রাজার বন্ধু নয়, বরং শত্রু। রাজা যখন বিপদে পড়বেন, এরা তখন কাপড় তুলে পালাবেন। এরা শুধু নিতে জানেন, দিতে নয়।

রাজার কোনো মন্দ কাজের সমালোচনা করলে এই তেলবাজরা রুখে দাঁড়ান। এরা অধিনায়কের চোখে কালোপট্টি বেঁধে রাখেন এবং যারা কাজের ভুল-ত্রটি ধরিয়ে দেন, তাদেরও নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন। এদের কথাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন, 'বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।' এরা রাজাকে এমনভাবে বুঝায় যে, সব ঠিক আছে, যারা আপনার সমালোচনা করছেন, তারা 'সাধু বেশে পাকা চোর অতিশয়'। এদের বিশ্বাস করবেন না।

এমন ধান্ধাবাজ পারিষদ দল কখনো কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনি, পারবেও না। তা সে হোক পরিবারে, অফিসে বা সরকারে। এই তেলবাজিটা অনেকটা বানরের তেলমাখা বাঁশে চড়ার অবস্থার মতো হয়। বানর যেমন বেয়ে বেয়ে, হাঁচড়ে-পাঁচরে ২-৩ কদম উঠে, আবার ৪ কদম নিচে নেমে যায়, ঠিক সেরকম। কারণ অতিরিক্ত তেল খুব বিপদজনক। লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না।

এমনকি ভর্তা, ভাজি, মুড়িমাখা যেসব খাদ্য তেল ছাড়া খাওয়াই যায় না, সেখানেও কিন্তু তেলের একটা মাপ আছে। মাত্রাতিরিক্ত তেল দিলে সেগুলো আর সুখাদ্য থাকে না। বরং অখাদ্য হয়ে যায়, বদহজম হয়। তেল ছাড়া কল চলে না, গাড়ির চাকা ঘোরে না, চুল চকচকে হয় না। কিন্তু মাত্রা ছাড়া তেল আমাদের জন্য কী বার্তা বয়ে আনে, তাও তো আমরা জানি।

আমাদের কোনো খাবারই তেল-ঘি ছাড়া চলে না, সে পান্তাই হোক আর মোঘলাই হোক। সেই সঙ্গে একথাও ঠিক যে, খাবারে যত না তেলের ব্যবহার হয়, তোষামোদিতে হয় তার শতগুণ। তাই বুঝতে পারছি না, সয়াবিন তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে আমরা এতোটা মুষড়ে পড়লাম কেন? তোষামোদি করার সুযোগ তো আরও বাড়ল এতে।

সরিষার তেল নিয়ে বসকে বা লিডারকে বলতে পারি- স্যার ঘানিভাঙা তেল, সয়াবিন তেলের ২ খানা ৫ লিটার বোতল উপহার দিয়ে বলতে পারি- নিজেরাই সয়া দিয়ে এই তেল বানিয়ে এনেছি। আমি যতটুকু জানি তেল দেওয়ার কাজে বাঙালিরা বোধকরি অগ্রবর্তী। অন্য দেশের তেল দেওয়ার খবর তেমন জানি না।

খনা বচন দিয়ে গেছেন, 'তেলা মাথায় ঢালো তেল, শুকনো মাথায় ভাঙো বেল'। খনার বচনকে অব্যর্থ করতে আমরা বাঙালিরা তেলা মাথায় তেল দিয়েই যাচ্ছি। আর যে অসহায়, চুল নাই বা থাকলেও খরখরে সেখানে বেল ভাঙার চেষ্টা করছি।

লেখার শুরুতে ভেবেছিলাম খনার বচন শুধু আমাদের জন্য, কিন্তু অতি সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার বাংলা একাডেমি সেদেশের মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়াকে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য যে পুরস্কারে ভূষিত করেছে, তাতে মনে হলো- হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈল মর্দন বা রাম প্রসাদের তেলের ঘানি টানা দৃশ্য ওই বাংলাতেও আছে এবং তা বেশ কঠিনভাবে আছে।

দেশের জ্ঞানীগুণী মানুষ যখন কলুর বলদ হয়ে পড়েন, তখন আর কী প্রত্যাশা করতে পারি আমরা, মানে সাধারণ মানুষরা? রাম প্রসাদের এই ছয় কলু অবশ্য ঘানির বলদ ঠেলা কলু নয়, প্রতীকী কলু, মানে আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। কাজেই আমরা তেল মর্দনে যতই দক্ষতার পরিচয় দেই না কেন, জীবনটা কেটে যাবে সেই কলুর বলদের মতোই।

লেখাটি শেষ করছি পত্রিকায় পড়া একটি গল্প দিয়ে। বৈবাহিক সূত্রে একটু দূর সম্পর্কের আত্মীয় যশোরের ক্ষিতীশ বাবু সেই যে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে এলেন কিন্তু তার আর যাওয়ার নাম নেই। এখানে তিনি কাজ পেয়ে গেছেন। মূল কাজ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পায়ে তেল মালিশ করা ও বাড়িতে ফুট-ফরমাশ খাটা।

তেলেই লক্ষ্মী, এটা বুঝতে পেরে তিনি দেশীয় ভেষজ দিয়ে সুঘ্রাণ চুলের তেল বানাতে শুরু করলেন। বোতলে ভরে তাতে চুল খোলা নারীর লেবেল এঁটে ঝাকাভর্তি করে মাথায় নিয়ে ফেরি করতে বের হতেন। কিন্তু তার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল যে, তেলের বাজারে প্রচারেই প্রসার। তিনি এসে অবনী ঠাকুরকে ধরলেন এই তেল সম্পর্কে সার্টিফিকেট লিখে দিতে হবে। অবনী ঠাকুর বললেন, আগে রবি কাকার সার্টিফিকেট আনো, তারপর।

তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে হাজির হলেন এবং তার তেলের নামধাম ও গুণাগুণ তাকে শুনিয়ে বাণিজ্যিক কারণে সার্টিফিকেট চাইলেন। ব্যবসায়িক পণ্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ আগেও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন। তিনি অমনি লিখে দিলেন 'অলকানন্দা তৈল সামান্য মাখিলেই চুল ওঠে' - শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। খুশিতে আটখানা হয়ে ক্ষিতীশ ছুটলেন অবনী ঠাকুরের কাছে।

এমনই রসবোধ রবি কাকার যে, তার কথার ভালো মানেও করা যায়, একটু মাখলেই চুল গজায়, মন্দও তো করা যায়। কাজেই তেলের মাহাত্ম্য  ভালোই বুঝতে পারছি আমরা। সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকে এই সয়াবিন তেলের মূল্য বৃদ্ধির জমানায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলে গেছেন, মানুষকে তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে? দেশে শিক্ষিত, মেধাবী, সচ্ছল হজো বেটার সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এত হজো বেটা লইয়া আমরা কী করিব?

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Matarbari project director sold numerous project supplies

Planning Adviser Prof Wahiduddin Mahmud today said the Matarbari project director had sold numerous project supplies before fleeing following the ouster of the Awami League government on August 5.

1y ago