জেলেপল্লীর রুহিণী দাসের জীবন ও ‘ভয় নাই’ বক্তৃতা
দুই ছেলেসহ ১০ সদস্যের পরিবারে ঘরের সংখ্যা ৪টি। রাতের অন্ধকারে আসে হামলাকারীরা। শিশুসহ পরিবারের সদস্যদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুড়ে যায় ঘর, পুড়ে যায় বেঁচে থাকার আশা-ভরসা, স্বপ্ন।
বলছি পীরগঞ্জ জেলেপল্লীর ৮০ বছরের বৃদ্ধ রুহিণী চন্দ্র দাশের পরিবার কথা। দরিদ্র হলেও নিজেদের উপার্জনে চলত পরিবারটি। কারও কাছে হাত পাততে হতো না। তাদের সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে। ছেলের একটি পুরনো মোটরসাইকেল ছিল, সেটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিবারে একটি গাভী ও ছোট একটি বাছুর ছিল। গরুটিও নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। সত্যিকার অর্থেই রুহিণী দাসের পরিবারের এখন কিছুই নেই।কুমিল্লার মন্দিরে কারা কোথায় কিভাবে ধর্ম অবমাননা করেছে, এসবের কিছুই তারা জানেন না।
খোলা আকাশের নিচে আজ কতটা অসহায় রুহিণী দাসের পরিবার! বর্ষা মৌসুম, অনবরত বৃষ্টি। খোলা আকাশের নিচে, চাল নেই। নেই রান্নার ব্যবস্থাও!
অবশেষে ঠাঁই পেয়েছেন রেড ক্রিসেন্টের ছোট্ট একটি তাঁবুতে। পরিবারের ১০ সদস্য নিয়ে তাঁবুতেই কাটছে দিনরাত।
আমাদের বগুড়া প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ আজ ঘুরে দেখেছেন পুড়িয়ে দেওয়া জেলেপল্লী। কথা বলেছেন রুহিণী দাসদের সঙ্গে। নিজের চোখে দেখেছেন তাদের বর্ণনাতীত দুঃখ বেদনা।
জেলেপল্লীতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা কোনো হিসেবে ২৬টি কোনো হিসেবে ৬০টি। রুহিণী দাসের পরিবারের মতো ৪০০-৫০০ মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন। আজকের লেখায় শুধু জেলেপল্লীর মধ্যেই সীমিত থাকব।
এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্যে সরকার কী করছে?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকায় সম্প্রীতি সমাবেশে বলেছেন, 'হিন্দু ভাইবোনদের বলব, আপনাদের ভয় নাই। যতদিন না সাম্প্রদায়িক শক্তির বিষ দাঁত আমরা ভেঙে দিতে পারব ততদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাজপথে থাকবে।'
এই বক্তৃতা কি শুনতে পাচ্ছেন জেলেপল্লীর নিঃস্ব মানুষেরা? তাদের তো রেডিও টেলিভিশন কিছুই অবশিষ্ট নেই। আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা রাজপথে আছেন। কিন্তু হামলা তো হয়েছে পীরগঞ্জের দরিদ্র-মেঠো জেলেপল্লীতে। রাজপথ থেকে তো মেঠো পথের জেলেপল্লী অনেকটা দুরে। তাদের ভয় পেতে নিষেধ করলেন, ভালো কথা। কিসের ভিত্তিতে তারা ভয় পাবেন না? 'হিন্দু ভাই বোনদের' জন্যে কী উদ্যোগ বা ব্যবস্থা নিয়েছেন আপনারা?
৩ দিন হয়ে গেল সরকার বা আওয়ামী লীগ তাদের পাশে আছে? কতটা পাশে আছে? ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় ৬০ পরিবারের জন্যে ১০০ বান্ডিল ঢেউ টিন ও ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। পরিবার প্রতি ১০ কেজি চাল, ১ কেজি ডালসহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস দিয়েছে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান আজ সোমবার জেলেপল্লীতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৬০টি পরিবার প্রতি ১০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। দিয়েছেন কিছু পশুখাদ্য।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন আজ বুধবার ৩১ লাখ টাকা দিয়েছে ২৬টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে। ব্র্যাকের পক্ষ থেকেও সহায়তা করা হচ্ছে। হয়ত আরও কেউ কেউ সহায়তা করবে।
প্রশ্ন হলো ৬০টি পরিবারের শতভাগ দায়িত্ব কেন সরকার নিতে পারছে না? তাৎক্ষণিকভাবে তাদের দায়িত্ব সরকার কেন নিতে পারল না? বিদ্যানন্দের মতো ছোট একটি প্রতিষ্ঠান ৩১ লাখ টাকার সহায়তা দিতে পারলে, ত্রাণ মন্ত্রণালয় কেন ৩ লাখ, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী কেন মাত্র ৬ লাখ টাকা দিলেন? তারা এখন টিন দিয়ে ঘর তুলবেন কীভাবে?
২৬টি বা ৬০টি পরিবারের ঘর তৈরি করে দেওয়াসহ তাৎক্ষণিক পুনর্বাসনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে সরকারের কত টাকা দরকার হয়? সরকারের কি সেই সামর্থ্য নেই? হামলা হয়েছে জেলেপল্লীর মেঠোপথে, 'সম্প্রীতি সমাবেশ' ঢাকার রাজপথে কেন? পীরগঞ্জের জেলেপল্লীতে নয় কেন? জেলেপল্লীর মেঠোপথ কাদা-ময়লা?
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশেও তো সরকারেরই দাঁড়ানোর কথা। হামলা ঠেকাতে না পেরে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। এখন ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সহায়তার চেয়ে বক্তৃতা বেশি কেন?বিরোধীদল সরকারকে অভিযুক্ত করে দায় চাপাতে পারে। সরকার কেন দায় চাপাবে? তার তো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রী 'কঠোর ব্যবস্থা' নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন হামলাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে।
শনাক্ত তো নাসিরনগর বা সুনামগঞ্জেও হয়েছিল।
নাসিরনগরে শনাক্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের তিন জনকে কয়েকদিন আগে মনোনয়ন দিয়ে আবার বাতিল করা হয়েছে। মনোনয়ন বাতিল করা হলেও তাদের আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
সুনামগঞ্জের শাল্লার হিন্দু পাড়ায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিল স্থানীয় যুবলীগ নেতা। এবার চিহ্নিত হলো কারা?
রাজনীতিবিদদের পরস্পরের অভিযুক্তের খেলার অসহায় শিকার এই নিরপরাধ মানুষগুলো। তাদের রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব, পাশে দাঁড়িয়ে পুনর্বাসনও। সেই দায়িত্ব কি সরকার পালন করছে? সরকারের মন্ত্রী নেতারা ব্যবস্থা না নিয়ে কেন এত কথা বলছেন?
বি.দ্র: লেখাটি শেষ করার পর জানা গেলে কুমিল্লার পূজা মণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখেছিলেন ইকবাল হোসেন নামক এক যুবক। যার কারণে তছনছ হয়ে গেল রুহিণী দাসদের জীবন। এখন জানার বিষয় ইকবাল হোসেন আসলে কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন?
mortoza@thedailystar.net
Comments