‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’
বহু বছর আগে কাজে বরিশাল গিয়েছিলাম। কাজ শেষ হয়ে গেলে দলের সবাই জীবনানন্দ দাশের ভিটা দেখার জন্য রওনা দিলাম। শহরের বগুড়া সড়কে এই বাড়ি শুনেছিলাম। দলের সবাই মোটামুটি জীবনানন্দ দাশের ভক্ত। তাই আমাদের পুরো দল চোখে স্বপ্ন নিয়ে, জোর গলায় কবির কবিতা আবৃত্তি করতে করতে যখন জীবনানন্দ দাশের বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখন দেখলাম অধিকাংশ মানুষ বলতেই পারছেন না, চেনেনই না কবিকে বা কবির বাড়িকে। অথচ এ মাটিতেই জীবনের ৩০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়ে নীরবে চলে গেছেন এই বিখ্যাত কবি।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর সেখানকার থিয়েটার করা একটি ছেলে বলল, আপনারা অমুক মিয়ার (এখন নামটা ভুলে গেছি) গ্যারেজ খুঁজুন, তাহলে জীবনানন্দ দাশের বাসা পাবেন। কারণ ওই গ্যারেজ এই এলাকার লোকেরা চেনে, কিন্তু কবির বাড়ি চেনে না। এর মানে হচ্ছে ওই গ্যারেজের উল্টো দিকে কবির ভিটা। আমরা হতভম্ব হলেও সেই গ্যারেজ খুঁজে বের করলাম।
সহজেই গ্যারেজটি খুঁজে পেতেই পেলাম 'ধানসিঁড়ি'। আমাদের জীবনানন্দের বাড়ি। কিন্তু জীবনানন্দের বাড়িটি কোথায়? না কোনো বাড়ি নেই এখানে। কবির স্মৃতি হিসেবে আছে ধানসিঁড়ি নামের বাড়ির সেই নামফলক, আর একটি দেয়াল। গ্যারেজের লোক জানাল, এই ভিটা বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন ভবন উঠেছে, আরও উঠবে। মনটা খুব বিষণ্ণ হয়ে গেল ধানসিঁড়ির ফটকের নিচেই স্তূপ করে রাখা নির্মাণসামগ্রী দেখে।
এখানে তার সম্পর্কিত পিসির বাড়িটা দেখতে পেলাম। কিন্তু উনি নাকি কথা বলতে চান না। তাই আর ঢুকলাম না। মনটাও খুব খারাপ হয়েছিল এই ভেবে যে, বাংলায় জন্ম নিয়ে বাংলার মাটিকে ঋণী করে রেখেছেন যে কবি, তার প্রতি কেন এত অবহেলা? নেই কবিগৃহ, নেই শাল-শিরিষের গাছ, নেই পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবাহী মঠ। এটা ছিল তার বাবার তৈরি করা বাড়ি।
সবাই এত কষ্ট পেয়েছিলাম যে, ফেরার পথে আর কোনো কথা বলিনি কেউ। মনে মনে শুধু ভেবেছিলাম যদি কবি কখনও মানুষ না হয়ে শঙ্খচিল বা শালিকের বেশে ফিরে আসেন এই পশ্চিম বগুড়া রোডে, কী দেখবেন তিনি? অবহেলা, অযত্ন, ভালোবাসাহীনতা? যার কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি, সেই কবির ভিটে-মাটিটুকুও কি আমরা রক্ষা করতে পারতাম না? বগুড়া রোডটিকে সিটি করপোরেশন জীবনানন্দ দাশ সড়ক নামকরণ করেছে। তবে স্থানীয়দের অনেকেই এখনও চেনেন না এই সড়ক।
মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনো কোনো মানুষ বাংলাদেশে জন্ম না নিলেই পারতেন। এতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হতো জানি না, অন্তত সেই মানুষটির যে সম্মান প্রাপ্য ছিল, তা হয়তো তিনি পেতেন। গত ২২ অক্টোবর ছিল কবির চলে যাওয়ার দিন। তাই এই কথাগুলো মনে হলো।
কবি নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। অথচ আমরা আশির দশকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন দেখেছি কবির সমাধিক্ষেত্রের কী দুর্বিষহ অবস্থা ছিল। মানুষ যেমন-তেমন করে ব্যবহার করতো এই সমাধিক্ষেত্রকে। যাক তাও গত কয়েকবছর ধরে দেখছি বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে। নিরাপদ করে রাখা হয়েছে।
বছর দুয়েক আগে শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছিলেন, 'বাবার মৃত্যুদিন নেই, কবর নেই। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাবার নামে একটা পলাশ গাছ বুনেছিলাম আমরা কয়জনা, শহীদ মিনার চত্বরের মাঝে। নিজের টাকায় চারা, লোহার গ্রিল আর ব্যানার তৈরি করে দিয়েছিলাম। বাবার কবর নাই তাতে কী হয়েছে, পলাশ গাছটাই আমার কাছে বাবা হয়ে, বাবার কবর হয়ে থাকে প্রতিদিন।'
কেন শহীদ কন্যাকে এই স্ট্যাটাস দিতে হলো? স্ট্যাটাসের নিচে দেখলাম একটি ছবি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি পলাশ গাছ। এর চারপাশে লোহার বেড়া দেওয়া। একটা সাইনবোর্ডে লেখা 'শহীদ আলতাফ মাহমুদ চত্বর'। সেই সাইনবোর্ডটা বিভিন্ন রং দিয়ে এবড়ো-থেবড়ো করে দাগানো। কী লেখা আছে তা পড়া যাচ্ছে না। এর চেয়েও বড় কথা লোহার বেড়ার দু'পাশে তিনটি প্লাস্টিকের ডাস্টবিন শিল্পকলা একাডেমির সৌজন্যে ঝুলানো হয়েছে।
আমি জানি না এই শিল্পকলা একাডেমি থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? শহীদ আলতাফ মাহমুদ চত্বর দেখার পরও কীভাবে এখানে ডাস্টবিন টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল? কারা এখানে চত্বর লেখা নোটিশবোর্ডে দাগ দিয়ে নষ্ট করল? তারা কি শহীদ আলতাফ মাহমুদকে চেনে না? নাকি চিনেও এই কাজ করল? যে গান শুনে আমরা একুশ উদযাপন করি, সেই গানের সুরস্রষ্টার প্রতি এ কেমন অসম্মান?
'জাগো বাহে কুন্ঠে সবাই' বলে আজও আমরা নুরুলদীনের মতো হাঁক দিয়ে যাই। 'পরাণের গহীন ভিতর' পড়ে আন্দোলিত হই। অথচ সেদিন এক লেখা পড়ে জানলাম, কতটা অবহেলা ভরে পড়ে আছে সব্যসাচী লেখক, কবি সৈয়দ শামসুল হকের সমাধিস্থল। কবি নিজে এই স্থান নির্বাচন করে গেছেন, কবরের এপিটাফও লিখে গেছেন। সমাধিসৌধের ডিজাইন করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও স্থপতি কবি রবিউল হুসাইনকে। স্থপতি তা করেছেন এবং নিজেও পরলোকগত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রায় ৫০ কোটি টাকার একটি খসড়া প্রকল্প তৈরি করেছে। কিন্তু এরপরেও প্রকল্পের অগ্রগতি বা সমাধির উন্নয়ন হয়নি।
'২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের ঘোর বর্ষায় সৈয়দ শামসুল হক সমাধিস্থ হন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে। সেসময় কলেজের কয়েকটি ভাঙাচোরা টিন দিয়ে কবরের ওপর নামমাত্র একটি ছাদ দেওয়া হয়েছিল, যাতে কবরটি ভেঙে না যায়। এখনও সেই ভাঙা টিনের চালই কবরের ওপর আছে। এখন যদি ওই টিন কোনো কারণে সরানো হয় বা ঝড়–বাদলায় উড়ে যায়, তাহলে বৃষ্টির জলে বালু–মাটির কারণে কবরটি যেকোনো সময়ে ভেঙে দেবে যাবে।' (প্রথম আলো)
সৈয়দ শামসুল হকের মতো বরেণ্য মানুষের এই দেশকে আর দরকার নেই, কিন্তু এই দেশের দরকার আছে তাকে ধারণ করা, সম্মানিত করার।
রণেশ মৈত্রের একটি লেখায় পড়েছিলাম, পাবনা শহরের অদূরে ডা. ফজলে রাব্বীর পৈত্রিক ভিটা আজও আছে এবং সম্পূর্ণ অরক্ষিত ও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। একজন শহীদ ও বড়মাপের ডাক্তার শুধু এইটুকু জেনেই কৃষকরা গ্রামে তার নামে একটি প্রাথমিক স্কুল তৈরি করেছেন। অথচ আমরা বা সরকার কিছুই করিনি, তার বা তাদের মতো মহান মানুষদের স্মৃতি রক্ষার্থে। উপেক্ষা ও ভালোবাসাহীনতার এরকম শত শত উদাহরণ দেওয়া যাবে।
তাই যখন দেখছি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে শহীদদের, বীরশ্রেষ্ঠদের ছবি ভুলভাবে, ভুল পরিচয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন আর অবাক হই না। আমাদের মতো অনেক শিক্ষিত লোকেরও শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানের পরিধি খুবই দুর্বল। এতটাই দুর্বল যে, দেশ, ইতিহাস, কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর, শিল্পী, চিত্রজগত সম্পর্কে কিছুই জানি না বা অর্ধসত্য জানি। ফলে কাকে, কী বা কতটা সম্মান দিতে হবে, সে সম্পর্কেও আমরা সচেতন নই বা উপেক্ষা করি।
আজকাল আমরা শুধু দিবসগুলো উদযাপন করি, কিন্তু মনে গ্রহণ করি না। কোন দিবসের কী তাৎপর্য, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। দিবস উদযাপন মানে বুঝি শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে মাথায় ফুলের তোড়া দিয়ে ঘুরে বেড়ানো, মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে রাস্তায় চ্যাঁচামেচি করা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাল, ডাল, মুরগি, গরু, টেবিল-চেয়ারের ওপর ছাড় দেওয়া।
এই যে শহীদ মিনার, আমাদের প্রাণের পরিচয়। এই যে রায়েরবাজার বধ্যভূমি, শহীদের স্মৃতিসৌধ, এসব জায়গায় কেউ যদি দিবস উদযাপনের দিন ছাড়া যান, তাহলে মনটা বিষণ্ণ হয়ে যাবে চারপাশের অবস্থা দেখে। নোংরা আবর্জনা, ফলের খোসা, চিপস, আইসক্রিম বা ঝালমুড়ির খালি প্যাকেট, কফ, থুথু, বৃষ্টির পানি কাদায় চারিদিক সয়লাব। নেশাখোর, ছিনতাইকারী সবাই টহল দেয় এগুলোর চারপাশে। এই বিশেষ এলাকাগুলোর নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে কি কেউ নেই? শুধু দিবস উদযাপনের জন্য কেন বেদীকে পরিষ্কার করতে হয়?
অপ্রিয় হলেও এ কথা সত্যি যে, বাংলাদেশের শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সিনেমা, নাটক, আন্দোলন, উদযাপন বা যেকোনো সৃষ্টিশীল পেশা সবকিছুই আজ নিম্নমুখী। বহু স্থানে অযোগ্যরা জায়গা করে নিয়েছে বলেই যোগ্যরা হারিয়ে যাচ্ছেন বা অভিমান করে দূরে সরে আছেন। যারা একেবারেই চলে যাচ্ছেন, তাদের মতো আর কাউকে এই দেশ আর খুঁজে পাবে না। তাই কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলি-
'অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।'
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments