কোনটা সত্যি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নাকি পকেট গড়ের মাঠ
আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, 'ভালো ভালো পোশাক পরা মানুষদের এখন টিসিবির লাইনে দেখা যাচ্ছে।' সম্ভবত মন্ত্রী মহোদয় এই মন্তব্য করার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের কোনো ইংগিত দিতে চেয়েছেন। বোঝাতে চাইলেন টিসিবির লাইনে দাঁড়ানোটা শুধু দরিদ্র মানুষ ও ছেঁড়া কাপড় পরাদের কাজ নয়, ভদ্রলোকেরাও দাঁড়াতে পারেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যা ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা। কাজেই ভালো কাপড় পরা মানুষদের এই লাইনে দেখাটা বেশ ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে।
অথচ এই ভালো কাপড় পরা একজন নাগরিক সেদিন বিজয় সরণিতে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে জিনিস কেনার সময় তার ছবি তুলতে মানা করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, 'আমি চাই না আমাকে কেউ এখানে দেখুক।'
মধ্য আয়ের দেশ বাংলাদেশে এই হচ্ছে বাস্তবতা। এই বাস্তবতার সবচেয়ে করুণ দিক হচ্ছে অর্থমন্ত্রী সাহেব আশা দিয়েছেন, 'আগামী অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু আয় আরও বেড়ে হবে ৩ হাজার ৮৯ মার্কিন ডলার।' হয়তো তখন এই বর্ধিত মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাজারে দ্রব্যমূল্য কয়েক ধাপ বেড়ে যাবে এবং টিসিবির দেওয়া ন্যায্যমূল্যের পণ্য কেনার লাইন আরও লম্বা হবে।
অবশ্য জিডিপি বৃদ্ধি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অধ্যাপক ড. বিরূপাক্ষ পাল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য নিয়ে সন্দেহ এখনো রয়ে গেছে। ... কোনো দেশেই বাংলাদেশের মতো এমন নিম্নমানের তথ্য নেই। এটি বিশ্রী মনে হতে পারে, তবে সত্য সত্যই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য সবচেয়ে নিম্নমানের।' (২৩ জানুয়ারি ২০২০, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডস)
আমি এই দেশের অতি সাধারণ নাগরিক। আমার অর্থনৈতিক বিষয় বোঝার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। জিডিপি, বৈদেশিক মুদ্রা আয়, ফরেন রিজার্ভ বৃদ্ধি বা কমে যাওয়া, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, এবং আধুনিক হিসেবে মাথাপিছু আয় গণনা করার বিষয়গুলো সম্পর্কে শুনি কিন্তু সব বুঝতে পারি না।
পত্রিকায় দেখলাম, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অথচ আমি এই আনন্দময় অনুভূতিটা বুঝতেই পারছি না। বরং বুঝতে পারছি সংসারের ব্যয়ের হিসাবটা কীভাবে বাড়ছে। অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন এমন একজন বন্ধু বুঝালেন যে মাথাপিছু আয় বাড়লেই আপনার পকেট ফুলে উঠবে তা কিন্তু নয়। মাথাপিছু গড় আয় কিন্তু ব্যক্তির আয় নয়। দেশের বার্ষিক মোট আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয়ের হিসাব করা হয়।
দেশের বার্ষিক এই গড় আয়ের হিসাবের মধ্যে আছেন শত শত কোটি অবৈধ টাকার মালিক, আছেন বৈধ কোটি টাকার মালিক, আছেন আমাদের মতো চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং অতিদরিদ্র মানুষ।
এই যে দেশের জনসংখ্যা, যা দিয়ে বার্ষিক গড় আয়কে হিসাব করা হয়, সেই জনসংখ্যা আদতে কত তা নিয়েও আছে মতানৈক্য। উন্নয়ন সহযোগীসহ সবাই বলছেন দেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটির বেশি, সেখানে বিবিএস বলছে সাড়ে ১৬ কোটি। তাহলে প্রকৃত জনসংখ্যা কত? অবশ্য জনসংখ্যা কম দেখাতে পারলে গড় মাথাপিছু আয় বেশি দেখানো সহজ হবে।
টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তার একটি লেখায় বলেছেন, জনসংখ্যার মূল হিসাবেই যদি গরমিল থেকে যায় তাহলে অন্য সব বাজেট ব্যবস্থাপনা, কৌশল প্রণয়ন ও অর্থনৈতিক হিসাবেও গরমিল দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এমন বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান দিয়ে জাতীয় আয় বাড়িয়ে দেখানো যায়, কিন্তু টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় কখনোই। বিবিএসের মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধির তথ্যের কোনো প্রভাব তাই সাধারণ মানুষের জীবনমান ও কর্মসংস্থানে নেই।
বাজারে জিনিসের মাত্রা ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, বাড়ি ভাড়া, তেল, গ্যাস, পানির দাম বেড়ে যাওয়ার হিসাব পত্রিকা পড়ে বা অর্থনীতিবিদ বা মন্ত্রী মহোদয়দের কথা শুনে বুঝতে হয় না। স্রেফ নিজের ব্যাগে হাত দিলেই বোঝা যায়। আমাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ফারাক বাড়ছে তো বাড়ছেই। অন্যদিকে বাড়ছে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য।
অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়লেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বৈষম্য মাত্রা ছাড়া হয়ে উঠেছে। কারণ বাংলাদেশেই ২০২০ সালে এত বেশি অতি ধনী মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে ঘটেনি।
যদিও ধনী মানুষ বাড়লে মন্দের চেয়ে ভালো হওয়ার কথা। কারণ এই ধনীক শ্রেণী তখন দেশে টাকা বিনিয়োগ করেন। ফলে মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এমনটা হলেও এ দেশে হয় না। এ দেশের ধনী মানুষের টাকা উড়ে উড়ে বাইরে চলে যায়। এরা দুবাই বা কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে তোলেন এবং বিদেশে বসে আরামে দিন কাটাতে টাকা ব্যয় করেন।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধি বিষয়ক আলোচনাতে নাকি সরকারের আগ্রহ থাকে মূলত ব্যয় নিয়ে। মানুষ যত বেশি ব্যয় করবে, প্রবৃদ্ধি তত বাড়বে। এটাই নাকি আমাদের জিডিপি গণনার পদ্ধতি। ফলে মানুষ কোন পথে আয় করছে সেটা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা না থাকলেও, টাকাটা ব্যয় হচ্ছে কি না এটাই মূল বিচার্য।
সেই আয় সৎ পথে না দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সেটা বড় কথা নয়। আর দুর্নীতি থেকে আয় হলেও মানুষ যেন লজ্জা না পায় সেজন্য আছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। আর তাই সাধারণ মানুষ টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে হয়রান হয়ে গেলেও বা লজ্জায় মুখ ঢাকলেও সরকার খুশি। কারণ, মাথাপিছু আয় বেড়েই চলেছে।
এই বাড়তি টাকাটা মানুষের হাতে তাহলে কোথা থেকে আসবে? চাইলেই বেতন বাড়বে না। বেতন বাড়লেও ব্যয় অনুপাতে বাড়বে না। তাহলে কি আমরা দুর্নীতি করে আয় বাড়াবো? সংসার খরচ কমাতে গিয়ে প্রতিদিনের খাবার খরচ, সন্তানের জন্য খরচ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের খরচ, চিকিৎসা খরচ, বিনোদন খরচ— কোনটা কমাবো? এ এক অন্তহীন প্রশ্ন।
যেসব পরিবার মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র তাদের জীবনযাপনের কথা আমাদের মন্ত্রী মহোদয়রা জানেন না। কারণ এই কোনো অবস্থার ভেতর দিয়েই তাদের যেতেই হয় না। দেশের অনেক পরিবার, বিশেষ করে শহরের খেটে খাওয়া মানুষ ও গ্রামের প্রান্তিক মানুষ ৩ বেলার খাবার খেতে পারছেন না। চাল, ডাল আর তেলের মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য মাথা কুটছেন। মাছ, মাংস, মুরগি বাজারের তালিকায় স্থান পাচ্ছে না। এমনকি যারা নিজেদের সচ্ছল বলে মনে করেন, তাদেরও ভাবতে হচ্ছে সংসারের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে।
যে পানি আমরা না ফুটিয়ে ব্যবহার করতে পারি না, যে পানিতে পোকা ভেসে আসে, যে পানিতে বাজে গন্ধ আসে, সেই পানির দাম আরেক দফা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ওয়াসা। ২০০৯ সালের অক্টোবরে তাকসিম এ খান ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরপর থেকে তিনি পানির দাম বাড়িয়েছেন ১৪ বার, আর নিজের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিয়েছেন ৪২১ শতাংশ। এই ১৩ বছরে একদিকে পানির দাম বাড়িয়ে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়েছেন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষেরই করের টাকায় নিজের বেতন বাড়িয়েই চলেছেন।
এতকিছুর পরও কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের কোনো বিচার নেই, সরকারি সেবা খাতগুলোর কোনো জবাবদিহিতা নেই। শুধু সাধারণ মানুষকে দায় নিতে হচ্ছে সবদিক থেকেই। বিভিন্ন বেসরকারি রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা হয়েছে ৫ কোটি। পাশাপাশি দেশে দারিদ্রের হারও বেড়েছে। এর কোনোটাই সরকার মেনে নিত পারছে না, অথচ নিজেরাও কোনো তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছে না। এই বিষয়ক টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে গেছি আমরা জনগণ। নিয়মিতভাবে যাদের পকেট হচ্ছে গড়ের মাঠ।
অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষের যেমন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা হয়েছে, তেমনি খুব অল্প সংখ্যক মানুষের আয়ও দেদার বেড়েছে। হয়তো সেই গড়মিলের হিসাবে জের ধরে আমাদের মাথাপিছু আয় ঠিকই বেড়ে গেছে। আমরাই বুঝতে পারছি না।
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments