ইসি পুনর্গঠন: গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও মানুষ কেন রসিকতা করে?

রোববার সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে আমন্ত্রিত নাগরিকদের সঙ্গে সার্চ কমিটির বৈঠক। ছবি: এমরান হোসেন

এবার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অনেক বিশিষ্ট নাগরিকও সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে রসিকতা করছেন, সেটি একটি নতুন ডাইমেনশন।

ইসির মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে মানুষের এই রসিকতার পেছনে রয়েছে মূলত বিগত কয়েক বছরে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাটি ধ্বংস হওয়ার ক্ষোভ।

বাস্তবতা হলো, শুধু নির্বাচন বা নির্বাচন কমিশন নয়, অন্যান্য সব সিরিয়াস বিষয় নিয়েই মানুষ এখন রসিকতা করে।

যখন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে মানুষ কথা বলছে, তখনই পুলিশের জন্য বিছানার চাদর কিনতে বা চাদরের মান যাচাই করতে পুলিশ প্রধানের জার্মানি সফরের বিষয়টিও আলোচনা ও বিতর্কের টেবিলে ওঠে এবং স্বভাবতই মানুষ এটি নিয়েও রসিকতা শুরু করে।

এর একটি বড় কারণ বোধ হয় এই যে, মানুষ জানে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা করলে তাতে ফেসবুকে খুব বেশি লাইক বা কমেন্ট পাওয়া যায় না। আবার সিরিয়াস বিষয় নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা করলে তার কিছু রাজনৈতিক বিপত্তিও আছে। কারণ রাষ্ট্রের সিরিয়াস বিষয় নিয়ে সিরিয়াস মন্তব্য করলে সেটি সঙ্গত কারণেই ক্ষমতাবানদের বিপক্ষে চলে যায়। তাতে করে সমালোচনাকারীকে সরকারবিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে দেয়ার শঙ্কা থাকে। এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়ারও ঘটনা ঘটতে পারে।

গত কয়েক বছরে যে প্রবণতাটি সবচেয়ে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে তা হলো, সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা মানেই হলো রাষ্ট্রদ্রোহিতা; সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও সেটি আওয়ামী লীগবিরোধিতা; আর সরকার বা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা মানেই সেটি বিএনপি-জামাতের ষড়যন্ত্র। যার অর্থ দাঁড়ায় দেশে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের বিরোধী—এর বাইরে আর কোনো শক্তি বা আর কোনো গোষ্ঠী এমনকি আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাতের বাইরে আর কোনো পক্ষ নেই, থাকতে পারে না।

এই যে সরল সমীকরণটি তৈরি করা হয়েছে, তার ফলেও সাধারণ মানুষ এমনকি বিশিষ্ট নাগরিকেরও গণমাধ্যম তো বটেই, সোশ্যাল মিডিয়ায়ও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভয় পান। ভয় পান বলেই তারা রসিকতা করেন। অর্থাৎ রসিকতাটাই এখন ক্ষোভ ও রাগ প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, মানুষের এই রসিকতার অর্থ সরকার, নীতিনির্ধারক এমনকি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে যে সার্চ কমিটি করা হলো, সেই কমিটি উপলব্ধি করতে পেরেছে কি না? কারণ নাগরিকদের এই রসিকতার ভেতরে অনেক প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। এই রসিকতার ভেতরেই আছে যে নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা কী এবং তারা আসলে কেমন নির্বাচন কমিশন প্রত্যাশা করে।

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে এবার একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে। একজন সিইসি এবং চারজন কমিশনার—এই পাঁচটি পদের বিপরীতে নাম জমা পড়েছে ৩২৯টি। অর্থাৎ প্রতি পদের বিপরীতে প্রায় ৬৬ জন। একজন সাংবাদিক ফেসবুকে রসিকতা করে এই ঘটনাকে 'বিসিএস পরীক্ষার চেয়েও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা' বলে মন্তব্য করেছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোনো কোনো আগ্রহী প্রার্থী নিজেই নিজের নাম সার্চ কমিটির কাছে জমা দিয়েছেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে গিয়ে নিজের জন্য তদবির করেছেন –এরকম খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। যারা এরকম তদবির করেছেন, তাদের মধ্যে প্রশাসনের সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও আছেন।

১০ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের একটি সংবাদ শিরোনাম: ইসিতে জায়গা পেতে নজিরবিহীন তদবির। খবরে বলা হয়, দুই শতাধিক ব্যক্তি স্বীয় উদ্যোগে ইসিতে জায়গা পেতে অনলাইন কিংবা সশরীরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে উপস্থিত হয়ে অনুসন্ধান কমিটির উদ্দেশ্যে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন। কেউ প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবার অনেকে নির্বাচন কমিশনার হতে আগ্রহ প্রকাশ করে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিচ্ছেন। আবেদনকারীদের মধ্যে সাবেক সামরিক বেসামরিক আমলা, বিচারকও রয়েছেন। অনুসন্ধান কমিটি যেন শেষ পর্যন্ত স্বীয় নাম বহাল রাখে সে বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন-নিবেদন করতেও দেখা গেছে। প্রশাসনের পাশাপাশি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজনকে জীবনবৃত্তান্ত হাতে হাতে জমা দেওয়ার সময় বলতে শোনা গেল—'দেখ নামটা যেন থাকে, আমার সম্পর্কে তুমি তো জান'। জবাবে 'জ্বি স্যার' বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তা বললেন, 'কী যে বলেন স্যার, আপনার যদি না হয় তবে আর কাকে নিয়ে হবে।'

সমকালের একটি শিরোনাম: ইসি হতে ১৩ জনকে দিয়ে সুপারিশ। খবরে বলা হয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আবদুল আউয়াল বিশ্বাস নির্বাচন কমিশনার হতে ১৩ জনকে দিয়ে সুপারিশ করিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সাংবাদিকরা এ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, তার জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মোট ২৫ জন ব্যক্তি সুপারিশ করছেন। নির্বাচন কমিশনার হতে এরকম সুপারিশ বা তদবিরের ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম শুধু নয়, বিশ্বের আর কোনো দেশে এরকম ঘটনা ঘটেছে কি না সন্দেহ।

সরকারি বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগ বা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত হতে নানারকম রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তদবিরের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। কিন্তু সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পেতে এরকম নির্লজ্জ তদবির আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সামগ্রিকভাবে আমাদের রুচি-বিনয়-ভদ্রতা ও শালীনতার কী ভয়াবহ অধঃপতন হয়েছে!

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বরাতে জানা যায়, সার্চ কমিটির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিশিষ্টজনরা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে নানারকম পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের অনেকে অনেকের নামও প্রস্তাব করেছেন। যেমন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সিইসি হিসেবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনের নাম প্রস্তাব করেছেন। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বিতর্কিত উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর নামও নাকি কেউ কেউ প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু সাখাওয়াত হোসেনের মতো দক্ষ এবং দলনিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত লোকও যদি সিইসি হন, তিনিও বর্তমান ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবেন কি না—সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। বিশিষ্টজনরাও যেটি এড়িয়ে গেছেন বা যেটি তারা আলোচনায় আনেননি তা হলো, দেশের সবচেয়ে সৎ, যোগ্য, মেধাবী ও দলনিরপেক্ষ পাঁচজন লোকও যদি সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান—তাদের পক্ষেও দেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোয় অবাধ-সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা হয়তো সম্ভব, কিন্তু গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য এবং ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করা সম্ভব নয়, যদি না ক্ষমতাকাঠামোয় পরিবর্তন আন যায়।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী  সরকার, সংসদ ও দল যেভাবে একাকার—সেই জায়গায় একটি সাংবিধানিক পরিবর্তন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানকেই (সেটি সাংবিধানিক অথবা অন্য কোনো সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান) পুরোপুরি স্বাধীন ও দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা কঠিন।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে এখন কোনো ভারসাম্য নেই। প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে সংসদ নেতা, সরকারের প্রধান নির্বাহী, দলের প্রধান এবং রাষ্ট্রপতিকে যেহেতু সকল সিদ্ধান্ত তার সঙ্গে পরামর্শক্রমে করতে হয়, ফলে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) প্রকারান্তরে রাষ্ট্রপ্রধানও।

সুতরাং, যদি রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক থেকে যায় এবং রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান যদি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত কোনো কাজ না করে বা করতে না পারে, তাহলে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে আইন করা হলেও, যে ধরনের মানুষদের নির্বাচন কমিশনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়ার কথা, সেটি নিশ্চিত করা কঠিন। বরং এতদিন যারা যেসব যোগ্যতা ও মানদণ্ডে নিয়োগ পেয়েছেন, মোটামুটি তারাই নিয়োগ পাবেন এবং এতদিন নির্বাচন কমিশন যে ধরনের কাজ করেছে, তার বাইরে গিয়ে সত্যিকারের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।  

সর্বোপরি, নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে আইন করা হলো কি না; কোন প্রক্রিয়ায় তাদের নিয়োগ দেয়া হলো, তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন নির্বাচন কমিশন কাজের ক্ষেত্রে আসলেই কতটা স্বাধীন? সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের এখতিয়ার কতটুকু এবং মাঠ প্রশাসন তাদের আদেশ-নিষেধ কতটা মানে; না মানলে শাস্তি কী? এইসব প্রশ্নের সুরাহা না করে খুব ভালো নির্বাচন কমিশন গঠন করেও মূল কাজ যে ভালো নির্বাচন—সেটি নিশ্চিত করা কঠিন। তার চেয়েও বড় কথা, দলীয় সরকারের অধীনে যে অন্তত জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হয় না, সেটি অতীতে বারবারই প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুযোগ নেই। তার মানে বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে সেটিও কতটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবে, তা নিয়েও সংশয় আছে।  

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments