তবে কি ইঁদুর, তেলাপোকাই হবে এদেশের প্রধান বন্যপ্রাণী?
"মরা হাতি লাখ টাকা" ছোটবেলা থেকে এই প্রবাদটা শুনে এলেও, গত কয়েকদিনে ব্যাপারটা খুব কষ্টের সাথে অনুভব করছি। এদেশে মানুষও হত্যা করা হচ্ছে পেশাদার খুনি দিয়ে, হাতিও তাই। মানুষ হত্যা করে মাটি চাপা দিচ্ছে, মানুষের চাইতে ১০০ গুণ বড় হাতিকেও হত্যা করে মাটিচাপা দিচ্ছে। কী ভয়ংকর মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা। খবরে পড়েছি বন দখলকারী একটি চক্র ভাড়াটে খুনিদের নিয়ে হাতি হত্যা করাচ্ছে। শেরপুর, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে একই কায়দায় হাতি হত্যা চলছে। এ যেন এক হত্যার উৎসব।
২০০৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বছরে তিন থেকে চারটি হাতি হত্যা করা হয়েছে, ২০২০ সালে করোনাকালে হত্যা করা হয়েছে ১২টি। আর চলতি বছরে এরই মধ্যে হাতি মৃত্যুর সংখ্যা ৩৩। প্র্রতি তিন দিনে ১ টি করে হাতি হত্যা করা হচ্ছে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খান বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে ইঁদুর তেলাপোকা হবে এদেশের প্রধান বন্যপ্রাণী। ওনার এই আশংকা খুব একটা অমূলক নয়। হাতিদের আশ্রয়স্থল কেড়ে নিয়েছে মানুষ। গাছ কেটে বন সাফ করেছে। হাতি চলাচলের পথে মানুষ বসতি গড়েছে। তাহলে এই নিরীহ প্রাণীগুলো কোথায় যাবে, কোন পথে চলবে? কী খাবে?
দেশের ২৬২টি হাতিকে রক্ষার জন্য সরকার একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করলেও সব শেষ হয়ে যেতে বসেছে। কারণ বনের ভেতরে গাছ কাটার পর সেখানে চোরাকারবারি বা বনউজাড়কারীরা ফসলের চাষ করছে। আর ওই ফসল পেকে ওঠার পর তা রক্ষায় তারা জমির চারপাশে বিদ্যুতের তার দিয়ে দিচ্ছে। হাতি চলাচলের মৌসুমে ওই পথে তারা বিদ্যুতের তার দিয়ে আটকে রাখছে। চলাচলের সময়ে সেখানে বাধা পেয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা পড়ছে হাতি। হাতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেরপুরের শালবনের বড় অংশ এখন আর বনভূমি নেই। সেখানে গাছ কেটে কৃষিকাজ হচ্ছে। এভাবে হত্যা চলতে থাকলে দেশ থেকে হাতি বিলুপ্ত হতে সময় লাগবে না। সরকার ২০১৮ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে হাতির সংখ্যা দ্বিগুণ করার যে পরিকল্পনা নিয়েছিল, তা বাস্তবায়ন আদৌ হবে কি, নাকি দেশ হাতিশূন্য হয়ে যাবে? এটাই এখন ভাবার বিষয়?
এইতো গতবছর কেরালায় একটি গর্ভবতী হাতির বোমা ভরা আনারস খাওয়া ও তিন দিন পানিতে দাঁড়িয়ে থেকে মারা যাওয়ার ঘটনাটি জানার পর বুকটা ভেঙে গেল মা হাতিটার জন্য। মনে হলো আমাকে আমার সন্তানসহ কেউ হত্যা করলো। পরে জানতে পারলাম যে কেরালা বন বিভাগ বলেছে যে এই হাতিটিকে কেউ ইচ্ছে করে বোমাসহ আনারস খেতে দেয়নি। ওই এলাকায় খেতকে বন্য শুয়োরের হামলার হাত থেকে রক্ষার জন্য চাষিরা এরকম করে ডিনামাইট ভরে আনারস দিয়ে রাখে। হাতিটি পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে এরকম একটা আনারস খেয়ে ফেলেছে। পরে এই নিয়মটি তুলে নেওয়া হয়েছে।
সেই ১৫ বছর বয়স্ক হাতিটির ময়নাতদন্তের পর জানা গেছে সে মা হতে যাচ্ছিল। যে ডাক্তার এই ময়নাতদন্ত করেছেন তিনি বলেছেন, 'এর আগে এত কষ্ট আমি কখনো পাইনি। আমার হাতে একটি বাচ্চা, যাকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না।'
এই ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতের মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর, কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও হাতিটির মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। টুইটারে পশুর বিরুদ্ধে এই জঘন্য আচরণের প্রতিবাদে একের পর স্কেচ, ছবি ও স্ট্যাাটাস শেয়ার করছে অগণিত মানুষ।
ভারতের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী রতন টাটাও সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখেছেন, 'আমি ভাবতেও পারছি না মানুষ এমন কাজ করতে পারে। এ ভয়ংকর। এটা ভয়ংকর ক্রিমিনাল কাজ। মানুষ খুন আর হাতি খুনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অবিলম্বে বিচার হোক।' রাষ্ট্রের এই পর্যায় থেকে যখন বড় বড় মানুষ প্রাণী হত্যার বিচার দাবি করেন, তখন সত্যিই খুব ভালো লাগে। মনের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি আসে।
হাতি হত্যা বা বাঘ হত্যা নিয়ে আমাদের উচ্চপদস্থ অনেকেরই কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের কেউ কেউ মনে করেন সৌদি আরবে তো বাঘ নাই, সেদেশের কি উন্নতি হয়নি? ফেইসবুকে সাবেক একজন মন্ত্রীর পরিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক সাক্ষাৎকার ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা দেখলে মনে হবে হয় লোকটি বেকুব, নয় ঘোরেল।
আইইউসিএন মনে করে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতর দিয়ে হাতির যাওয়ার একটি করিডর তৈরির পাশাপাশি দেশে হাতির বিচরণের অন্য পথগুলো সুরক্ষিত করতে হবে। এশীয় হাতি রক্ষাবিষয়ক আন্তমহাদেশীয় জোটের বিশেষজ্ঞ ও হাতি গবেষক মোস্তফা ফিরোজ বলেছেন, হাতি রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বন বিভাগ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এই মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ সরকারের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে হাতি রক্ষায় দ্রুত উদ্যোগ দরকার। (প্রথম আলো)
মানুষ হাতির বনভূমি, যাতায়াতের পথ দখল করেছে বলেই আজ তারা নিরুপায় হয়েই লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। হাতির বিচরণ ক্ষেত্রে মানুষ বসতি গড়ছে, বনবিভাগের জমিতে চাষাবাদও করছে। যখন হাতি সেখানে ঢুকছে, তখন বিদ্যুতের শক দিয়ে বা গুলি করে তাদের মারছে।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক স্পষ্টই বলে দিয়েছেন বন বিভাগের একার পক্ষে হাতি রক্ষা করা যাবে না। কারণ বনের ভেতর অবৈধ দখলদারেরা কীভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়, ফসলের চাষ করে, আর অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে, তা দেখার দায়িত্ব একা বনবিভাগের নয়। সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলোর সহযোগিতা ছাড়া হাতি বাঁচানো যাবে না।
অবশ্য বিদ্যুতের শক দিয়ে বন্য হাতি হত্যা করলে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি হাতি হত্যা করেছে বলে প্রমাণিত হলে কঠিনতর দণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও আইনে অরণ্যের গাছ কাটা, গাছ সংগ্রহ, বন ধ্বংস এমনকি বনভূমি অংশে চাষাবাদ করাও নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু এরপরেও কি কিছু থেমে আছে? বনভূমির জায়গা দখল করে পার্ক, রিসোর্ট, রেললাইন, কল-কারখানা, সড়ক নির্মাণ, চাষাবাদ সব চলছে। জানি না কেউ কখনো এইসব অপরাধের জন্য শাস্তি পেয়েছে কি না?
আমরা নিজেদের প্রয়োজনে হাতি হত্যা করি, আবার হাতিকে দিয়ে চাঁদাও তোলাই। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাতিকে ব্যবহার করে চাঁদা তোলা হচ্ছে। আইন রক্ষাকারী সংস্থার সামনে দিয়েই এই জঘন্য অপরাধ চলছে। যানবাহনের পাশে গিয়ে যখন রাজকীয় প্রাণী হাতি ৫০ টাকার জন্য শুর পাতে, তখন লক্ষ্য করে দেখবেন, তার চোখে কী অব্যক্ত বেদনা। টাকা না চাইলে পিঠে বসে থাকা অমানুষটি বেত দিয়ে মাথায় গুতা মারে। হাতি অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী, দলগতভাবে বিচরণ করে, বাচ্চাকে খুব ভালবাসে, নিজের মতো চলাফেরা করে, বাধা পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সেই রাজকীয় প্রাণীকে মানুষ ভিক্ষুক বানিয়ে ছেড়েছে।
আমাদের দেশেও অনেকে আছেন, যারা পশুপাখিকে রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তবে পশুপাখির প্রতি নির্দয় আচরণই বেশি দেখেছি। দেশে কুকুর, বিড়াল, হাতি, পাখি, শিয়াল, বনবিড়াল, ডলফিন, বাঘ সবাইকে এক কাতারে ফেলে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে যখন পশুপাখির প্রতি নির্দয় কোনো আচরণ করা হয়, তখন কখনো দেখি না রাষ্ট্রীয় পর্যায়, ব্যবসায়ী মহল, রাজনীতিবিদ, আমলা, তারকা বা অন্য পেশাজীবিরা কেউ এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং অপরাধীর বিচার দাবি করেছেন।
রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তেমনভাবে বিচারেরও আশ্বাস দেওয়া হয় না। এ ব্যাপারে আইন থাকলেও কাউকে শাস্তি পেতে দেখি না। গণমাধ্যমে সংবাদ হয়, সামাজিক মাধ্যমে কিছু হৈচৈ হয়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষকরা দুঃখ প্রকাশ করেন, বনবিভাগ তৎপর হয় --- ব্যস তারপর সব শেষ। আমার খুব দুঃখ হয় কেন পশুপাখি নিধন, বন-জঙ্গল লোপাট, নদী ভরাট এইসব ইস্যুকে খুব তুচ্ছ বা কোনো অপরাধ বলেই গণ্য করা হয় না এদেশে।
পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা এক ধরনের মানসিক বিকৃতি বা অসুস্থতা। মানুষই এ জীবজগতে সবচেয়ে বেশি নৃশংস। কারণ একমাত্র মানুষই পারে অপ্রয়োজনে বা তুচ্ছ কারণে ভয়ংকরভাবে মানুষ ও পশুপাখিকে হত্যা করতে। আর কোনো জীব তা পারে না।
প্রাণী অধিকার রক্ষায় জনগণকে সবচেয়ে আগে সচেতন করতে হবে। পশুপাখিকে ভালবাসতে হবে। আর এই কাজে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো তারকাদের কাজে লাগাতে হবে। তারকারা, রাজনীতিকরা, গণমাধ্যম জোর গলায় বলবে প্রাণীরাই মা প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে, আর প্রকৃতি আমাদের বাঁচায়। মানুষকে বোঝাতে হবে তেলাপোকা ইঁদুর নয়, হাতি, বাঘ থেকে শুরু করে একটি বনমোরগও বন্য প্রাণী।
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments