কে করবেন চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন
জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশ ২০১৫ সাল থেকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন করছে, যা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০৩০ সালে। এই লক্ষ্যের মূল শ্লোগান হলো, 'কেউ পিছিয়ে থাকবে না'। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব হবে সুরক্ষিত, দূর হবে দারিদ্র, শিশু এবং নারীদের প্রতি থাকবে না কোনো বৈষম্য এবং পৃথিবীর সব মানুষ শান্তি এবং সমৃদ্ধি ভোগ করবে।
বাংলাদেশ সরকারও সেই লক্ষ্যে ছোট-বড় বিবিধ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, যার ফল মূল ভূখণ্ডের মানুষ ভোগ করতে শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের চরাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকায় অনেক মানুষ দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বাস করছে, বিশাল এক জনগোষ্ঠী যাদের জীবনমানের উন্নয়ন আটকে আছে নানাবিধ সমস্যার মধ্যে। তাদের নিয়ে সরকার কি কিছু করছে? করে থাকলে কী করছে, যা দৃশ্যমান নয়? অর্থাৎ এই জনগোষ্ঠী কিন্তু এখনো এসডিজি অর্জনের মূল লক্ষ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অন্তত এ কথা বলাই যায়।
যেসব এনজিও এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চরাঞ্চল এবং উপকূলের মানুষের উন্নয়নে সীমিত পরিসরে কাজ করে তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এসব এলাকায় প্রায় ৬০-৭০ লাখ মানুষ বসবাস করে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগের এক ভাগ। এই বিপুল জনসংখ্যার উন্নয়ন যদি সমানভাবে না হয়, তবে দেশে এসডিজি অর্জনের লক্ষ্য কীভাবে পূরণ হবে?
বাংলাদেশের চরাঞ্চল হচ্ছে অপার সম্ভাবনার একটা জায়গা। চরাঞ্চলগুলোতে প্রায় ৩০ ধরনের ফসলের চাষ হয়। এখানে যে কৃষক ৩০ শতাংশ জমিতে বছরে দুইবার ফসল ফলানোর সুযোগ পান, তার দারিদ্র্য বলে কিছু থাকে না। কারণ চর হচ্ছে শস্যভাণ্ডার। পলি মাটির জন্য এখানে জমিতে বেশি ফসল ফলে।
সীমিত সম্পদের তুলনায় অধিক জনসংখ্যার এই দেশকে নিকট ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় যে চরাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে, এই কথা এখনই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়। কিন্তু যে মানুষগুলো চরাঞ্চলের চরম আবহাওয়া সহ্য করে আমাদের জন্য খাদ্যের যোগান দিচ্ছেন, তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায় না।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, গত এক দশকে বাংলাদেশ সরকার দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অনেকগুলো মেগা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নে। এই পরিকল্পনার বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুযোগ-সুবিধা তো চরাঞ্চলের মানুষ কিছু পাবেন। তবে, সেই লভ্যাংশ মূল ভূখণ্ডের মানুষের তুলনায় অনেক কম। কারণ চরাঞ্চলের মানুষের সমস্যা আসলে চরাঞ্চলের ভূমির সঙ্গে প্রোথিত। সুতরাং মূল ভূখণ্ডে যতই উন্নয়ন করা হোক না কেন, সেটা চরাঞ্চলের মানুষের ওপর খুব কমই প্রভাব ফেলবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হচ্ছে তার ফল চরাঞ্চলের মানুষও ভোগ করছে, কিন্তু সঠিক লাভ উঠাতে পারছে না শুধু অবকাঠামোর দিক থেকে পিছিয়ে থাকার কারণে। যে খরা-বন্যা সহিষ্ণু ফসল কিংবা অধিক ফলনশীল জাতের ফসল তারা চাষ করছেন, তা সঠিক দামে বিক্রি করতে পারেন না শুধু এলাকার দুর্গমতার কারণে।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার মাত্র কয়েকটি চরে দেশের মোট উৎপাদিত কাঁচামরিচের তিন শতাংশের চাষ হয়। বর্তমানে রংপুর এবং রাজশাহী এলাকার চরগুলোতে যে পরিমাণ মিষ্টি কুমড়া চাষ হচ্ছে, তা দিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলার মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব। দেশের স্থলভাগে যখন পাট, ভুট্টা, হরেক রকমের ডাল এবং গমের চাষ কমে যাচ্ছে, তখন চরাঞ্চলে এই সব ফসলের আধিক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এখন দেখা যাক চরাঞ্চল এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের মূল সমস্যাগুলো কী কী এবং সেগুলোর সমাধান সরকার কীভাবে করতে পারে। আগেই বলেছি যে, চরাঞ্চলের মানুষের প্রধান সমস্যা বর্তমানে দারিদ্র্য নয়। মূলত তিনটি সমস্যায় এসব এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন আটকে আছে, তা হলো- যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা। উদাহরণ হিসাবে গাইবান্ধা জেলার দুটি উপজেলার বাস্তবচিত্র এখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
সমস্যা-১
শিক্ষা ব্যবস্থা: গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা শিক্ষা এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে চর এলাকার ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হতে পারে না। মেয়েদের বাল্য বিয়ে হয়ে যায়, আর ছেলেরা জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ে।
ফুলছড়ি উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. কফিল উদ্দিন জানান, এই উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২৯টি। তার মধ্যে চর এলাকায় আছে ৭৭টি। এরমধ্যে গত দুই বছরে ভাঙনের শিকার হয়েছে সাতটি স্কুল। বন্যার সময় অনেক বছর দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত এসব স্কুল বন্ধ রাখতে হয়। অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কোন সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি। এসব স্কুলের গড় শিক্ষার্থী সংখ্যা ১০০ জন। সে হিসাবে চরের স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা হয় প্রায় আট হাজার।
কফিল উদ্দিন আরও জানান, চরের ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী নানা কারণে আর হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারে না।
ফুলছড়ি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মাহবুবুল আলম জানান, এই উপজেলায় চর এলাকাগুলোতে কোনো কলেজ নেই। মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ছয়টি এবং উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে চারটি। এর পাশাপাশি দাখিল মাদ্রাসা আছে দুটি। চর এলাকায় মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে কলেজে ভর্তি হতে পারে না প্রায় ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।
এখান থেকে আমরা দেখছি, এখনো গাইবান্ধার চর এলাকার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নানা কারণে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরুতে পারে না। এর পিছনে দারিদ্র্য, চর এলাকার অভিভাবকদের অসচেতনতা, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বাল্য বিয়েকে দায়ী করেছেন এই মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার।
গাইবান্ধার তিস্তা, যমুনার চরাঞ্চলের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চরাঞ্চলের ৫০ শতাংশ শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে আর পড়াশোনা করে না। কারণ হিসাবে তারা বলেছেন, বাড়ির কাছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অন্য চরে বা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলে খরচ যায় অনেক বেড়ে। প্রতিদিন অভিভাবকদের সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থী প্রতি দিতে হয় ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত। আবার যেসব সচেতন অভিভাবকদের সামর্থ্য আছে, কেবল তারাই সন্তানদের শহরে আবাসিক হোটেল বা মেসে রেখা পড়াশুনা করাতে পারেন। এই অভিভাবকরা জানিয়েছেন, যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হতো কিংবা বাড়ির কাছে হাইস্কুল বা কলেজ থাকতো, তবে দরিদ্র ঘরের ছেলে-মেয়েরাও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারতো।
সমস্যা-২
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: চরাঞ্চলের মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পান বটে, তবে সেটাও পর্যাপ্ত নয়। সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক ও কিছু এনজিও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা সেবা পান, কিন্তু সেটাও নিয়মিত নয়। ফলে হঠাৎ করে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে প্রায় একটা যুদ্ধ করতে হয় পরিবারের সদস্যদের। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে।
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে ১৯টি, যার মধ্যে ১২টি চরাঞ্চলের মধ্যে। এই ১২টির মধ্যে গত দুই-তিন বছরের বন্যায় ভেঙে গেছে পাঁচটি। যেগুলো এখন অস্থায়ী টিনের ঘরে রূপ নিয়েছে। এরমধ্যে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) পদ খালি আছে তিনটিতে। ফলে সেগুলোও বন্ধ আছে।
কিছুদিন আগে আমি নিজে গাইবান্ধা সদর উপজেলা এবং ফুলছড়ি উপজেলার বেশ কিছু চরাঞ্চল ঘুরে দেখেছি, এখানে সিএইচসিপি নিয়মিত সেবা দিতে আসেন না। তারা প্রায় সবাই বসবাস করেন শহরে। নিজ নিজ কর্মস্থলে কেউ যান সপ্তাহে এক দিন, কেউ দুই দিন, কেউবা তিন দিন। অথচ তাদের সেখানে প্রতিদিন যাওয়ার কথা। এই স্বাস্থ্য কর্মীরা যে প্রতিদিন যান না, সেই বিষয়টি জানেন না উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বা সিভিল সার্জন নিজে।
এই উপজেলায় মাত্র একটি স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র রয়েছে কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নে, যেটির অবকাঠামো এতো খারাপ যে চিকিৎসকরা ঠিক মতো বসে লোকজনকে সেবা দিতে পারেন না।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান জানান, উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের প্রায় পাঁচটিই অবস্থিত চর এলাকায়। এই চরাঞ্চলে সেবা দেওয়াটা অনেক কঠিন। তার মতে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। সব সময় নৌকা পাওয়া যায় না। কোনো স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করলে তা ভাঙনের শিকার হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো নির্মাণের জন্য ভালো জায়গা পাওয়া যায় না।
তিনি দুঃখ করে বলেন, চরে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করার জন্য জেলা প্রশাসনের, পুলিশের স্পিড বোট আছে, কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিজস্ব নৌকা নেই। অনেক সময় বাচ্চাদের টিকা দিতে গেলে তা নষ্ট হয়ে যায় বৈরি আবহাওয়া এবং সময়মত যানবাহন না পাওয়ার কারণে। শহর থেকে চরের করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া খুব কঠিন বলে তিনি জানান।
রফিকুজ্জামান স্বীকার করেছেন যে, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তার অভাবে চরে সহজে কোনো স্বাস্থ্যকর্মী থাকতে চান না। শহর থেকে চরের করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া খুব কঠিন বলে তিনি জানান।
এই চিকিৎসকের পরামর্শ হচ্ছে। যদি চরে বড় বড় আশ্রয়ণ কেন্দ্র নির্মাণ করা যায় এবং তার কয়েকটি কক্ষ সারাবছর চিকিৎসকদের বরাদ্দ দেওয়া যায়, তাহলে সেগুলো উপস্বাস্থ্য কেন্দ্ৰ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং চরের মানুষদের দ্বিতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বন্যার সময় চরের নারীরা লোকলজ্জার কারণে দিনের বেলা শৌচকাজ সারতে পারেন না। অপেক্ষা করতে হয় কখন রাত হবে, কারণ সেখানে কোনো পাকা পায়খানা বা স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই।
সমস্যা-৩
যোগাযোগ ব্যবস্থা: চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো খারাপ যে, কেউ যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে তাকে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে শহরের কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগে। বেশি সমস্যা হয় প্রসূতিদের চিকিৎসা পেতে। গাইবান্ধা সদর এবং ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে যারা বাস করেন তারা জানিয়েছেন, মাত্র শতকরা পাঁচ শতাংশ নারীকে সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়, বাকি ৯৫ শতাংশের ক্ষেত্রে বাড়িতে বাচ্চা প্রসব হয়।
জরুরি অবস্থায় অসুস্থ রোগীকে নৌকায় করে কাছাকাছি চরের হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সবসময় নৌকাও পাওয়া যায় না। শুকনো মৌসুমে সমস্যা আরও প্রকট হয়। অন্য চরে যেতে হলে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নৌকা নিয়ে নদী পার হওয়া যায় না।
গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্রের একটি চরের নাম কোচখালী। এই গ্রামের শাহিদা বেগম (২৬) জানান, প্রায় দেড় বছর আগে তার স্বামীর বোন তাসলিমা নাসরীন (২৩) সন্তান জন্মদানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যান। সন্তান প্রসবের পরে জটিলতা দেখা দিলে তাসলিমাকে নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শহরের হাসপাতালে। কিন্তু নৌকা পেতে দেরি হওয়ায় হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তিনি মারা যান। এই চরের আর এক নারী শিরিনা আক্তার (২৮) জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে স্বামীরা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চায় না।
এই এলাকার চর খারজানি, বাটিকামারী চরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন যে, অন্তঃসত্ত্বা নারী, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু, অ্যাজমা রোগী কিংবা বয়স্ক রোগীদের ২০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে নেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে নদী যখন শুকিয়ে যায়। প্রথমে কোনো ঘোড়ার গাড়ি না পেলে জলচৌকি, কিংবা কাপড়ের দুই পাশে দড়ি লাগিয়ে কাঁধে করে রোগীকে নদী পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়। সেখান থেকে অপেক্ষায় থাকতে হয় নৌকার। নৌকা পেলে রোগীকে নেওয়া হয় বালাসী ঘটে। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নেওয়া হয় জেলা শহরের হাসপাতালে। এই প্রক্রিয়ায় তিন-চার ঘণ্টা লাগে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। অনেক সময় রোগী হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মারা যান।
ফুলছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সেলিম পারভেজের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই উপজেলার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ (প্রায় দেড় লাখ) বাস করেন প্রায় ৭০-৮০টি চরে। এই চরগুলোতে যাওয়ার জন্য ভালো কোনো রাস্তা নেই। শুকনো মৌসুমে বছরের ৬-৭ মাস চরের মানুষ পায়ে হেঁটেই শহর-বন্দরে আসা যাওয়া করেন। মালামাল পরিবহনে ব্যবহার হয় ঘোড়ার গাড়ি। যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম হওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত যান না। স্কুলের শিক্ষকরা ঠিক সময়ে আসা-যাওয়া করেন না। ভালো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই এই চরাঞ্চলে। তিনি সরকারের কাছে চর এলাকার মানুষের জন্য বিশেষ উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।
আবার ফিরে আসি চরাঞ্চলের কৃষি সম্ভাবনা কেন প্রাসঙ্গিক সেই বিষয়ে। কৃষির উন্নয়নের সঙ্গে গত দুই দশক থেকে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় ফল-ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটা অব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কথা বলার কারণ হলো, আমাদের দেশের প্রধান ফসল ধান চাষে কৃষক আর তেমন লাভ করতে পারছেন না। ফলে অধিক লাভের আশায় তারা অন্য ফল-ফসল উৎপাদনে ঝুঁকছেন। অথচ আমারদের খাদ্যাভ্যাসে ভাত এখনো প্রধান খাবার। ফলে সরকারকে অধিক মূল্য দিয়ে বিদেশ থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানি শুরু করতে হয়েছে। করোনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেটা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ এই ২০২০-২১ অর্থবছরে যদিও সরকারের চাল আমদানির প্রাথমিক লক্ষ ছিল মাত্র এক লাখ টন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারের চাল-আমদানির লক্ষ দাঁড়ায় ১০ লাখ টন।
উত্তরাঞ্চলের শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত নওগাঁ জেলায় গত ১০ বছরে আমের বাগান হয়েছে দ্বিগুণ। এক দশক আগে যেখানে আম বাগান ছিল আট হাজার হেক্টরেরও কম, সেখানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর নওগাঁয় আমের চাষ হয়েছে মোট ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। এক দশক আগেও এই জমিগুলোতে কৃষকরা ধান চাষ করতেন বলে জানা গেছে।
নওগাঁর মতো প্রায় প্রতিটি জেলায় কোনো না কোনো কারণে কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের নাটোর, রাজশাহীসহ বেশ কিছু জেলায় আবাদি জমি খনন করে মাছ চাষের জন্য বড় বড় পুকুর করা হচ্ছে। অর্থাৎ কৃষক অধিক লাভের আশায় ধান চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য ফসল এবং পেশার দিকে ঝুঁকছেন। এই প্রবণতা দিন দিন আরও বাড়বে এবং আবাদি জমির পরিমাণ কমতেই থাকবে। ফলে যতোই উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ হোক না কেন, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের মোট জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় চাল আর উৎপাদন সম্ভব হবে না। তাই দেশের সার্বিক কৃষি ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ নিতে হলে সরকারকে আবার নতুন করে নীতি তৈরি করতে হবে। সম্ভাবনাময় চরাঞ্চল নিয়ে মেগা প্রকল্প গ্রহণের সময় আমাদের হাতে এখনো আছে। সরকার যদি চরাঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে এখনই নতুন পদক্ষেপ নেয়, তবে তার সুফল আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অবশ্যই ভোগ করতে পারবে।
চরাঞ্চলের উন্নয়নকে ঘিরে যদি মেগা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যায়, যদি নদী শাসনের মাধ্যমে চরগুলোতে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো যায়, সেই সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা যায়, তবে চরগুলো পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে। কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য-প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটবে। স্থায়ী কিছু বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করে কমিউনিটি ভিত্তিক ফসল চাষ, বিক্রি এবং চিকিৎসা সেবাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলো থেকে এ ক্ষেত্রেও আমরা অনেকটা এগিয়ে যাব। মূল কথা হলো, সমস্যা যেখানে যেমনই হোক, তার সমাধান সেই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বের করতে হবে এবং উপযুক্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে সেটা করা সম্ভব বৈকি।
mostafashabujstar@gmail.com
Comments